1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছাত্র আন্দোলনে প্রাণহানির বিচার হবে কীভাবে?

১৭ আগস্ট ২০২৪

বাংলাদেশে সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ, সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকশত মানুষ৷ নিহতদের মধ্যে অনেক শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক রয়েছেন৷ এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার কীভাবে হবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা৷

নিহতদের ছবি নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিল
জাতিসংঘের হিসাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে দেশজুড়ে নিহতের সংখ্যা ছয়শ'র বেশি৷ছবি: DW

বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ চলাকালে ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বিইউপির এমবিএর শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ৷ তার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে ধারণকৃত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানির বোতল বিতরণ করছেন৷

মুগ্ধর সেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়৷ তার বলা ‘‘পানি লাগবে কারো, পানি?'' দিয়ে বিভিন্ন দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে৷ সেদিনের কথা স্মরণ করে মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ভাই, বা আমাদের পরিবারের সদস্যরা ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ আমাদের বাবা আমাদেরকে সেভাবেই বড় করেছেন৷ শুধু এই আন্দোলন না, এর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, তারপর বন্যার সময় ত্রাণ বিতরণ - এগুলোতেও ওরা ছিল৷ নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দিনেও একইরকমভাবে আমার দুই ভাই স্নিগ্ধ এবং মুগ্ধ পানি এবং বিস্কুট বিতরণ করেছিল৷ এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে যখন আগুন লাগে, সেখানে তারা উদ্ধার কাজ করতে গিয়েছিল৷ তার স্বীকৃতিস্বরুপ স্কাউটস থেকে তারা বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডসও পেয়েছিল৷''

বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বিইউপির এমবিএর শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধছবি: privat

‘‘সেই একইরকমভাবে এখানে মুগ্ধ মানুষদেরকে মানবতার খাতিরে সাহায্য করতে গিয়েছিল৷ তাদের জন্য পানি এবং বিস্কুট নিয়ে গিয়েছিল নিজের টাকা দিয়েই৷ সেখানে গিয়ে তাদেরকে পানি এবং বিস্কুট দিয়ে সহায়তা করছিল৷ এর মধ্যে সে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল,'' যোগ করেন তিনি৷

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের একজন মুগ্ধ৷ আরেক শিক্ষার্থী গোলাম নাফিজ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে চার আগস্ট নিহত হন৷ সেদিন দিবাগত রাত ১২টার পর একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় তার ছবি প্রকাশিত হয়, যেখানে দেখা যায় যে, গুলিবিদ্ধ নাফিজ রিকশার পাদানিতে ঝুলছেন৷

নাফিজের বাবা গোলাম রহমান সেই ছবি দেখে তার সন্তানকে শনাক্ত করে মরদেহ সংগ্রহে হাসপাতালে গিয়েছিলেন৷ সেদিনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে রহমান বলেন, ‘‘চার আগস্ট সকাল এগারোটার দিকে আমার ছেলে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে রওয়ান দিয়েছিল৷ শুরুতে সে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত গেছে৷ শাহবাগ মোড় থেকে ব্যাক করে আবার ফার্মগেটে এসেছে৷ পরে তিনটার সময় ওর মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছে৷ তখন সে বলেছিল যে, আম্মু আমি আন্দোলনে এসেছি৷ তোমাদের কী অবস্থা? তখন তার মা বলেন যে, বাবা, ভালো আছি৷ তার মা তাকে বাসায় চলে আসতে বলেন৷ সে-ও আসবে জানায়৷''

কিন্তু তারপর আর ছেলের কোনো খোঁজ পাননি গোলাম রহমান৷ দিন গড়িয়ে রাত অবধি বিভিন্ন থানায় ঘুরেছেন তিনি৷ রহমান বলেন, ‘‘রাত বারোটার দিকে আমার আরেক ছেলে মানবজমিনে প্রকাশিত একটি ছবি দেখতে পায়৷ সেই ছবি দেখে নিশ্চিত হই যে, আমার ছেলে আর জীবিত নেই, মারা গেছে৷''

শিক্ষার্থী গোলাম নাফিজ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে চার আগস্ট নিহত হনছবি: Privat

‘‘রাত সাড়ে তিনটার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখি আমার ছেলের লাশ সেখানে আছে৷ মাথার মধ্যে একটা পতাকা বাঁধা৷ সেদিন সকালে সে আমাকে বলেছিল আব্বু আমাকে বিশটা টাকা দেও৷ তখন আমার কাছে ১৩০ টাকা ছিল৷ আমি বলেছিলাম একশো টাকা নেও৷ সে বলেছে না, ত্রিশ টাকা দেও৷ ত্রিশ টাকা দিছি৷ সেই ত্রিশ টাকা দিয়ে সে একটা পতাকা কিনে মাথার মধ্যে বেঁধে রেখেছিল,'' যোগ করেন তিনি৷ 

রহমান বলেন, ‘‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে, যেভাবে ওর শরীরে আঘাত করেছে, নাকে, মুখে, মাথায়, পায়ে৷ মনে করেন, এমন অবস্থায় আঘাত করেছে, আঘাতের পর আঘাত, আঘাতের পর আঘাত৷ এত আঘাত করেছে বলাবাহুল্য৷ একটা ছেলেকে একটা বাড়ি দিলেই যথেষ্ট৷ ওরা তো নিষ্পাপ৷ ১৬ বছরের ছেলে৷'' 

তিনি আরো বলেন, ‘‘তাকে এমনভাবে মারধর করেছে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার, খুব খারাপ অবস্থা৷ এরপর আবার বুকের মধ্যে গুলি করেছে৷ গুলিটা শরীর ছেদ করে বেরিয়ে যায়৷ খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করা হয়েছিল বলে একজন ডক্টর জানিয়েছেন৷''

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও এর বিচার করা সম্ভব: আইনজীবী মিতি সানজানা

This browser does not support the audio element.

কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাত, সংঘর্ষে কত মৃত্যু ঘটেছে?

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নানা পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণের একাধিক ভিডিও যাচাই করে সত্যতা নিশ্চিত করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷ বিভিন্ন থানাতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে৷

এসব সংঘর্ষ, সহিংসতা চলাকালে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে সেই হিসেব সরকারের তরফ থেকে এখনো জানানো হয়নি৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার প্রথম আলো নিজস্ব পন্থায় একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে সেটি আলাদাভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি৷

প্রথম আলোর হিসেবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম প্রাণহানি হয় ১৬ জুলাই রংপুরে৷ সেখানে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে জানিয়েছে৷

বাংলাদেশের জনপ্রিয় পত্রিকাটির হিসেবে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট সময়ের মধ্যে অন্তত ২১৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন, ৪ থেকে ৬ আগস্ট অবধি প্রাণহানির সংখ্যা ৩২৬ জন এবং ৭ আগস্ট থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৭ জন৷ অর্থাৎ, কোটা সংস্কার আন্দোলন, যা পরবর্তীতে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়, সেই আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ, সংঘাতে প্রাণ গেছে অন্তত ৫৮০ জনের৷ জাতিসংঘের হিসেবে অবশ্য সংখ্যাটি ছয়শ'র বেশি৷

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি নির্দেশদাতা: মোহাম্মদ নাফিজের বাবা গোলাম রহমান

This browser does not support the audio element.

এই আন্দোলন দমনে পুলিশ, র‍্যাব ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)-র বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে বলেও লিখেছে প্রথম আলো৷ আর নিহতদের একটি বড় অংশই শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক৷ তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকও রয়েছেন৷ কিছু মানুষের পরিচয় এখনো জানা যায়নি

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা, তদন্তে জাতিসংঘ

গণআন্দোলনের মুখে পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার পর তিনি এবং আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী হত্যার দায়ে একাধিক মামলা হয়েছে৷ শীঘ্রই আরো মামলা হতে পারে বলে জানা গেছে৷

মোহাম্মদ নাফিজের মৃত্যু নিয়ে শীঘ্রই হত্যা মামলা দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছেন তার বাবা গোলাম রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘যারা নির্দেশদাতা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশদাতা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশদাতা, পুলিশের আইজিপি নির্দেশদাতা, তাদেরকে আমি বিচারের আওতায় আনার জন্য বলবো৷ পুলিশ বাহিনী তাদের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছে গুলি করার জন্য ছাত্রদেরকে৷''

আইনজীবী মিতি সানজানা মনে করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া প্রাণহানির বিচার প্রচলিত আইনেই করার সুযোগ আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও এর বিচার করা সম্ভব৷ পাশাপাশি বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও করার সুযোগ আছে৷ সেই সাথে সাথে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আছে৷ বাংলাদেশের আদালত যদি মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়, সেক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল রয়েছে৷''

মুগ্ধ মানুষদেরকে মানবতার খাতিরে সাহায্য করতে গিয়েছিল: মুগ্ধর ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত

This browser does not support the audio element.

তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনায় যারা আদেশ দিয়েছেন, সহযোগী যারা ছিলেন এবং যারা সেগুলো বাস্তবায়ন করেছেন, সকলকেই কিন্তু বিচারের মুখোমুখি করার সুযোগ আইনের মধ্যে রয়েছে৷''

এদিকে, বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনে প্রাণহানি নিয়ে জাতিসংঘ শুক্রবার এক প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্দোলন মোকাবিলা করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহার করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী৷ এই নৃশংসতার তদন্তে একটি তথ্য অনুসন্ধান দলকে আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ৷

মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন নতুন সরকারের অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলছে৷ সে ব্যাপারে আমাকে জানানো হয়েছে৷ এবং যেটা জানি যে, জাতিসংঘ থেকেও টিম আসার কথা এ ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য৷ আমরা সেটার জন্য অপেক্ষা করছি৷ সেভাবে হলে আমার মনে হয় বিচার ঠিকঠাকভাবে হবে৷''

একের পর এক হত্যা মামলার মুখোমুখি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘‘স্বজনহারা বেদনা নিয়ে আমার মতো যারা বেঁচে আছেন, তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাই৷ আমি এই হত্যাকাণ্ড ও নাশকতার সাথে  জড়িতদের যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছি৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ