শিক্ষা সংক্রান্ত দাবি আদায়ে কাজ করা ছাত্র রাজনীতির একটি অন্যতম বড় উদ্দেশ্য৷ এসব করার মধ্য দিয়ে তাঁদের জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতির জন্য তৈরি হওয়ার কথা৷
বিজ্ঞাপন
কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, দাবি আদায়ে ছাত্রনেতারা আন্দোলন না করে উলটো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নানাভাবে বাধা দিচ্ছেন৷ সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি আন্দোলনের সময় তারা আন্দোলনকারী ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল মন্তব্য করেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ এই ঘটনার এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করলে সেখান থেকে মুক্তি পেতে তিনি ছাত্রলীগের সহায়তা চান বলে অভিযোগ উঠেছে৷
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ছাত্রনেতাদের ব্যবহারের এমন অভিযোগ আগেও উঠেছে৷ কয়েকদিন আগে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ফি কমানোর দাবিতে বিক্ষোভ করছিলেন৷ কিন্তু তাতে বাধা দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা৷ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদের কর্মসূচিতে বাধা দিতে কলেজের অধ্যক্ষই নাকি ছাত্রলীগের কিছু কর্মীকে ডেকে নিয়েছিলেন৷
দুর্লভ ছবিতে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস
বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ ও ৬৪ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ছাত্রসমাজের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা
এদেশের ভূখণ্ডের জন্মের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা৷ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করায় তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছবি: Journey/A. Hoque
তৎকালীন ছাত্রনেতারা
নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন থেকে শুরু করে তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন এবং ওই সময়ের অন্যসব জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ছাত্রনেতারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি করতেন৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে পরবর্তীতে তারা প্রত্যেকেই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একেকটি পিলার হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন৷ ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন৷
ছবি: Journey/R. Hoque
বঙ্গবন্ধু পথপ্রদর্শক
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী যে কোনো রাজনীতিবিদ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য পথপ্রদর্শক৷ বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকে রাজনীতি ও অধিকার সচেতন ছিলেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি৷
ছবি: Journey/M. Alam
ছয়দফা কর্মসূচি
১৯৬৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হলে ছয়দফা সমর্থন ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে৷
ছবি: Journey/A. Hoque
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালে সকল ছাত্রসংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১-দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে৷ এর ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদানে বাধ্য হয়৷ মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রদের এ প্রভাবকে স্বীকৃতি দেন৷
ছবি: Journey/R. Talukder
স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের ১ মার্চের পরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়৷ ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে৷ পরদিন তারা পল্টন ময়দানে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়৷ শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ৷
ছবি: Journey/R. Talukder
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে৷ ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্তুত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি৷ উল্লেখ্য, মুজিবনগর সরকার যথার্থভাবেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জাতীয়তাবাদী অভিধাগুলি, যেমন দেশের নাম, জয় বাংলা স্লোগান, জাতীয় পতাকা ইত্যাদিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল৷
ছবি: Journey
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অহঙ্কার করার মতো৷ গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়৷
ছবি: Journey/M. Alam
স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং ১৯৯১ সালে তাঁর পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে পুনরায় ছাত্ররা ঐক্য ও শক্তির পরিচয় দিয়েছে৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতন হয়৷ শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রযাত্রা৷
ছবি: Journey/Y. Saad
২০০২ শামসুন্নাহার হল আন্দোলন
২০০২ সালের ২২ জুলাই রাত ১টায় অর্থাৎ ২৩শে জুলাই দিবাগত রাতে শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর রাতের অন্ধকারে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলনে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ ২৩ শে জুলাই সকাল থেকে ছাত্রদল ব্যতীত ক্যাম্পাসের ক্রীয়াশীল সব ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে৷ ১ লা আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন ভিসি৷
ছবি: Journey/Z. Islam
২০০৭ সালে ছাত্র আন্দোলন
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় চার শিক্ষক ও আট শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আটক হন আট শিক্ষক, এক কর্মকর্তা৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
ছাত্র আন্দোলনের মুখে শিক্ষকদের মুক্তি
দু’দিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত কয়েকশ জন আহত হয়৷ পরে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে দণ্ড পাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে ডিসেম্বরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার৷ ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে আটক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের ছেড়ে দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
13 ছবি1 | 13
এবার একটু বড় ঘটনাগুলোর দিকে তাকাবো৷ ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে রাতের অন্ধকারে সাধারণ ছাত্রীদের উপর হামলা চালিয়েছিল পুলিশ৷ সেই ঘটনার প্রতিবাদে বড় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল৷ সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেটি শুরু করেছিলেন৷ মনে পড়ে, সেই সময় বৃষ্টিতে ভিজে রোকেয়া হলের সামনে গড়ে তোলা ‘মুক্তাঞ্চল'-এ বসে থাকার কথা৷ মনে পড়ে, আমাদের প্রতিবাদ-মিছিলে পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ আর লাঠিচার্জের কথা৷ মনে পড়ে, আন্দোলন ভণ্ডুল করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট ছাত্রদল আর ছাত্রশিবিরের হামলার কথা৷ অবশ্য কোনো কিছুই সেই আন্দোলনকে আংশিক সফল হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি৷ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী৷ তবে এখনও সেদিন রাতে ছাত্রীদের উপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিচার করা যায়নি৷ সাধারণ শিক্ষার্থীদের শুরু করা এই আন্দোলনে পরে যোগ দিয়েছিলেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা৷
এবার পাঁচ বছর পরের আরেকটি আন্দোলনের কথা৷ সময়টা ছিল ২০০৭৷ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন ক্ষমতায়৷ ঐ বছর আগস্টের ২০ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেনা সদস্যদের বিরোধ লেগেছিল৷ ঐ ঘটনার প্রেক্ষিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হলে আন্দোলন গড়ে ওঠে৷ পরবর্তীতে তা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আটককৃত শিক্ষকদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷
এখানে চারটি আন্দোলনের কথা উল্লেখ করলাম৷ এর মধ্যে শেষের দু'টি (শামসুন্নাহার ও তত্ত্বাবধায়ক আমলের আন্দোলন) ঘটনা বেশ বড়৷ দুটোই শুরু করেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা৷ বিশেষ করে, সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে এমন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিলেন, যখন বেশিরভাগ রাজনীতিবিদই ভয়ে চুপসে ছিলেন৷
আর বাকি দুই আন্দোলন ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা৷
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ পড়ার পর আপনার হয়ত মনে হতে পারে, ছাত্র রাজনীতিকে খারাপ প্রমাণ করার জন্যই আমি নির্দিষ্ট ঐ ঘটনাগুলো বেছে নিয়েছি, আর ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অতীতের কথা এড়িয়ে গেছি৷ আসলে কিন্তু তা নয়৷ আমি শুধু বলতে চেয়েছি, গত দুই দশকে ছাত্র রাজনীতির যে গতিপ্রকৃতি দেখা যাচ্ছে তাতে কিছুদিনের জন্য হলেও তা বন্ধ রাখা যেতে পারে৷ তাহলে রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা এখন প্রয়োজনে ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের ব্যবহার করছেন, তাঁরা এরকম চর্চা ছাড়াই চলাফেরা শিখে যাবেন৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছাত্র সংগঠনের দ্বারস্থ না হয়ে অন্য সমাধান বের করা শিখে যাবে৷
আর এ সব কিছু হওয়ার পর চাইলে আবারও ছাত্র রাজনীতি শুরু করা যেতে পারে৷ তখন হয়ত ছাত্র রাজনীতির একটি সুস্থ ধারা আমরা আশা করতে পারি৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷