দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে বইছে তুমুল নির্বাচনি হাওয়া। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন মহলের দৃষ্টি এখন স্বাভাবিকভাবেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের দিকে নিবদ্ধ।
বিজ্ঞাপন
যতই নির্বাচন হোক, যদি সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ না ঘটে, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির অবসান না হয়, তাহলে কোনো কিছুই টেকসই ও অর্থবহ হবে না।ছবি: DW
বেশ আশা ও আগ্রহ নিয়েই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা ।
কারণ, সকলেই জানেন, জাতীয় নেতা তৈরি হওয়ার পূর্বধাপ এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন। তরুণ নেতৃত্বের প্রাথমিক হাতে খড়ি হয় এই রাজনৈতিক অনুশীলনের মাধ্যমেই। তাছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু একটা লম্বা সময় ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত থাকায় শিক্ষাঙ্গণে এক দিকে যেমন নেতৃত্বের শুন্যতা ও স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতির নামে চলেছে এক তরফা কর্তৃত্ব, সহিংসতা, দখলদারিত্ব, দমন-পীড়ণ, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি। পাশাপাশি ব্যাহত হয়েছে একটি সুস্থ নির্বাচনের সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার সুযোগ।
শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের নেতা নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের গণতান্ত্রিক অনুশীলনও বাধাগ্রস্থ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদকে বলা হয় ‘মিনি পার্লামেন্ট'। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে এবং আবাসিক হল থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে থেকেই আবার পাঁচ জন সিনেট সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সরাসরি অংশ নিতে পারে। এই নির্বাচিত সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের সুবিধা অসুবিধা তুলে ধরার সুযোগ পায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় বিগত বছরগুলোতে সিনেটে কোন শিক্ষার্থী প্রতিনিধিই ছিল না। ফলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি ও অধিকারের বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে।
ক্যাম্পাসগুলোতে নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠনের দাপটে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এমনকি অনেকের মধ্যে ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে অনাস্থা ও বিরূপ মনোভাব দেখা গেছে।
শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থী ও বিশ্লেষকদের কথা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন নির্বাচন হয় না? বাধা কোথায়? কলেজগুলোতেও কি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত না? এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ছবি: DW
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই নিয়মিত নির্বাচন হয় না : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে সরকার-বিরোধীরাই অধিকাংশ সময় নির্বাচিত হয়। ফলে ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয়। এই কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে চায় না।
ছবি: DW
আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো : রিফাত জাহান, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সবার আগে আমি আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো, যার কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা নেই এবং কোনো রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত হবে না। প্রার্থীর কাছে আমি প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, সচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাবি করতে পারি, তবে অবশ্যই সেটা শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি চাই না : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডাকসু ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। তবে বাস্তবে এটি প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে৷ ফলে, প্রশ্ন ওঠে- ডাকসু কি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করছে, নাকি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হচ্ছে? অবশ্য ডাকসুর প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হন, তবু তারা সাধারণত নিজেদের রাজনৈতিক দলের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ থাকেন। এমন লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি চাই না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাচনে নারী প্রার্থী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই নেতৃত্বে সবার কণ্ঠস্বর সমানভাবে শোনা না গেলে গণতান্ত্রিক চর্চা পূর্ণতা পায় না। তাই নারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ খুবই সামান্য : পপি রাজবংশী, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। ছাত্র সংসদে বিভিন্ন পদে কিছু নারী শিক্ষার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করলেও তাদের অবস্থান ভালো না। আবার হল সংসদে অনেক পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। সব মিলিয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণও সন্তোষজনক নয়। রাকসুতে ‘জাতিসত্ত্বা বিষয়ক সম্পাদক’ পদের সংযুক্তিসহ চার দফা দাবি জানিয়েছিল ‘আদিবাসী’ ছাত্র সংগঠনগুলো। এ দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতদের দায়িত্ব অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা : নাঈম ইবনে জামান, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমি যাদের ভোট দিবো, তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ না হওয়ায় প্রশাসনিক ও একাডেমিক যেসব অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। যেমন, একাডেমিক সিলেবাসকে যুগোপযোগী করা, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ফান্ডিং ও স্কলারশিপের ব্যবস্থা গ্রহণ।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর অগ্রাধিকার শিক্ষার্থীদের দাবি নয়, বরং দলীয় স্বার্থই হবে - এমন আশঙ্কা বাস্তবসম্মত। যখন ছাত্র সংসদ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, তখন তারা জাতীয় স্বার্থে বড় ভূমিকা রেখেছে। দলীয় রাজনীতির অতীত ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, ছাত্র সংসদে দলীয়করণ হলে শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর হারিয়ে যাবে, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত হবে না। এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শকে হেজেমোনিক করে তুলবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতরা যেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন : সাদিয়া শরিফ শান্তা, শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। কিন্তু যদি পূর্ণ প্যানেল বা অধিকাংশ পদে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থীরাই জয়ী হন, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সৎ ও মেরুদণ্ড থাকা নেতা চাই : মামুন ইসলাম, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নেতার হতে হবে স্বচ্ছ, তার মধ্যে অবশ্যই কোনো প্রকার দ্বিচারিতা, কিংবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কাজ করার মানসিকতা থাকতে পারবে না। প্রশ্ন করা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মতো সৎ সাহস এবং ডিসিশন মেইকিংয়ের যোগ্যতা, তথা মেরুদণ্ড থাকা একান্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকা জরুরি : অর্পিতা সুশীল অপি, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নির্বাচনে অমুসলিম ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত জরুরি। এটি বৈষম্য রোধ, সবার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের নির্দিষ্ট সমস্যা ও চাহিদা তুলে ধরতে সহায়ক হবে। এ ধরনের প্রতিনিধিত্ব যতটা বেশি উঠে আসবে, শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ছাত্র সংসদ গঠনে ততবেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্যাম্পাসে শান্তি ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব : বোরহান রব্বানী, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। তবে আমরা তেমন কোনো পরিচয়ের ভিত্তিতে ভোট দেবো না। আমরা বিবেচনা করবো-কে বা কারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যারা শিক্ষার্থীদের নায্য অধিকার আদায় করতে পারবে। এছাড়া যাদের ইশতেহারে ক্যাম্পাসের শান্তি, উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- তাদেরই আমরা ভোট দেবো।
জাকসু নির্বাচনে নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম থাকার অন্যতম কারণ হলো- রাজনীতির পরিবেশকে এখনো অনেকেই নিরাপদ মনে করেন না। কেননা, গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও এর পরবর্তী সময়ে নারীদের অনলাইন বুলিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক চাপ, নিরাপত্তার অভাব এবং নেতৃত্বে নারীদের সুযোগ কম থাকায় অনেকেই এগিয়ে আসতে চান না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
12 ছবি1 | 12
অথচ নিয়মিত ভাবে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করা হলে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা এবং চিন্তাধারায় গুণগত পরিবর্তন আসতে পারতো। শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণা যেমন পেতো তেমনি তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হতো। বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু একটা ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয় বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রও বটে। একজন পরিপ‚র্ণ মানুষ হিসেবে সে যেন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে অনন্য অবদান রাখতে পারে সেভাবেই বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
আগেকার দিনে বলা হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর আর টিএসসিতে ঘুরে এলেও নাকি অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায়। এটা হয়তো শুধু কথার কথা ছিল না। কেননা তখনকার সময় শিক্ষাঙ্গণে একটা মুক্ত, উদার পরিবেশ বিরাজ করতো। পুঁথিগত শিক্ষা বা পাঠ্যক্রমের বাইরেও আরো যেসব কার্যক্রম থাকে যেমন, খেলাধ‚লা, সমাজ সেবা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ইত্যাদির চর্চা পুরো দমেই ছিল। এসব কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ দক্ষতা, টিমে কাজ করার মনোভাব, মানবিক গুণাবলী ও নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা করে। পৃথিবী জুড়েই ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়। পঞ্চাশ, ষাট তো বটেই আশি নব্বই দশকেও ডাকসুর উদ্যোগে আন্তহল বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, নাটক মঞ্চায়ন ও সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা হতো। নানা অনুষ্ঠানে টিএসসি থাকতো প্রাণবন্ত ও মুখরিত। এর মধ্যে থেকেই উঠে আসতো আগামীর সঠিক নেতৃত্ব।
এসব অনুষ্ঠান আয়োজনে ছাত্র সংসদগুলো খুব ভালো ভূমিকা রাখতো। সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম জোরদার করতে ছাত্র সংসদের কোনো বিকল্প নেই। এককভাবে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন যা করতে পারে না, ছাত্র সংসদের সহায়তায় সহজেই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের জন্য ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। কারণ, শিক্ষার্থীরা যখন নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় এবং নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করে তখন তারা একধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে, যা অনেকটা প্রশিক্ষণ অর্জনের মতোই তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং তাদেরকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগী করে তোলে।
অথচ আমরা দেখেছি দিনের পর দিন ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর মতো প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্মগুলো অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের মতো করে আধিপত্য বিস্তার করে সন্ত্রাসী কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে শিক্ষাঙ্গণগুলোতে গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার অবকাশ মেলেনি। বরং সংঘাত ও অস্থিরতা বেড়েছে। জোর জবরদস্তি, ভয় ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি কায়েম হয়েছে। প্রতি বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সবশেষ নির্বাচন হয়েছে ১৯৯০ সালে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে একবার ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। কিন্তু তারপর গত ছয় বছর আর কোন নির্বাচন হয়নি।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কিনা তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভক্ত। এই নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত।
ছবি: Abdul Goni
বাকের মজুমদার (আহ্বায়ক, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
গত বছরের ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী হল প্রশাসনের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হলে ছাত্র রাজনীতি করা যাবে না। এখানে লাভ-ক্ষতির চেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষার্থীরা কি চায়? তারা একমত যে, হলে তারা ছাত্ররাজনীতি চায় না। আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের পক্ষে, তাদের চাওয়াই আমাদের চাওয়া। আমরা হলে যেমন ওপেন রাজনীতির বিরোধিতা করছি, তেমনি গুপ্ত রাজনীতির যে কথা শুনতে পাই, সেটাও বন্ধ হওয়া উচিৎ।
ছবি: Samir Kumar De/DW
নুজিয়া হাসিন রাশা (সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিজেই একটি রাজনৈতিক প্রজেক্ট - জনগণকে রাজনৈতিকভাবে নিরস্ত্র করার, তাদের সংগঠিত প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষিত করার কৌশল। রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ মূলত গুপ্ত সংগঠন, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থগোষ্ঠী, কর্পোরেট এনজিও ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করে, যা জনগণের গণতান্ত্রিক স্পেসকে সংকীর্ণ করে। প্রতিরোধের রাজনীতি করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মেঘমল্লার বসু (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব না, হয় তা প্রকাশ্যে থাকে নয়তো তা গুপ্ত পথ নেয়। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অর্থ, প্রকাশ্য রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে গুপ্তপন্থাকে প্রণোদনা দেওয়া। এহেন পদক্ষেপ অন্তর্ঘাতের দরজা খুলে দেয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আরমানুল হক (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আমি যখন হলে অবস্থান করব, তখন তো আমার পরিচয়কে লুকাতে পারি না! হলে ছাত্র রাজনীতি সমস্যা, নাকি হলের দখলদারিত্ব সমস্যা? হলে যদি ১ম বর্ষ থেকেই প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে বৈধ সিটের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কীভাবে একটা নির্দিষ্ট দল দখল করতে পারে? আর ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হল সংসদকে প্রশ্ন করার জন্য ছাত্র রাজনৈতিক দল ছাড়া ভিন্ন কোন ফোরাম আছে কিনা, তা একটা বড় প্রশ্ন।
ছবি: Samir Kumar De/DW
আশরেফা খাতুন (মুখপাত্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, হলে নিয়োজিত হাউজ টিউটররাও ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গণরুম, গেস্টরুমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারেন নাই। হলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কমিটি দেওয়া শুরু হলে আবারও এক চিত্রের আবির্ভাব ঘটবে। আমি চাই, আবাসিক হলগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রতিনিধিত্ব করুক যাতে দখলদারিত্ব, গণরুম, গেস্টরুমের বিভীষিকা ফিরে না আসে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নাহিদুজ্জামান শিপন (সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলোর সূত্রপাত ঘটে হলগুলোর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। হলে রাজনীতি বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অগণতান্ত্রিক। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে ডাকসু নির্বাচনকে অর্থবহ করা যাবে না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
এস এম সাইফ কাদের রুবাব (মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হল রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা আদতে ডাকসুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যন্ত্রের হাতে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোন কল্যাণে আসবে না।
ছবি: Samir Kumar De/DW
জাহিদুল ইসলাম তাহসিন (শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
ক্যাম্পাসের বড় সমস্যাগুলোর একটি সিট সংকট, আর হলে রাজনীতি ফিরে এলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নেতারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের অগ্রাধিকার দিতে পারে। একই সঙ্গে হলে একক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে, কারণ ভিন্ন ভিন্ন দল নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠবে। এর ফলে হলের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে এবং পড়াশোনার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মারুফ হাসান শাহিন (শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হলে ছাত্র রাজনীতি চালু হলে আগের মতো গণরুম প্রথা ফিরে আসতে পারে, কারণ অতীতে দেখা গেছে সরকার দলের রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে বছরের পর বছর অবৈধভাবে হলে অবস্থান করত। একইভাবে পরিচয় পর্ব ও ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুম প্রথাও আবার শুরু হতে পারে। দলীয় কোন্দল বেড়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কেননা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
9 ছবি1 | 9
জুলাই গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকার পতনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে শিক্ষাঙ্গণে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলে একটা নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি পাওয়া যাবে, যারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজ করবে।
তবে মনে রাখা দরকার এই নির্বাচন মানে শুধু ভোট দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং গঠনমূলক ইতিবাচক ছাত্র রাজনীতির সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগেরই একটি অংশ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা দেখেছি কিছু ব্যতিক্রম বাদে ডাকসু থেকেই জাতীয় পর্যায়ের অনেক নেতা নেত্রী উঠে এসেছেন। শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা ও মানবিক গুণাবলীসম্বলিত নেতৃত্বের একটি চমৎকার পরম্পরা ও ধারাবাহিকতা তৈরি করতে ডাকসু সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। এতে বোঝা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সঠিক ও সৃজনশীল নেতৃত্ব গড়ে উঠলে পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতেও তার ইতিবাচক প্রতিফলন পড়তে পারে, যা হতে পারে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার পথে এক অনন্য পদক্ষেপ।
কিন্তু এক্ষেত্রে আশঙ্কার জায়গাও আছে। গুণগত রাজনৈতিক চর্চার বদলে ছাত্র সংসদ যদি দলীয় স্বার্থ রক্ষার লেজুড় বৃত্তিতে লিপ্ত হয়, তবে এই ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের আদতে কোন কাজে আসবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা কর্মীদের প্রথম পরিচয় হতে হবে শিক্ষার্থী তারপর রাজনৈতিক কর্মী। দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণ চিন্তাই হওয়া উচিত তাদের মূল লক্ষ্য। শিক্ষার্থীদের অধিকার সমুন্নত রেখে, অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করে পরমত সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতা চর্চার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে সত্যিকারের শিক্ষা ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখা ছাত্র নেতৃত্বের কাছে সকলের কাম্য।
উন্নত বিশ্বে, যেমন অ্যামেরিকা, ক্যানাডায়ও বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ আছে। ছাত্ররাই সেখানে তাদের নেতা নির্বাচন করে, কিন্তু জাতীয় রাজনীতির সাথে সেই নেতাদের সম্পৃক্ততা থাকে না। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা লেজুড়বৃত্তির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্র সংগঠনগুলো একে অন্যের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয়। এমনকি খুনোখুনি ও রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার উদাহরণও আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও সিট বরাদ্দেও অতীতে রাজনৈতিক দলীয় কোটার অপব্যবহার দেখা গেছে। সবাই চাইছে সেইসব দুর্নীতি ও অপসংস্কৃতির অবসান। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্রদের রাজনীতির গুটি হিসেবে ব্যবহার করার ন্যক্কারজনক প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
যতই নির্বাচন হোক, যদি সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ না ঘটে, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির অবসান না হয়, তাহলে কোনো কিছুই টেকসই ও অর্থবহ হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন দরকার তার সূতিকাগার হতে পারে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই। জ্ঞান ও মুক্তচিন্তা বিকাশের মাধ্যমে ছাত্র সংসদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে, রাজনীতিতে ইতিবাচক ও গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে শিক্ষার্থী ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷