ডাকসু নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। সামনে আছে এক মাসেরও কম সময়। এই সময়ে হঠাৎ করেই ‘গুপ্ত রাজনীতি' বিষয়টা বেশ আলোচনায় এসেছে।
বিজ্ঞাপন
ছাত্রদল যখন ১৮টি হলে তাদের শাখা গঠন করল, তখন ‘সাধারণ ছাত্র'—এই নাম নিয়ে প্রতিবাদ করা হলো। (প্রতীকী চিত্র)ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/picture alliance
নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে তাদের কমিটি ঘোষণা করে। সেই ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে বিপত্তি। গভীর রাতে ‘সাধারণ ছাত্র'—এই ব্যানারে বিপুলসংখ্যক ছাত্র চলে আসে উপাচার্যের কাছে। দাবি তাদের—হলে কোনো ছাত্র রাজনীতি চলবে না। এ নিয়ে বাক-বিতণ্ডা। এই সময়েই উঠে আসে ‘গুপ্ত রাজনীতি' বিষয়টা। যারা কমিটি দিয়েছে, অথবা দিতে চায়, তাদের প্রশ্ন হলে ছাত্র রাজনীতি না চললে, তাহলে কী চলবে? গুপ্ত রাজনীতি?
প্রশ্ন হচ্ছে, এই গুপ্ত রাজনীতি বিষয়টা কী? আগে শুনতাম আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের কথা। স্বাধীনতার পরপর চরম বামপন্থিদের অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স করতেন। বহুল আলোচিত সিরাজ শিকদারের দল পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনীতি ছিল এই তালিকায়। যে দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাদের যে রাজনীতি, সেটাই আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স।
ভালো-মন্দে ছাত্র রাজনীতি
গণতান্ত্রিক সব আন্দোলন, বাংলাদেশ সৃষ্টি, একটি স্বাধীন দেশের বাঁক বদলে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে৷ গৌরবের সেই ধারা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছে হালের ছাত্র সংগঠনগুলো? ছাত্র রাজনীতির ভালো-মন্দের বয়ান পড়ুন ছবিঘরে৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্ররা৷ এই আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে এমনই এক ঘটনা, দাবি পূরণের পরেও যার রেশ থেকে যায়৷ ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার দীক্ষা দেয়; যা থেকে জন্ম নেয় স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ৷
ছবি: Journey/R. Hoque
গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালে সব ছাত্রসংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করে৷ এর ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য করা হয়৷ এরপর এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়৷
ছবি: Journey/R. Talukder
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের ১ মার্চের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়৷ শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ৷ স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করার ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্র সংগঠন তথা শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছবি: Journey/R. Talukder
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চ মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে৷ ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্তুত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি৷
ছবি: Journey
স্বৈরাচার পতন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং ১৯৯১ সালে তাঁর পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে ছাত্রঐক্য ও শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের পতন হয়, শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নবযাত্রা৷
ছবি: Journey/Y. Saad
ছাত্র বিক্ষোভ
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সঙ্গে সেনা সদস্যদের সংঘর্ষ হয়৷ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষক ও আট শিক্ষার্থী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালেয়র আট শিক্ষক ও এক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে এদের মুক্তি দেয়া হয়৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
সেভেন মার্ডার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ছাত্রলীগের সাত নেতা খুন হন৷ ওই সময়কার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান এই খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে৷ বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শফিউলের মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও ’৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান তাকে বিএনপিতে যোগদানের শর্তে ক্ষমা করে দিয়ে মুক্তি দেন৷
ছবি: Fotolia/Scanrail
সস্ত্রাসে ছাত্র নেতারা
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর ক্যাম্পাসগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়তে থাকে৷ ক্ষমতা ধরে রাখতে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন স্বৈরশাসক এরশাদও৷ এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি যখন যে দলটি ক্ষমতায় ছিল ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়৷
ছবি: bdnews24
রগ কাটা শিবির
ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরের পর বছর রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল৷ ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনীতি করা এই সংগঠনটির নেতারা প্রতিপক্ষের কর্মীদের হাত-পায়ের রগ কেটে দিত, এজন্য এটিকে রগকাটা সংগঠন হিসেবে মনে করেন অনেকেই৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
ছাত্রদলে অছাত্র
বিএনিপির শাসনামলে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বার বার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়ায় ছাত্রদলের নেতারা৷ ভাতৃপ্রতীম ছাত্র শিবিরের সঙ্গেও তাদের সংঘাত-সংঘর্ষ ছিল নিয়মিত ঘটনা৷ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রদল টেন্ডারবাজি, ছাত্রী নিপীড়নসহ হাজারো অভিযোগে বিদ্ধ ছিল প্রায় সময়ই৷ অছাত্রদের এই সংগঠনের নেতৃত্বে রাখা এক সময় অঘোষিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল৷
ছবি: Reuters
নিয়ন্ত্রণহীন ছাত্রলীগ
টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ৷ এই সময়ে ছাত্রলীগ সারা দেশে তাদের আধিপত্য পুরো প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে৷ প্রতিপক্ষ দূর্বল হয়ে যাওয়ায় নিজেদের মধ্যে বার বার সংঘাতে জড়িয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা৷ সাধারণ ছাত্ররাও এদের হাতে বলি হয়েছেন অনেকবার৷ সংগঠনটির নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নানা সময়ে শিরোনাম হয়েছে৷ এ বছর চাঁদাবাজীর অভিযোগে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Bdnews24.com
প্রতিবাদী বাম
এক সময় ক্ষমতা, শক্তি, প্রভাব, প্রতিপত্তি আর দাপুটে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো কালের পরিক্রমায় এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত৷ জাতীয় কোনো ইস্যুতে ভয়ে অনেকে চুপ থাকলেও এখনো বেশকিছু বাম সংগঠনের নেতাকর্মীদের অন্তত রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/M. Asad
ক্যাম্পাসে যত খুন
স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন৷ ঢাবিতে ৭৪, রাবিতে ২৯, চবিতে ১৯, জাবিতে সাত, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন৷ আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হয়েছে ২৪ জন শিক্ষার্থী৷ নিজ সংগঠনের নেতাকর্মী বা প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে এসব খুনের ঘটনা ঘটছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Asad
13 ছবি1 | 13
চলছে নিষিদ্ধ দলের তৎপরতা
বর্তমান সময়ে হিজবুত তাহরিরকে এই তালিকায় ফেলা যেতে পারে। তারা নিষিদ্ধ দল। কিন্তু তাদের তৎপরতা কিন্তু চলছে। প্রায়ই শহরের বিভিন্ন দেয়ালে তাদের ঢাউস ঢাউস পোস্টার দেখা যায়। এটা তারা কখন লাগায়, কে পড়ে বলতে পারব না। পোস্টারের লেখাগুলো ছোট ছোট। দূর থেকে দেখা যায়, কিন্তু পড়া যায় না। পড়তে হলে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় মাঝেমধ্যে এসব দেখেছি। কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়ার সাহস হয়নি। ভেবেছি—কেউ যদি দেখে ফেলে! যদি ভাবে এই সংগঠনের প্রতি আমার কেন এত আগ্রহ? ফলে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পড়া আর হয়নি। এটাই আন্ডারগ্রাউন্ড বা গোপন সংগঠনের বৈশিষ্ট্য। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, হাঁটতে হাঁটতে পড়া যে যায় না, এটা জেনেও এরা এমন ছোট আকৃতির লেখা সংবলিত পোস্টার লাগায় কেন? সম্ভবত তারা কেবল জানান দেয়, তাদের সংগঠনটিকে নিষিদ্ধি করা হলেও তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বোঝাতে চায় তারা বেশ ভালোভাবেই জীবিত আছে।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কিনা তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভক্ত। এই নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত।
ছবি: Abdul Goni
বাকের মজুমদার (আহ্বায়ক, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
গত বছরের ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী হল প্রশাসনের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হলে ছাত্র রাজনীতি করা যাবে না। এখানে লাভ-ক্ষতির চেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষার্থীরা কি চায়? তারা একমত যে, হলে তারা ছাত্ররাজনীতি চায় না। আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের পক্ষে, তাদের চাওয়াই আমাদের চাওয়া। আমরা হলে যেমন ওপেন রাজনীতির বিরোধিতা করছি, তেমনি গুপ্ত রাজনীতির যে কথা শুনতে পাই, সেটাও বন্ধ হওয়া উচিৎ।
ছবি: Samir Kumar De/DW
নুজিয়া হাসিন রাশা (সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিজেই একটি রাজনৈতিক প্রজেক্ট - জনগণকে রাজনৈতিকভাবে নিরস্ত্র করার, তাদের সংগঠিত প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষিত করার কৌশল। রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ মূলত গুপ্ত সংগঠন, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থগোষ্ঠী, কর্পোরেট এনজিও ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করে, যা জনগণের গণতান্ত্রিক স্পেসকে সংকীর্ণ করে। প্রতিরোধের রাজনীতি করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মেঘমল্লার বসু (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব না, হয় তা প্রকাশ্যে থাকে নয়তো তা গুপ্ত পথ নেয়। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অর্থ, প্রকাশ্য রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে গুপ্তপন্থাকে প্রণোদনা দেওয়া। এহেন পদক্ষেপ অন্তর্ঘাতের দরজা খুলে দেয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আরমানুল হক (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আমি যখন হলে অবস্থান করব, তখন তো আমার পরিচয়কে লুকাতে পারি না! হলে ছাত্র রাজনীতি সমস্যা, নাকি হলের দখলদারিত্ব সমস্যা? হলে যদি ১ম বর্ষ থেকেই প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে বৈধ সিটের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কীভাবে একটা নির্দিষ্ট দল দখল করতে পারে? আর ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হল সংসদকে প্রশ্ন করার জন্য ছাত্র রাজনৈতিক দল ছাড়া ভিন্ন কোন ফোরাম আছে কিনা, তা একটা বড় প্রশ্ন।
ছবি: Samir Kumar De/DW
আশরেফা খাতুন (মুখপাত্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, হলে নিয়োজিত হাউজ টিউটররাও ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গণরুম, গেস্টরুমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারেন নাই। হলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কমিটি দেওয়া শুরু হলে আবারও এক চিত্রের আবির্ভাব ঘটবে। আমি চাই, আবাসিক হলগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রতিনিধিত্ব করুক যাতে দখলদারিত্ব, গণরুম, গেস্টরুমের বিভীষিকা ফিরে না আসে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নাহিদুজ্জামান শিপন (সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলোর সূত্রপাত ঘটে হলগুলোর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। হলে রাজনীতি বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অগণতান্ত্রিক। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে ডাকসু নির্বাচনকে অর্থবহ করা যাবে না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
এস এম সাইফ কাদের রুবাব (মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হল রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা আদতে ডাকসুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যন্ত্রের হাতে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোন কল্যাণে আসবে না।
ছবি: Samir Kumar De/DW
জাহিদুল ইসলাম তাহসিন (শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
ক্যাম্পাসের বড় সমস্যাগুলোর একটি সিট সংকট, আর হলে রাজনীতি ফিরে এলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নেতারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের অগ্রাধিকার দিতে পারে। একই সঙ্গে হলে একক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে, কারণ ভিন্ন ভিন্ন দল নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠবে। এর ফলে হলের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে এবং পড়াশোনার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মারুফ হাসান শাহিন (শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হলে ছাত্র রাজনীতি চালু হলে আগের মতো গণরুম প্রথা ফিরে আসতে পারে, কারণ অতীতে দেখা গেছে সরকার দলের রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে বছরের পর বছর অবৈধভাবে হলে অবস্থান করত। একইভাবে পরিচয় পর্ব ও ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুম প্রথাও আবার শুরু হতে পারে। দলীয় কোন্দল বেড়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কেননা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
9 ছবি1 | 9
ছদ্মবেশী শিবিরের রাজনীতি
এখানেই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গে গুপ্ত রাজনীতির পার্থক্য। গুপ্ততে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে, কিন্তু সেটা চলবে অন্য পরিচয়ে। হাসিনার শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলের তেমন কোন অবস্থানই ছিল না। অন্য কোনো দল করলে হল থেকে বিতাড়িত হতে হতো। আর জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতি করার তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীরা তো ছিলই, এমনকি তাদের রীতিমতো কমিটি পর্যন্ত ছিল। কীভাবে থেকেছে এরা? এদের অনেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে মিশে ছিল। ছাত্রলীগের কর্মী ছিল, নেতা পর্যন্ত ছিল। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অনেক বছর ধরে একটা অভিযোগ ছিল তারা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালাতো। সেই সব অপকর্মে কি এই ছদ্মবেশী শিবিরের লোকেরা অংশ নিত না? অবশ্যই নিত। না নিলে তো তারা ছাত্রলীগেই থাকতে পারত না।
এই যে অন্য পরিচয়ে থেকে গোপনে নিজের রাজনীতিটা করে যাওয়া, এটাকেই বলা হচ্ছে গুপ্ত রাজনীতি। গুপ্ত রাজনীতির অসাধারণ একটা উদাহরণ তৈরি করেছে ছাত্রশিবির। ৫ আগস্টের পর ছাত্র শিবিরকে দেখা গেছে আন্দোলনে তাদের কত জোরালো ভূমিকা ছিল, সেটাকে ঘটা করে প্রচার করতে। সে সময়ই প্রথম জানা যায়—কীভাবে তাদের লোকজন বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে নিজেদের পরিচয় গোপন করে কাজ করেছে। এসময় একটা মোক্ষম প্রশ্ন তুলেছিলেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিব। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, হাসিনার শাসনামলে ছাত্র শিবিরের যতগুলো কমিটি ছিল, সেগুলোতে আসলে কারা কারা ছিল। নামগুলো পেলে হয়ত বোঝা যেত কোন কোন সংগঠনের পরিচয়ে গুপ্তভাবে ছিল। বলাবাহুল্য, ছাত্রশিবির সেই তালিকাটি শেষ পর্যন্ত আর প্রকাশ করেনি। আগে না হয় একটা প্রতিকূল পরিবেশ ছিল, তাই তারা গুপ্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। এখন তো আর সেই অবস্থা নেই। তাহলে এখনও কেনো তাদের পুরানো নেতৃত্বের নামগুলো প্রকাশে দ্বিধা করছে তারা?
অনেকে বলেন কেবল ছাত্র লীগেই নয়, ছাত্রদল বা অন্যান্য সংগঠনেও ছাত্র শিবিরের অনেকে ছদ্মবেশে ছিল। তারা হয়ত এখনও মূল দলে দাপটের সঙ্গে বিরাজ করছেন। সে কারণেই তারা পূর্ববর্তী কমিটিগুলোর নাম প্রকাশ করতে চান না! হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তবে বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছে। সকল সংগঠনের মধ্যে এ নিয়ে কেবল আলোচনাই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে আতঙ্ক পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গুপ্ত রাজনীতির প্রসঙ্গটি এসেছে কিছুটা অন্যভাবে। ছাত্রদল যখন ১৮টি হলে তাদের শাখা গঠন করল, তখন ‘সাধারণ ছাত্র'—এই নাম নিয়ে প্রতিবাদ করা হলো। তারা বলল, হল পর্যায়ে রাজনীতি শুরু হলে, আবার সেই গণরুম সংস্কৃতি শুরু হতে পারে। এমন আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। ছাত্রলীগ বিতাড়িত ও নিষিদ্ধ হওয়ার পর, নতুন সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুমের সেই নির্যাতন কিন্তু আর অবশিষ্ট নেই। জোর করে কাউকে মিছিলে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা নেই। আগের এবং পরের এই দুই অবস্থা যারা দেখেছে, তুলনা করেছে, তাদের মধ্যে এমন আতঙ্ক থাকতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ‘সাধারণ ছাত্র' এর ব্যানারে যারা আপত্তিটা তুলছে, তারা কি আসলেই সাধারণ ছাত্র? হলে রাজনীতি বন্ধের কথা যারা বলছেন তারা নিজেরাও কি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট নন?
অনেকেই বলছেন, এরা আসলে ছাত্র শিবিরের লোক। ছাত্র শিবিরের নতুন ছদ্মবেশ হচ্ছে ‘সাধারণ ছাত্র।' তাহলে তারা কি হলগুলোতে রাজনীতি করছে না? তাদের কি সেখানে কমিটি নেই? আসলে তারা হলগুলোতে গুপ্ত রাজনীতি করছে। বিভিন্ন সমাজকল্যাণ বা সেবামূলক সংগঠন গড়ে তুলেছে। ছাত্রদের বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে ফিলটার দিচ্ছে, ভালোমন্দের দিকে খেয়াল রাখছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে বলছে, আমরা শিবির নই সাধারণ ছাত্র। এটা শিবিরের বহুল ব্যবহৃত এবং পরীক্ষিত কার্যকর একটা পদ্ধতি। প্রয়োজন অনুযায়ী এরা কখনো অরাজনৈতিক সাধারণ ছাত্র, আবার কখনো বা শিবিরের পরীক্ষিত কর্মী।
কুয়েটে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সব রাজনৈতিক সংগঠনকে লাল কার্ড
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)-এ ছাত্রলীগ,ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়নসহ সব রাজনৈতিক দল এবং কুয়েট প্রশাসনকে লালকার্ড প্রদর্শন করা হয়েছে৷
ছবি: A.S Bishwash
দুর্বার বাংলা চত্বরে বিক্ষোভ
আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুর ১২টার দিকে কুয়েটের দুর্বার বাংলা চত্বরে তারা লাল কার্ড দেখান ও বিভিন্ন স্লোগান দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা৷
ছবি: A.S Bishwash
স্লোগানে মুখর ক্যাম্পাস
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্র রাজনীতির ঠিকানা এই কুয়েটে হবে না’, ‘নো ছাত্রদল, নো ছাত্রশিবির, নো বৈবিছাআ, অনলি ছাত্র’; 'রক্ত যখন ঝরছিল, প্রশাসন তখন কই ছিল?, ‘উই ওয়ান্ট নলেজ নো পলিটিকাল ড্যামেজ’, ‘শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরে, প্রশাসন তামাশা করে’, ‘বহিষ্কার বহিষ্কার জড়িতদের বহিষ্কার’, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’- এসব প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে স্লোগান দেন৷
ছবি: A.S Bishwash
মূল দাবি
দাবি করা হয়, মঙ্গলবারের হামলার ঘটনায় ছাত্রদলের যারা জড়িত, তাদেরকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে৷ ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে অধ্যাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে, সেটাকে পরিবর্তন করে অর্ডিন্যান্স করতে হবে, যাতে কেউ আদালতে গিয়েও ছাত্র রাজনীতি করার অধিকার ফিরে না পায়৷ পরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন কর্মসূচি পালনকারীরা৷ মিছিলটি কুয়েটের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার দুর্বার বাংলায় ফিরে শেষ হয়৷
ছবি: A.S Bishwash
প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ছয় দফা দাবি দেয়া হলেও কুয়েট প্রশাসন সেটা পূর্ণাঙ্গ রূপে মানেনি৷ এ কারণে কুয়েটের ভিসি, প্রোভিসি এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালককে বর্জন করা হয়৷ লাল কার্ড দেখানোর কর্মসূচি পালন করা শিক্ষার্থীরা বলেন, কুয়েট প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, তাই তারা নতুন প্রশাসন চান৷ তারা জানান, প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে৷
ছবি: A.S Bishwas/DW
অজ্ঞাতনামা ৪০০-৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা
মঙ্গলবারের হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন৷ বুধবার রাতে খানজাহান আলী থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়৷ কুয়েটের নিরাপত্তা পরিদর্শক মনিরুজ্জামান লিটন অজ্ঞাতনামা ৪০০-৫০০ জনকে অভিযুক্ত করে মামলাটি করেন৷
ছবি: A.S Bishwas/DW
১৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনা
১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্যাম্পাসে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে৷ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন৷এর আগে বুধবার কুয়েটের জরুরি সিন্ডিকেট সভায় ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয় সেদিন৷
ছবি: A.S Bishwas/DW
6 ছবি1 | 6
দুএকটা উদাহরণ দিই। বর্তমানে ছাত্র শিবিরের যিনি কেন্দ্রীয় সভাপতি তিনিবুয়েটের ছাত্র। অথচ আমরা সবাই জানি আবরার হত্যার পর থেকে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ছিল। তাহলে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি কোনও রাজনীতি করতেন না? অরাজনৈতিক একজন ব্যক্তিকে শিবির তাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বানিয়ে দিয়েছেন? একই কথা বলা যায় শিবিরের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কেও। তিনি এসেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, এখানেও অনেক বছর ধরে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল! অর্থাৎ, আরও অনেকের মতো এই দুইজনও অরাজনৈতিক পরিচয়ে রাজনীতি করেছেন। অর্থাৎ গুপ্ত রাজনীতি করেছেন!
মধ্যরাতে ‘সাধারণ ছাত্র'রা যখন মিছিল করে ভিসির কাছে গেলেন, নানা আলোচনার পর ভিসি জানালেন হল পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি চলবে না, গুপ্ত রাজনীতিও চলবে না। প্রথমটি বললেন ‘সাধারণ ছাত্র'দের দাবিতে, দ্বিতীয়টি ছাত্রদলের দাবির প্রেক্ষিতে। এমন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে একটা সরল প্রশ্ন কিন্তু উঠতেই পারে—যে রাজনীতি গুপ্ত, সেটাকে আপনি বন্ধ করবেন কীভাবে? কেউ তো আর স্বীকার করবে না যে, সে গুপ্ত রাজনীতি করছে।
এখানে আর একটি প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক, সেটা হচ্ছে—হলে যদি ছাত্র সংগঠনের কমিটি না থাকে, তাহলে সেখানে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন হবে কীভাবে? এই যে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে সেটা নির্দলীয়ভাবে হচ্ছে? না, এতে ছাত্রলীগ ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। যে ছাত্র ডাকসুতে ভোট দেবে সেই একই ছাত্র তো তার হল সংসদ নির্বাচনেও ভোট দেবে। তাহলে ডাকসুতে ছাত্র সংগঠনের উপস্থিতি থাকলে হলে থাকবে না কেন? এসব প্রশ্নের আসলে কোনোই জবাব নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসির কিছু কিছু কর্মকাণ্ড আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। যতদূর জানি, ছাত্রজীবনে উনি শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সে বিবেচনায় শিবিরের প্রতি ওনার এক ধরনের ভালোবাসা থাকতেই পারে। কিন্তু সেই ভালোবাসা যেন দৃষ্টিকটু পর্যায়ে উপনীত না হয়, সেদিকেও উনাকেই খেয়াল রাখতে হবে। আর একটা বিষয়, উনি যদি মনে করেন ছাত্রনেতাদের কর্মকাণ্ড হলগুলোতে শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করছে, তখন সেটাকে থামানোর দায়িত্বও তো তারই। প্রতিটা হলে প্রোভোস্ট আছেন, হাউস টিউটরগণ আছেন। এদের দায়িত্ব হলের মধ্যে ভালো-মন্দ কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখা। এখন এসব পদে যদি দলীয় শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে তাদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে পক্ষপাতিত্ব দেখা দেবেই। আওয়ামী লীগের শাসনামলে খুব প্রকটভাবে দেখা গেছে। আগামীতেও যে এটা দৃশ্যমান হবে না, সে গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারবে না। এরা যতটা না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তারচেয়েও যেন অনেক বেশি দলদাস শিক্ষক। সরকারি দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে এদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলে। সেই প্রতিযোগিতায় যারা এগিয়ে থাকেন, তারাই পান বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব পদ। ফলে যতদিন শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ না হবে, যতদিন এরা নিজস্ব মেরুদণ্ডের ওপর শক্ত হয়ে না দাঁড়াতে পারবে, ততদিন ছাত্র রাজনীতির দানবীয় রূপ প্রকাশিত হতেই থাকবে, সাধারণ ছাত্রদের ওপর নিপীড়ন চলতেই থাকবে। সেক্ষেত্রে রাজনীতি গুপ্ত নাকি উন্মুক্ত—সেটা তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হবে না। কৌশলগত কারণেই কিছু সময়ের জন্য সেটা ‘গুপ্ত' চেহারা নেবে, পরে আবার সময় বুঝে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বের হয়ে আসবে।