বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা সব সময়েই ছিল নির্ধারক। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-প্রতিটি পর্বেই ছাত্রসমাজ ছিল সামনের কাতারে।
বিজ্ঞাপন
তিন দশকের বেশি সময় পর যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়- এটি গণতন্ত্রের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারেরও পরীক্ষা। ছবি: DW
সে কারণেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল একটি ক্যাম্পাসভিত্তিক আয়োজন নয়; বরং এটি জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। বলা যায়, ছাত্র সংসদ জাতীয় রাজনীতির জন্য এক ধরনের গবেষণাগার, যেখানে নতুন নেতৃত্বের পরীক্ষিত হওয়ার সুযোগ থাকে। ছাত্র সংসদ রাজনীতি থেকে উঠে আসা অনেকের জাতীয় রাজনীতিতে সুদৃঢ় অবস্থানই এটিকে প্রমাণ করে।
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিশেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য তিনটিকে তিন দশকেরও বেশি সময় পর আবার ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই নির্বাচন আয়োজন একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন না হওয়ায় ক্যাম্পাসগুলোতে যে নেতৃত্বশূন্যতা ও গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অভাব তৈরি হয়েছিল, তা দেশের রাজনীতির জন্যও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই নির্বাচন না হওয়া মানে নেতৃত্ব বিকাশের ধারাবাহিকতায় এক ধরনের ব্যাঘাত।
নানা কারণ দেখিয়ে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে স্থবির পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। দীর্ঘ সময়ে এই নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদবিহীন এক শূন্যতা তৈরি হয়। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের প্রভাব যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল, তখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। নানা অজুহাতে নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে। কখনো প্রশাসনিক কারণে, কখনো আইনগত কারণে, আবার কখনো সরাসরি রাজনৈতিক স্বার্থে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়ে, শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ হারায় এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে যায় সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন।
শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থী ও বিশ্লেষকদের কথা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন নির্বাচন হয় না? বাধা কোথায়? কলেজগুলোতেও কি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত না? এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ছবি: DW
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই নিয়মিত নির্বাচন হয় না : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে সরকার-বিরোধীরাই অধিকাংশ সময় নির্বাচিত হয়। ফলে ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয়। এই কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে চায় না।
ছবি: DW
আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো : রিফাত জাহান, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সবার আগে আমি আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো, যার কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা নেই এবং কোনো রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত হবে না। প্রার্থীর কাছে আমি প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, সচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাবি করতে পারি, তবে অবশ্যই সেটা শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি চাই না : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডাকসু ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। তবে বাস্তবে এটি প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে৷ ফলে, প্রশ্ন ওঠে- ডাকসু কি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করছে, নাকি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হচ্ছে? অবশ্য ডাকসুর প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হন, তবু তারা সাধারণত নিজেদের রাজনৈতিক দলের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ থাকেন। এমন লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি চাই না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাচনে নারী প্রার্থী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই নেতৃত্বে সবার কণ্ঠস্বর সমানভাবে শোনা না গেলে গণতান্ত্রিক চর্চা পূর্ণতা পায় না। তাই নারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ খুবই সামান্য : পপি রাজবংশী, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। ছাত্র সংসদে বিভিন্ন পদে কিছু নারী শিক্ষার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করলেও তাদের অবস্থান ভালো না। আবার হল সংসদে অনেক পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। সব মিলিয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণও সন্তোষজনক নয়। রাকসুতে ‘জাতিসত্ত্বা বিষয়ক সম্পাদক’ পদের সংযুক্তিসহ চার দফা দাবি জানিয়েছিল ‘আদিবাসী’ ছাত্র সংগঠনগুলো। এ দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতদের দায়িত্ব অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা : নাঈম ইবনে জামান, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমি যাদের ভোট দিবো, তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ না হওয়ায় প্রশাসনিক ও একাডেমিক যেসব অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। যেমন, একাডেমিক সিলেবাসকে যুগোপযোগী করা, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ফান্ডিং ও স্কলারশিপের ব্যবস্থা গ্রহণ।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর অগ্রাধিকার শিক্ষার্থীদের দাবি নয়, বরং দলীয় স্বার্থই হবে - এমন আশঙ্কা বাস্তবসম্মত। যখন ছাত্র সংসদ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, তখন তারা জাতীয় স্বার্থে বড় ভূমিকা রেখেছে। দলীয় রাজনীতির অতীত ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, ছাত্র সংসদে দলীয়করণ হলে শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর হারিয়ে যাবে, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত হবে না। এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শকে হেজেমোনিক করে তুলবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতরা যেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন : সাদিয়া শরিফ শান্তা, শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। কিন্তু যদি পূর্ণ প্যানেল বা অধিকাংশ পদে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থীরাই জয়ী হন, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সৎ ও মেরুদণ্ড থাকা নেতা চাই : মামুন ইসলাম, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নেতার হতে হবে স্বচ্ছ, তার মধ্যে অবশ্যই কোনো প্রকার দ্বিচারিতা, কিংবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কাজ করার মানসিকতা থাকতে পারবে না। প্রশ্ন করা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মতো সৎ সাহস এবং ডিসিশন মেইকিংয়ের যোগ্যতা, তথা মেরুদণ্ড থাকা একান্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকা জরুরি : অর্পিতা সুশীল অপি, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নির্বাচনে অমুসলিম ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত জরুরি। এটি বৈষম্য রোধ, সবার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের নির্দিষ্ট সমস্যা ও চাহিদা তুলে ধরতে সহায়ক হবে। এ ধরনের প্রতিনিধিত্ব যতটা বেশি উঠে আসবে, শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ছাত্র সংসদ গঠনে ততবেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্যাম্পাসে শান্তি ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব : বোরহান রব্বানী, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। তবে আমরা তেমন কোনো পরিচয়ের ভিত্তিতে ভোট দেবো না। আমরা বিবেচনা করবো-কে বা কারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যারা শিক্ষার্থীদের নায্য অধিকার আদায় করতে পারবে। এছাড়া যাদের ইশতেহারে ক্যাম্পাসের শান্তি, উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- তাদেরই আমরা ভোট দেবো।
জাকসু নির্বাচনে নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম থাকার অন্যতম কারণ হলো- রাজনীতির পরিবেশকে এখনো অনেকেই নিরাপদ মনে করেন না। কেননা, গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও এর পরবর্তী সময়ে নারীদের অনলাইন বুলিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক চাপ, নিরাপত্তার অভাব এবং নেতৃত্বে নারীদের সুযোগ কম থাকায় অনেকেই এগিয়ে আসতে চান না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
12 ছবি1 | 12
আওয়ামী লীগ আমলে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের যে চিত্র তৈরি হয়েছিল, তা ছিল একেবারেই ভয়ের। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি- এসব অভিযোগে গত দেড় দশকে ক্যাম্পাসজুড়ে কুখ্যাতি পেয়েছে ছাত্রলীগ। তাদের বাইরে অন্য কোনো সংগঠনের কার্যত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল, এখন তারাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাঠে রয়েছে।পুলিশ-প্রশাসনের প্রকাশ্য সহায়তায় ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য চলতে থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকাটা সেই স্বেচ্ছাচারী শাসনেরই অংশ ছিল, যাতে নতুন নেতৃত্ব উঠতে না পারে এবং সরকারদলীয়দের একচ্ছত্র দখল বজায় থাকে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন ভিন্ন এক আঙ্গিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তবে এই নির্বাচন আয়োজন করাই সব সমস্যার সমাধান নয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত রাখা। অতীতে দেখা গেছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রভাব খাটানো, ভোটারদের বাধা দেওয়া কিংবা ভিন্নমতকে দমন করা হয়েছে। ভোট সুষ্ঠু করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনের ভূমিকাকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। প্রশাসন যদি কোনো বিশেষ দল বা সংগঠনের প্রতি পক্ষপাত দেখায়, তাহলে বহুল কাঙ্ক্ষিত এই নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়বে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেশিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও প্রবল কৌতূহল রয়েছে। যদিও নির্বাচন নিয়ে মাঝেমধ্যে শঙ্কার মেঘ উঁকি দিচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষী, যে ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, সেই সমাজের গণতন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন করতে পারলে বাংলাদেশ তার গণতন্ত্রকে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারবে। এখন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো চাইলেই নিরপেক্ষভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে, ছাত্র সংসদগুলোও আরও বেশি কার্যকর হয়ে উঠতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বিগত ১০৪ বছরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে সাতবার। ১৯৯১ সালে দেশে নতুন করে গণতন্ত্রে ফেরার পর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত এক দফা নির্বাচনের পর গঠিত ডাকসু ও হল সংসদ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। পেছনে তাকিয়ে দেখা যায়, ৩৬ বছর আগে রাকসু, ৩৫ বছর আগে চাকসু এবং ৩৩ বছর আগে জাকসু নির্বাচন হয়েছিল। অথচ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার থাকতে এই প্ল্যাটফর্মের নির্বাচন ধারাবাহিকভাবে হওয়ার কথা ছিল।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কিনা তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভক্ত। এই নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত।
ছবি: Abdul Goni
বাকের মজুমদার (আহ্বায়ক, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
গত বছরের ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী হল প্রশাসনের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হলে ছাত্র রাজনীতি করা যাবে না। এখানে লাভ-ক্ষতির চেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষার্থীরা কি চায়? তারা একমত যে, হলে তারা ছাত্ররাজনীতি চায় না। আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের পক্ষে, তাদের চাওয়াই আমাদের চাওয়া। আমরা হলে যেমন ওপেন রাজনীতির বিরোধিতা করছি, তেমনি গুপ্ত রাজনীতির যে কথা শুনতে পাই, সেটাও বন্ধ হওয়া উচিৎ।
ছবি: Samir Kumar De/DW
নুজিয়া হাসিন রাশা (সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিজেই একটি রাজনৈতিক প্রজেক্ট - জনগণকে রাজনৈতিকভাবে নিরস্ত্র করার, তাদের সংগঠিত প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষিত করার কৌশল। রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ মূলত গুপ্ত সংগঠন, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থগোষ্ঠী, কর্পোরেট এনজিও ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করে, যা জনগণের গণতান্ত্রিক স্পেসকে সংকীর্ণ করে। প্রতিরোধের রাজনীতি করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মেঘমল্লার বসু (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব না, হয় তা প্রকাশ্যে থাকে নয়তো তা গুপ্ত পথ নেয়। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অর্থ, প্রকাশ্য রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে গুপ্তপন্থাকে প্রণোদনা দেওয়া। এহেন পদক্ষেপ অন্তর্ঘাতের দরজা খুলে দেয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আরমানুল হক (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আমি যখন হলে অবস্থান করব, তখন তো আমার পরিচয়কে লুকাতে পারি না! হলে ছাত্র রাজনীতি সমস্যা, নাকি হলের দখলদারিত্ব সমস্যা? হলে যদি ১ম বর্ষ থেকেই প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে বৈধ সিটের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কীভাবে একটা নির্দিষ্ট দল দখল করতে পারে? আর ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হল সংসদকে প্রশ্ন করার জন্য ছাত্র রাজনৈতিক দল ছাড়া ভিন্ন কোন ফোরাম আছে কিনা, তা একটা বড় প্রশ্ন।
ছবি: Samir Kumar De/DW
আশরেফা খাতুন (মুখপাত্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, হলে নিয়োজিত হাউজ টিউটররাও ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গণরুম, গেস্টরুমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারেন নাই। হলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কমিটি দেওয়া শুরু হলে আবারও এক চিত্রের আবির্ভাব ঘটবে। আমি চাই, আবাসিক হলগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রতিনিধিত্ব করুক যাতে দখলদারিত্ব, গণরুম, গেস্টরুমের বিভীষিকা ফিরে না আসে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নাহিদুজ্জামান শিপন (সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলোর সূত্রপাত ঘটে হলগুলোর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। হলে রাজনীতি বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অগণতান্ত্রিক। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে ডাকসু নির্বাচনকে অর্থবহ করা যাবে না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
এস এম সাইফ কাদের রুবাব (মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হল রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা আদতে ডাকসুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যন্ত্রের হাতে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোন কল্যাণে আসবে না।
ছবি: Samir Kumar De/DW
জাহিদুল ইসলাম তাহসিন (শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
ক্যাম্পাসের বড় সমস্যাগুলোর একটি সিট সংকট, আর হলে রাজনীতি ফিরে এলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নেতারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের অগ্রাধিকার দিতে পারে। একই সঙ্গে হলে একক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে, কারণ ভিন্ন ভিন্ন দল নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠবে। এর ফলে হলের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে এবং পড়াশোনার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মারুফ হাসান শাহিন (শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হলে ছাত্র রাজনীতি চালু হলে আগের মতো গণরুম প্রথা ফিরে আসতে পারে, কারণ অতীতে দেখা গেছে সরকার দলের রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে বছরের পর বছর অবৈধভাবে হলে অবস্থান করত। একইভাবে পরিচয় পর্ব ও ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুম প্রথাও আবার শুরু হতে পারে। দলীয় কোন্দল বেড়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কেননা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
9 ছবি1 | 9
অতীতে অনেক সময় দেখা গেছে, নির্বাচন হলেও ছাত্র সংসদ কার্যকর হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর কার্যকর সংসদ গঠন করতে হবে। এই ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে কাজ করবে। আবাসন সংকট, পরিবহন সমস্যা, গ্রন্থাগার ও গবেষণাগারের সুযোগ বাড়ানো, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে ছাত্র সংসদকে। শিক্ষার মান এবং ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে হবে ছাত্র সংসদকে। ফলে শুধু ছাত্র সংসদ গঠন করেই বসে থাকলে হবে না। নিয়মিত সভার পাশাপাশি নীতিগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে করে ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন, এটিকে যাতে কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতির শাখায় পরিণত করতে না পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি নিয়মিতভাবে হয়এবং সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিফলন ঘটে, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তরুণদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে, যারা ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে দায়িত্ব নিতে পারবেন। তবে এ জন্য প্রয়োজন সহিংসতা ও দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে নির্বাচন আয়োজন এবং নির্বাচিত সংসদকে কার্যকরভাবে পরিচালিত করার ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে, তবে ছাত্র সংসদ আবারও হয়ে উঠতে পারে জাতির নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম প্রধান ঘাঁটি।
তিন দশকের বেশি সময় পর যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়- এটি গণতন্ত্রের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারেরও পরীক্ষা। সহিংসতা, দখলদারি ও দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু নির্বাচন যদি আবারও প্রভাব ও পক্ষপাতের খেলায় ভেস্তে যায়, তবে তরুণ প্রজন্মের আস্থা আরও একবার ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন সেই সন্ধিক্ষণে একটি আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে। এ জন্য সত্যিকার অর্থেই শিক্ষার্থীদের হাতে তাদের নিজস্ব নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে হবে।