বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের পর এই বনে বসে যে প্রশ্নের মুখে আমি সবচেয়ে বেশি পড়ছি তা হলো, এই ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা৷ প্রশ্নের উত্তরটি নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছি আমি৷
বিজ্ঞাপন
একবার মনে হচ্ছে এসব ছাত্র সংগঠনগুলো সত্যিই নিয়ন্ত্রণহীন৷ বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনাও বলেছেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে শাস্তি পেতে হবে৷ বলা যায়, বুয়েট ছাত্রলীগ শাখার গুরুত্বপূর্ণরা এরকম একটি কাণ্ড করবেন বা করতে পারবেন তা আসলে কেউ ভাবতে পারেননি৷ হঠাৎ করেই তারা এরকম একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন৷ যেমনভাবে পদবঞ্চিত ছাত্রদলের নেতারা বিএনপির নয়াপল্টন অফিস ভাংচুর করেন অনেকটা সেরকম আর কী৷
কিন্তু আবার মনে হয়, বুয়েটের ছাত্রলীগ শাখা কি সত্যি এত বোকা! কী মোক্ষ বা কী লক্ষ্য তারা অর্জন করবেন বলে ভেবেছিলেন ফাহাদকে পিটিয়ে? কেন তাদের মনে হয়েছিল ফাহাদকে রাত দুপুরে ডেকে এনে পেটানোটা জরুরি৷ কাকতালীয়ভাবে একদিন আগে ফাহাদ ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিল, যেখানে সে প্রশ্ন তুলেছিল ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে৷ ছাত্রলীগ কিন্তু এর আগেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাজ বা কথার মান-মর্যাদার পাহারাদার হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে৷
দুর্নীতির দায়ে পুরানো কমিটি বিদায় নেওয়ার পরপরই নতুন কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কেউ ধৃষ্টতা দেখালে ‘তার পিঠের চামড়া থাকবে না৷ গত বছর কোটা সংস্কারকারীদের উপর হামলার প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রশ্ন করলে তারা আমাকে বলেছিলেন, আন্দোলনকারীদের অপরাধ তারা শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ করেছিলেন৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হতেই পারে, আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কাজ এবং কথা প্রশ্নাতীত রাখা ছাত্রলীগের প্রধান দায়িত্বগুলোর একটি৷
ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক নৃশংসতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগ৷ বিশ্বজিৎ থেকে আবরার পর্যন্ত তাদের নির্যাতনে মারা গেছে বেশ কয়েকজন৷ কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টি, কারো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে শরীরের হাড়৷ বিচার হয়নি অনেক ঘটনারই৷
ছবি: bdnews24.com
দখলবাজির শিকার আবু বকর
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন মেধাবী ছাত্র আবু বকর৷ ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী শক্ত ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবু বকরের মাথা থেঁতলে দেয়া হয়৷ এই হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়৷ ২০১৭ সালে আদালতের রায়ে ছাত্রলীগের অভিযুক্ত ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পায়৷ (ছবি: সাম্প্রতিক)
ছবি: bdnews24.com
খাবার নিয়ে বিরোধে হত্যা
২০১০ সালে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ইফতারের টোকেন সংঘর্ষ বাধে রাজশাহী ছাত্রলীগের মধ্যে৷ তার জের ধরে দলটির কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে পিটিয়ে শাহ মখদুম হলের দ্বিতীয় তলা থেকে ফেলে দেয়া হয়৷ ১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর তার মৃত্যু হয়৷ এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় ১০ জন, যাদের সবাই এখন জামিনে৷
ছবি: DW/A. Khanom
জুবায়েরকে কুপিয়ে হত্যা
২০১২ সালে জানুয়ারিতে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের৷ তাকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করে তারই সংগঠনের প্রতিপক্ষরা৷ এই মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালে পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন৷ গত বছরের জানুয়ারিতে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড ও দুজনের যাবজ্জীবন বহাল রাখে হাইকোর্ট৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজনই পলাতক৷
ছবি: bdnews24.com
দুর্ভাগা বিশ্বজিৎ
বিশ্বজিৎ দাস ছিলেন পুরান ঢাকার একজন দর্জি৷ ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নৃশংস হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়৷ সেসময় ১৮ দলের অবরোধ চলছিল৷ বিশ্বজিৎ শিবির কর্মী এমন ধারণা করে তাঁকে চাপাতি, কিরিচ দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কোপায় ছাত্রলীগ কর্মীরা৷ আলোচিত এই ঘটনায় নিম্ন আদালতে আট আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন, দুইজনকে খালাস আর পলাতক দুইজনের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট৷
ছবি: bdnews24.com
বাদ যায়নি শিশুও
২০১৩ সালে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয় মারা যায় ১২ বছরের শিশু রাব্বি৷
ছবি: bdnews24.com
আধিপত্য বিস্তারের বলি তাপস
২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার৷ ২০১৬ সালে এই ঘটনায় ২৯ নেতাকর্মীর নামে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ৷ মূল আসামী আশরাফুজ্জামানসহ গ্রেপ্তারকৃত ১৫ জনই জামিনে পান৷ (ছবি: প্রতীকী)
ছবি: Fotolia/Scanrail
খাদিজার মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরা
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবরের ঘটনা৷ এমসি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে বের হবার পরই খাদিজা আক্তার নার্গিসকে চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি)-র ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম৷ নার্গিসকে মৃত ভেবে পালিয়ে যাওয়ার সময় পথচারীরা বদরুলকে আটক কোরে পুলিশে দেয়৷ আলোচিত এই ঘটনায় বদরুলের যাবজ্জীবন সাজার রায় দিয়েছে আদালত৷
ছবি: bdnews24.com
হেলমেট বাহিনীর হামলা
গত বছর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র কিছু যুবক ধানমন্ডি, জিগাতলা এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিকদের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করে৷ হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী বলে বিভিন্ন গনমাধ্যমে পরিচয় সহ খবর বের হয়৷ কিন্তু এই ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, কারও বিচারও হয়নি৷
ছবি: Bdnews24.com
হাতুড়ি মামুনদের বিচার হয়নি
দেশব্যাপী কোটা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ ওঠে৷ তেমনই একটি ঘটনা ঘটে গত বছরের ২ জুলাই৷ তরিকুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় পেটায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী৷ তাকে হাতুড়ি পেটা করে দলটির সহ-সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-মামুন৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: bdnews24.com
চোখ হারানো এহসান
গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে এহসান নামের এক ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা৷ নিজের ক্যালকুলেটর ফেরত চাইলে এই হামলা চালায় তারা৷ এসময় তাকে শিবির কর্মী বলেও অপবাদ দেয়া হয়৷ হামলায় এহসানের চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয়৷ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৭ নেতা-কর্মী বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার হলেও তারা হলে থাকতেন বলে খবর বের হয়৷ অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছাড়ে এহসান৷
ছবি: bdnews24.com
আহ্ আবরার!
সবশেষ ৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের নৃশংসতার শিকার হল বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ৷ রাত ২টার দিকে শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা আগের দিন সন্ধ্যায় তাকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে৷ আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন, যার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১০ জন ৷
ছবি: bdnews24
১০ বছরে ২৪ হত্যা
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত ১০ বছরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে৷ যার প্রায় সবগুলোর সাথেই ছাত্রলীগ জড়িত রয়েছে৷ এর মধ্যে ১৭ টিই ঘটেছে নিজেদের অন্তর্কোন্দলে৷ সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ গত ১০ বছরে সেখানে ৮ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: bdnews24
ইচ্ছে হলেই মারধর, হামলা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচীতে ইচ্ছে হলেই হামলা চালায় ছাত্রলীগ কর্মীরা৷ কোটা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সময় মারধর করেছে সংগঠনটির নেতা কর্মীরা৷ গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের আন্দোলনেও ছাত্রলীগের হামলা এবং ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে৷ একাধিকবার তাদের হামলার শিকার হয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর৷
ছবি: bdnews24.com
13 ছবি1 | 13
আবরারের ঘটনা নিয়ে ছাত্র রাজনীতি থাকা না থাকার প্রশ্ন উঠেছে৷ আমার মনে হয়, দেশে ছাত্র রাজনীতি নেই, নেই আসলে কোনো রাজনীতিই৷ এক্ষেত্রে আইন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ করা হলে সরকারি দলই বেশি লাভবান হবে৷ ছাত্ররা কলেজ বা বিশ্বিবদ্যালয়গুলোতে রাজনীতি না করতে পারলে আন্দোলন বা সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়া এক রকম অসম্ভব৷
আওয়ামী লীগের শক্ত হাতে দেশ শাসন বা পুলিশ বা প্রশাসনকে কুক্ষিগত করার অভিযোগ মাথায় রেখেও বলা যায়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত এক দশকে নিজেদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সামর্থ্যহীনতাই প্রমাণ করে গেছে শুধু৷ কারণ, সরকারের চরম প্রতিরোধ সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন সফল হয়েছে৷
এখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধ বা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলে কয়েকদিন আগে নতুন কমিটি করে বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদলে যে প্রাণ সঞ্চার হয়েছিল তা-ও মুখ থুবড়ে পড়বে, সরকারের পথ হবে আরও কাঁটাহীন৷
বুয়েটের ঘটনটা যদি পরিকল্পনাহীন আকস্মিকও হয়, একথা সত্যি, আমাদের দশদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে ভয়ের শীতলতায়৷ সুতরাং ছাত্র বা জনতা কারো পক্ষেই এখন সাধারণ প্রতিবাদ বা আন্দোলন সংগ্রাম করার চিন্তা মাথায় আনা কঠিন৷
এই ভয় থেকে মুক্তি পেতে আমাদের জানতে হবে, কেন আসলে আবরারকে মারা হয়েছিল, কার নির্দেশে৷