1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছাত্র সংসদ নির্বাচন ফিরছে, গণতন্ত্র ফিরবে কি?

শহীদুল ইসলাম
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা সব সময়েই ছিল নির্ধারক। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-প্রতিটি পর্বেই ছাত্রসমাজ ছিল সামনের কাতারে।

ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতিতে প্রার্থীরা৷ তাদের কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে ক্যাম্পাসে৷
তিন দশকের বেশি সময় পর যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়- এটি গণতন্ত্রের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারেরও পরীক্ষা। ছবি: DW

সে কারণেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল একটি ক্যাম্পাসভিত্তিক আয়োজন নয়; বরং এটি জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। বলা যায়, ছাত্র সংসদ জাতীয় রাজনীতির জন্য এক ধরনের গবেষণাগার, যেখানে নতুন নেতৃত্বের পরীক্ষিত হওয়ার সুযোগ থাকে। ছাত্র সংসদ রাজনীতি থেকে উঠে আসা অনেকের জাতীয় রাজনীতিতে সুদৃঢ় অবস্থানই এটিকে প্রমাণ করে।

ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিশেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য তিনটিকে তিন দশকেরও বেশি সময় পর আবার ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই নির্বাচন আয়োজন একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন না হওয়ায় ক্যাম্পাসগুলোতে যে নেতৃত্বশূন্যতা ও গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অভাব তৈরি হয়েছিল, তা দেশের রাজনীতির জন্যও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই নির্বাচন না হওয়া মানে নেতৃত্ব বিকাশের ধারাবাহিকতায় এক ধরনের ব্যাঘাত।

নানা কারণ দেখিয়ে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে স্থবির পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। দীর্ঘ সময়ে এই নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদবিহীন এক শূন্যতা তৈরি হয়। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের প্রভাব যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল, তখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। নানা অজুহাতে নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে। কখনো প্রশাসনিক কারণে, কখনো আইনগত কারণে, আবার কখনো সরাসরি রাজনৈতিক স্বার্থে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়ে, শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ হারায় এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে যায় সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন।

আওয়ামী লীগ আমলে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের যে চিত্র তৈরি হয়েছিল, তা ছিল একেবারেই ভয়ের। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি- এসব অভিযোগে গত দেড় দশকে ক্যাম্পাসজুড়ে কুখ্যাতি পেয়েছে ছাত্রলীগ। তাদের বাইরে অন্য কোনো সংগঠনের কার্যত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল, এখন তারাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাঠে রয়েছে।পুলিশ-প্রশাসনের প্রকাশ্য সহায়তায় ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য চলতে থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকাটা সেই স্বেচ্ছাচারী শাসনেরই অংশ ছিল, যাতে নতুন নেতৃত্ব উঠতে না পারে এবং সরকারদলীয়দের একচ্ছত্র দখল বজায় থাকে।

গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন ভিন্ন এক আঙ্গিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তবে এই নির্বাচন আয়োজন করাই সব সমস্যার সমাধান নয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত রাখা। অতীতে দেখা গেছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রভাব খাটানো, ভোটারদের বাধা দেওয়া কিংবা ভিন্নমতকে দমন করা হয়েছে। ভোট সুষ্ঠু করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনের ভূমিকাকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। প্রশাসন যদি কোনো বিশেষ দল বা সংগঠনের প্রতি পক্ষপাত দেখায়, তাহলে বহুল কাঙ্ক্ষিত এই নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়বে।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেশিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও প্রবল কৌতূহল রয়েছে। যদিও নির্বাচন নিয়ে মাঝেমধ্যে শঙ্কার মেঘ উঁকি দিচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষী, যে ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, সেই সমাজের গণতন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন করতে পারলে বাংলাদেশ তার গণতন্ত্রকে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারবে। এখন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো চাইলেই নিরপেক্ষভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে, ছাত্র সংসদগুলোও আরও বেশি কার্যকর হয়ে উঠতে পারবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বিগত ১০৪ বছরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে সাতবার। ১৯৯১ সালে দেশে নতুন করে গণতন্ত্রে ফেরার পর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত এক দফা নির্বাচনের পর গঠিত ডাকসু ও হল সংসদ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। পেছনে তাকিয়ে দেখা যায়, ৩৬ বছর আগে রাকসু, ৩৫ বছর আগে চাকসু এবং ৩৩ বছর আগে জাকসু নির্বাচন হয়েছিল। অথচ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার থাকতে এই প্ল্যাটফর্মের নির্বাচন ধারাবাহিকভাবে হওয়ার কথা ছিল।

অতীতে অনেক সময় দেখা গেছে, নির্বাচন হলেও ছাত্র সংসদ কার্যকর হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর কার্যকর সংসদ গঠন করতে হবে। এই ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে কাজ করবে। আবাসন সংকট, পরিবহন সমস্যা, গ্রন্থাগার ও গবেষণাগারের সুযোগ বাড়ানো, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে ছাত্র সংসদকে। শিক্ষার মান এবং ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে হবে ছাত্র সংসদকে। ফলে শুধু ছাত্র সংসদ গঠন করেই বসে থাকলে হবে না। নিয়মিত সভার পাশাপাশি নীতিগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে করে ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন, এটিকে যাতে কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতির শাখায় পরিণত করতে না পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি নিয়মিতভাবে হয়এবং সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিফলন ঘটে, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তরুণদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে, যারা ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে দায়িত্ব নিতে পারবেন। তবে এ জন্য প্রয়োজন সহিংসতা ও দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে নির্বাচন আয়োজন এবং নির্বাচিত সংসদকে কার্যকরভাবে পরিচালিত করার ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে, তবে ছাত্র সংসদ আবারও হয়ে উঠতে পারে জাতির নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম প্রধান ঘাঁটি।

তিন দশকের বেশি সময় পর যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়- এটি গণতন্ত্রের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারেরও পরীক্ষা। সহিংসতা, দখলদারি ও দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু নির্বাচন যদি আবারও প্রভাব ও পক্ষপাতের খেলায় ভেস্তে যায়, তবে তরুণ প্রজন্মের আস্থা আরও একবার ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন সেই সন্ধিক্ষণে একটি আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে। এ জন্য সত্যিকার অর্থেই শিক্ষার্থীদের হাতে তাদের নিজস্ব নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে হবে।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ