পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের দুটি শহরে স্কুলছাত্রীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছিল প্রদেশটির কর্তৃপক্ষ৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হওয়ায় মাত্র একদিন পরই প্রত্যাহার করতে হয়েছে সিদ্ধান্ত৷
বিজ্ঞাপন
দেশটির উত্তর-পশ্চিমের দুই বড় শহর খাইবার পাখতুনখোয়ার রাজধানী পেশোয়ার এবং হরিপুরের সব স্কুলে এ পোশাক বাধ্যতামূলক করা হয়৷ ‘অনৈতিক দুর্ঘটনা' এড়ানোকে দেখানো হয় কারণ হিসেবে৷
সোমবার জারি করা এ নির্দেশে দেশজুড়ে শুরু হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী অধিকার আরো সংকুচিত করার পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিয়ে সমালোচনায় মুখর হন নারীবাদিরা৷
প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী জিয়াউল্লাহ বাংগাশ জানানা, যৌন হয়রানি থেকে ‘নারীদের রক্ষা' এবং তাদের যাতে ‘ভালো দেখা যায়' সে কারণেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাই যাতে মেয়েরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে এবং অভিভাবকরাও নিশ্চিন্ত থাকেন৷'' অবশ্য মঙ্গলবারই এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে প্রাদেশিক সরকার৷
মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে তালিবান শাসনের তুলনা করেছেন৷ প্রদেশটি আফগানিস্তান সীমান্তে অবস্থিত৷ বেশ কয়েক বছর প্রদেশটির নিয়ন্ত্রণে ছিল পাকিস্তান তালিবান৷ সে সময় মেয়েদের অনেক স্কুল বোমা মেরে ধ্বংসও করেছিল তারা৷
বোরকা-নেকাব নিষিদ্ধ যেসব দেশে
শুধু ইউরোপ নয়, বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশেও নিষিদ্ধ হয়েছে বোরকা ও নেকাব৷ কিছু কিছু দেশে নিষিদ্ধ করা নিয়ে চলছে আলাপ-আলোচনা, রয়েছে বিতর্কও৷
ছবি: CLAUDE PARIS/AP/dapd
ফ্রান্স
ফ্রান্স ইউরোপের প্রথম দেশ, যেখানে বোরকা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়৷ ফ্রান্সে ৫০ লাখ মুসলমানের বাস৷ ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল এই আইন কার্যকর হয়৷ বোরকা বা নেকাব পড়লে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনে৷
ছবি: Getty Images
বেলজিয়াম
২০১১ সালের জুলাইয়ে বেলজিয়ামেও নেকাব নিষিদ্ধ হয়৷ অর্থাৎ কোনো নারী তার পুরো মুখ কাপড়ে ঢেকে রাখতে পারবে না৷
ছবি: AP
নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে ২০১৫ সালে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়৷ বিশেষ করে জনসমক্ষে, অর্থাৎ স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদির মতো জায়গায বোরকা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷ আইনটি কার্যকর হয় ২০১৯ সালের ১ আগস্ট৷
ছবি: AP
স্পেন
পুরো স্পেনে নয়, শুধু বার্সেলোনা শহর কর্তৃপক্ষ সেখানে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্রিটেন
ব্রিটেনে প্রচুর মুসলিমের বাস, তাই সেখানে কোনো ইসলামি পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই৷ তবে স্কুলগুলোতে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়৷ ২০০৭ সালে বেশ কয়েকটি মামলার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ ঠিক করে, স্কুলে কেউ বোরকা বা নেকাব পরতে পারবে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
সুইজারল্যান্ড
২০১৩ সালে সুইজারল্যান্ডের ইটালীয় ভাষাভাষীদের এলাকা টিসিনোতে বোরকা নিষিদ্ধের ওপর ভোট হয়৷ নিষিদ্ধ করার পক্ষে পড়ে ৬৫ শতাংশ ভোট৷ এরপর ২৬টি শহরে বোরকা নিষিদ্ধ হয়৷ চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে লুগানো, লোকারনো, মাগাদিনোসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বোরকা নিষিদ্ধ হয়৷ কেউ জনসমক্ষে বোরকা পড়লে ৯ হাজার ২০০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে তাঁর৷
ছবি: imago/Geisser
ইটালি
ইটালির বেশ কয়েকটি শহরে নেকাব নিষিদ্ধ৷ উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নোভারা কর্তৃপক্ষ সেখানে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে৷ ৭০-এর দশকেই মুখ ঢেকে রাখা সব ধরনের ইসলামিক পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইটালি৷
ছবি: picture alliance/dpa/Rolf Haid
অস্ট্রিয়া
দেশটির ক্ষমতাসীন জোট সরকার প্রকাশ্য স্থানে পুরো মুখ ঢাকা নিকাব নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একমত হয়েছে৷ স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে নিকাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে একমত হয়েছে সরকারের শরিক দলগুলোও৷ এছাড়া যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁদের মাথায় স্কার্ফ, হিজাব কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতীক পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বিবেচনা করছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Roessler
জার্মানি
জার্মানির বাডেন ভুর্টেমব্যার্গ রাজ্যের স্কুলে বোরকা-নিকাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, স্কুলে বোরখা বা নিকাব পরে যাওয়া যাবে না। এমন কিছু পরা যাবে না, যা মুখ ঢেকে রাখে। আগেই শিক্ষিকাদের জন্য এই নিয়ম জারি করেছিল রাজ্যটি। জরিপে দেখা গেছে, প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জার্মানও প্রকাশ্যে বোরকাধারী মহিলাদের দেখতে নারাজ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Schuh
শাড
২০১৫ সালের জুন মাসে দুটি বোমা হামলার দুই দিন পর নারীদের মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করেছে শাড৷ বোরকা কোথাও বিক্রি করা হচ্ছে দেখলে তা সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হবে বলেও ঘোষণা দেন শাডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী৷ কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে রাখা হয়েছে কারাদণ্ডের বিধান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্যামেরুন
শাডে মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাসের মাথায় আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনও একই সিদ্ধান্ত নেয়৷ বর্তমানে দেশটির পাঁচটি প্রদেশে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে৷
ছবি: Reuters/S. Wermuth
তাজিকিস্তান
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশ তাজিকিস্তান বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করে৷ ইসলামি মুখঢাকা পোশাক পরার চেয়ে দেশটির ঐতিহ্যগত পোশাক পরায় মনোযোগী হতে নারীদের আহ্বান জানায় দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়৷ এই আইন অমান্য করলে কোনো সাজার ব্যবস্থা রাখা হয়নি, তবে শিগগিরই জরিমানা বা কারাদণ্ড চালু করা হতে পারে বলে আলোচনা চলছে দেশটিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Arshad Arbab
মরক্কো
আফ্রিকার ৯৯ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বীর দেশ মরক্কোতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বোরকার উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়৷ তবে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি দেশটির সরকার৷ বোরকা পরার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কিনা, তাও স্পষ্ট করা হয়নি৷ এর ফলে দেশটিতে এখনও এ নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/F. Senna
নাইজার
জঙ্গি গোষ্ঠী বোকো হারামের কার্যক্রম বেশি থাকায় দেশটির দিফা এলাকায় পর্দা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ দেশটির প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, প্রয়োজনে মাথা ঢাকা পোশাক হিজাবও আসতে পারে নিষেধাজ্ঞার আওতায়৷
ছবি: Getty Images/AFP
শ্রীলঙ্কা
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল খ্রিস্টানদের ইস্টার সানডের প্রার্থনা চলাকালে গির্জায় আত্মঘাতি বোমা হামলায় নিহত হন অন্তত ২৫৩ জন৷ এর এক সপ্তাহ পরেই মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করে দেশটির সরকার৷
ছবি: AP
তিউনিসিয়া
২০১৯ সালের ৫ জুন গণজমায়েতের স্থান, গণপরিবহন ও সরকারি অফিস-আদালতে নিকাব নিষিদ্ধ করে তিউনিসিয়া সরকার৷ জঙ্গি আক্রমণ মোকাবেলাই এর প্রধান কারণ বলে জানায় আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান দেশটির সরকার৷
ছবি: Taieb Kadri
16 ছবি1 | 16
শান্তিতে নোবেলজয়ী স্কুলছাত্রী মালালা ইউসুফজায়িকে এই প্রদেশেই গুলি চালিয়ে আহত করে তালিবান জঙ্গিরা৷ এখন অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দলই রয়েছে প্রদেশটির শাসনে৷
মানবাধিকার কর্মী তৈমুর কামাল এমন নির্দেশ প্রত্যাহারে সন্তোষ জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এমন নির্যাতনমূলক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে আমি খুশি হয়েছি৷ শিশুদের জোর করে হিজাব পরালো হলে সেটা খুব ভয়ানক হতো৷'' নারী অধিকারকর্মী তাহিরা আবদুল্লাহ বলেন, ‘‘এর ফলে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি মোটেও উজ্জ্বল হলো না৷ বাকি বিশ্ব যখন শিশুদের শিক্ষার অধিকার রক্ষায় দ্রুত এগিয়ে চলেছে, পাকিস্তান চলছে উল্টো পথে৷''
তবে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হলেও এ নিয়ে বিতর্ক এখনই থামছে না৷ প্রাদেশিক সরকারের আইনপ্রণেতা সিরাজউদ্দিন খান জানিয়েছেন, তার দল জামায়াত-ই-ইসলামি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে এবং ‘পুরো প্রদেশ জুড়ে এই নির্দেশ চালু করার জন্য সরকারকে বাধ্য করবে৷'
পাকিস্তানে এমন বিতর্ক নতুন নয়৷ কদিন আগেই দেশটির নৌবাহিনী পরিচালিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস ও ক্লাসরুমে ছেলে ও মেয়েদের আলাদা বসার ও চলাফেরার নির্দেশ জারি করা হয়৷ এ নিয়েও চলছে ব্যাপক সমালোচনা৷