1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাবাংলাদেশ

ছাত্র-বিক্ষোভ দমনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে: জাতিসংঘ

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বুধবার এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ
অভ্যুত্থান দমনে সহিংসতা গোপন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নানা চেষ্টার তথ্যও পেয়েছে জাতিসংঘছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক সরকার, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস সংগঠনগুলো গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত ছিল৷

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে একটি দল পাঠিয়েছিল যার মধ্যে মানবাধিকার অনুসন্ধানকারী, একজন ফরেনসিক চিকিৎসক ও একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ছিলেন৷

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য এবং অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে একটি সরকারি নীতি উঠে এসেছে, যা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের এবং সমর্থকদের আক্রমণ ও সহিংসভাবে দমন করার নির্দেশ দেয়, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো উদ্বেগ উত্থাপনকারী এবং জরুরিভাবে আরও ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷

বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে, প্রতিবেদনে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে, এবং এসময় হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন, এবং এদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীগুলোর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন৷ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু৷ বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে যে তাদের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন৷

বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনকারী উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত থেকে, কিন্তু এর পেছনে ছিল ধ্বংসাত্মক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি এবং প্রশাসন থেকে সৃষ্ট ব্যাপক ক্ষোভ, যা অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি করেছিল৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষমতায় থাকার জন্য সাবেক সরকার ক্রমাগত  সহিংস পন্থা ব্যবহার করে এই বিক্ষোভগুলো দমনে পদ্ধতিগতভাবে চেষ্টা করেছিল৷

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার তুর্ক বলেছেন, ‘‘এই নৃশংস প্রতিক্রিয়া ছিল সাবেক সরকারের একটি পরিকল্পিত এবং সমন্বিত কৌশল, যা জনতার বিরোধিতার মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল৷ বিক্ষোভ দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাপক নির্বিচারে গ্রেফতার, আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাসের যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে৷''

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা যে সাক্ষ্য এবং প্রমাণ সংগ্রহ করেছি তা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর এবং যা আন্তর্জাতিক অপরাধও গঠন করতে পারে৷ জাতির কল্যাণ এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য দায়বদ্ধতা এবং ন্যায়বিচার অপরিহার্য৷''

অন্তর্বর্তী সরকার তদন্তের সাথে ব্যাপক সহযোগিতা প্রদর্শন করেছে, বিভিন্ন জায়গায় প্রবেশাধিকারের অনুমতি দিয়েছে এবং যথেষ্ট নথিপত্র সরবরাহ করেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে৷

প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, যারা সরাসরি বিক্ষোভ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা একাধিক বড় আকারের অভিযানের নির্দেশনা দেন ও তদারকি করেন, যেখানে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছিল বা নির্বিচারে গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছিল৷

এতে দেখা গেছে যে নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এবং অবৈধভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করার সাথে জড়িত ছিল, এর মধ্যে এমন ঘটনাও ছিল যেখানে ব্যক্তিদের খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল৷

প্রতিবেদনে, অন্যদের মধ্যে, আবু সাঈদের ঘটনাটি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে৷ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের সময় পুলিশকে উদ্দেশ্য করে দু'বাহু ছড়িয়ে ‘আমাকে গুলি করুন' বলে চিৎকার করার সময়ের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল৷ ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র এবং ভূ-অবস্থান প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তদন্তকারীরা তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল, তা সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য পুনঃনির্মাণ করেন৷ একটি ফরেনসিক বিশ্লেষণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, প্রায় ১৪ মিটার দূরত্ব থেকে শটগান দিয়ে কমপক্ষে দুবার তাকে গুলি করা হয়েছে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, আবু সাঈদ, পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে৷

প্রথম দিকের বিক্ষোভের সম্মুখসারীতে থাকার কারণে, নারীরা ও সহ নেতৃত্ব প্রদানকারীরা, নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার এবং নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের আক্রমণের শিকার হন৷ প্রতিবেদনে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার বিষয়টি নথিভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে শারীরিক আক্রমণ এবং ধর্ষণের হুমকি রয়েছে, এর লক্ষ্য ছিল নারীদের বিক্ষোভে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা৷

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, যে পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের হত্যা ও পঙ্গু করেছে, এবং তাদেরকে নির্বিচারে গ্রেফতার, অমানবিক অবস্থায় আটক এবং অত্যাচার করেছে৷ নথিভুক্ত মৃত্যুর ঘটনাগুলোর একটি এমন ছিল, যেখানে ধানমন্ডিতে একজন ১২ বছর বয়সি শিশু বিক্ষোভকারী প্রায় ২০০টি গুলি ছোঁড়ার কারণে রক্তক্ষরণে মারা যায়৷ এছাড়া, নিহতদের মধ্যে ছিল খুব ছোট শিশু যাদেরকে তাদের বাবা-মা বিক্ষোভে নিয়ে গিয়েছিলেন অথবা যারা পথচারী হিসেবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন৷ নারায়ণগঞ্জে এমন একটি ঘটনা রয়েছে, যেখানে একজন ছয় বছর বয়সি মেয়েকে তার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে একটি বিক্ষোভের সহিংস সংঘর্ষ দেখার সময় মাথায় গুলি করা হয়েছিল৷

৫ আগস্ট – বিক্ষোভের শেষ এবং সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিনের একটিতে – আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সি একটি ছেলে জানায়, পুলিশ ‘সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি করছিল'৷ সে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিল বলে জানিয়েছে৷

প্রতিবেদনটি এমন ঘটনাগুলোও নথিভুক্ত করেছে, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী আহত বিক্ষোভকারীদের জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদান প্রত্যাখ্যান বা বাধাগ্রস্ত করেছে, রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং হাসপাতালগুলো থেকে তাদের আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে, চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত কর্মীদের ভয় দেখিয়েছে এবং হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করেছে, যা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করে যে, আইনানুগত প্রক্রিয়া ছাড়া বিক্ষোভকারীদের শনাক্ত করার এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংসতার মাত্রা কোন পর্যায়ে ছিল তা গোপন করার চেষ্টা করা হচ্ছিল৷

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যখন সাবেক সরকার দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছিল তখন সংঘটিত প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড এবং আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকদের, পুলিশ এবং মিডিয়াকে লক্ষ্য করে করা অন্যান্য গুরুতর প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনাগুলোও নথিভুক্ত করেছে৷ হিন্দু, আহমাদিয়া মুসলিম এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর আদিবাসী জনগণের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে৷ যদিও বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের সাথে সম্পর্কিত প্রায় ১০০ জন গ্রেফতার হয়েছে বলে জানানো হয়েছে, তবে অনেক প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং এসব গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের পরেও অপরাধীরা এখনও দায়মুক্তি উপভোগ করছে৷

প্রতিবেদনটি কিছু বিস্তারিত পরিসরে সুপারিশ প্রদান করেছে, যেমন নিরাপত্তা ও বিচার খাতের সংস্কার, নাগরিক ও রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখার জন্য প্রণীত দমনমূলক আইন ও প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় বৃহত্তর পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা৷

হাই কমিশনার ফলকার তুর্ক বলেন, ‘‘বাংলাদেশের জন্য এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম পথ হল একটি বিস্তারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সময়ে সংঘটিত ভয়াবহ অন্যায়গুলোর সত্য উন্মোচন, নিরাময় এবং জবাবদিহিতার মুখোমুখি হওয়া, এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতার প্রতিকার করা এবং এর পুনরাবৃত্তি যাতে আর কখনও না হয় তা নিশ্চিত করা৷ আমার কার্যালয় এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় জবাবদিহিতা এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে৷

এপিবি/জেডএইচ (জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন)

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ