দেখলে মনে হবে টবের গাছ, পুঁতি দিয়ে তৈরি৷ অথচ আলো ফেললে সেই গাছ থেকে যে ছায়া পড়ে, তা দেখতে হয় কিংবদন্তির ঘোড়া ‘ইউনিকর্ন'-এর মতো৷ এই হলো গ্রিক শিল্পী টেওডোসিও সেক্টিও অরেয়া-র ভাস্কর্য৷
বিজ্ঞাপন
শ্যাডো আর্ট, যাকে বলা যেতে পারে ছায়ার ভাস্কর্য বা ভাস্কর্যের ছায়া৷ যা একটি গাছ বলে মনে হচ্ছে, আলো পড়লে তা নৃত্যরতা নারীতে পরিণত হতে পারে৷ এই ছায়াময় ভাস্কর্যের স্রষ্টা হলেন টেওডোসিও সেক্টিও অরেয়া৷ ৩৬ বছর বয়সি গ্রিক শিল্পী আদতে ‘ওয়েল্ডিং', অর্থাৎ ঢালাইয়ের কাজ শিখেছিলেন৷ আজ তিনি লোহা কিংবা অন্য কোনো ধাতু দিয়ে ভাস্কর্য সৃষ্টি করেন৷ কিন্তু সেই ভাস্কর্যের পিছনে থাকে আরো একটি শিল্পকলা: তা হলো সেই ভাস্কর্যের ছায়া৷ টেওডোসিও বলেন:
‘‘ছায়া তো সর্বত্র৷ সাধারণত আমরা তাদের খেয়াল করি না৷ কিন্তু আমি ছায়ার ব্যাপারে বেশিমাত্রায় সচেতন, চারদিকে ইন্টারেস্টিং নানা ছায়া দেখি৷ কোনো বস্তুর মধ্যে কী লুকনো আছে, তা যেন দিব্যচক্ষে দেখতে পাই৷ সব কিছু যেন একটা কয়েন-এর মতো, যার দু'টো পিঠ আছে৷ ছায়াদের জগতটা একটা সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ – যা সীমাহীন এবং যার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে৷''
ভাস্কর্য দেখতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র!
সুচ এত ছোট যে হারিয়ে গেলে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ তাই ‘খড়ের গাদার মধ্যে সুচ খোঁজা’ বলতে বোঝায় পণ্ডশ্রম৷ কিন্তু সেই সুচের মাথায় যে চোখ, তার মধ্যেও যে ভাস্কর্য থাকতে পারে, ভাবা যায়? উইলার্ড উইগান কিন্তু সেই কাজটাই করেন৷
ছবি: Willard Wigan
আকার ০.০০০২ ইঞ্চি!
এক ইঞ্চির মাপ তো সবাই জানেন৷ সেটাকে ১০ হাজার ভাগ করে তার দু’ভাগ নিলে যতটুকু হয়, তার মধ্যে কি কোনো কিছু রাখা সম্ভব? যাঁরা ভাবছেন এটা অকল্পনীয় একটা ব্যাপার, তাঁদের জন্য খবর হলো, ঠিক ঐটুকু জায়গাতেই ভাস্কর্য তৈরি করেন ব্রিটিশ শিল্পী উইলার্ড উইগান! ছবিতে একটি পিনের মাথায় বিশ্বকাপের ট্রফি দেখা যাচ্ছে৷ অবশ্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে এটা দেখা সম্ভব নয়৷
ছবি: Willard Wigan
তুলনা
বা পাশে সোনালি রংয়ের যে পালতোলা জাহাজটি দেখা যাচ্ছে, সেটা ডানপাশে থাকা সুচের চোখের মধ্যে সহজেই ঢুকে যায়৷ এই ছবির মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই উইগানের কাজের মাহাত্মটা বোঝা যাচ্ছে!
ছবি: Willard Wigan
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে
ছবিতে পিনের মতো যে দুটো জিনিস দেখা যাচ্ছে সেগুলোকে ভাস্কর্য গড়ার কাজে লাগান উইগান৷ পুরো কাজটা করতে হয় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে৷ উইগান নিজেকে শিল্পীর চেয়ে ভাস্কর হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন৷
ছবি: Willard Wigan
রং-তুলি হিসেবে চোখের পাতার লোম
উইগানের কাজের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো চোখের পাতার লোম৷ এগুলোকেই রং-তুলি হিসেবে ব্যবহার করেন উইগান৷ আগে মাছির চুলকে রং-তুলি হিসেবে ব্যবহার করলেও পরে দেখতে পান যে, মানুষের চোখের লোম দিয়েও এ কাজ করা যায়৷ ছবিতে একটি কেচিকে এমনই একটি লোমের উপর দেখা যাচ্ছে৷ উইগানের ভাস্কর্য গড়ার উপকরণের মধ্যে আছে আঁশ বা তন্তু, স্বর্ণ, প্লাস্টিক ইত্যাদি৷
ছবি: Willard Wigan
সাবধানে শ্বাস নেয়া
উইগান এত ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে কাজ করেন যে, কাজের সময় তাঁকে বেশ সতর্কতার সঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে হয়৷ কেননা একটু উলটপালট হলেই নিঃশ্বাসের তোড়ে সব শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে৷
ছবি: Willard Wigan
প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা
একেকটি ভাস্কর্যের কাজ শেষ হতে দুই মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়৷ আর দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করাও উইগানের জন্য খুব একটা অস্বাভাবিক নয়৷
ছবি: Willard Wigan
যেন সিন্ডেরেলার কাহিনি
ছবিতে ‘সিন্ডেরেলা’ রূপকথার কয়েকটি চরিত্রকে দেখা যাচ্ছে৷ উইগানের জীবনটাও অনেকটা রূপকথার গল্পের মতোই৷ ছোটবেলায় ‘ডিসলেক্সিয়া’ নামক রোগের কারণে ঠিকভাবে পড়তে পারতেন না৷ ফলে স্কুলের বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতো৷ সেসময় থেকেই উইগান অতি ক্ষুদ্র ভাস্কর্য তৈরি করা শুরু করেন, যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না৷ তাঁর মনে হয়েছিল, মানুষ যদি তাঁর কাজ দেখতেই না পারে, তাহলে তাঁরা সেটা নিয়ে সমালোচনা করতে পারবে না৷
ছবি: Willard Wigan
স্বীকৃতি
উইগান তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ পর্যন্ত অনেক পুরস্কার পেয়েছেন৷ প্রিন্স চার্লস, স্যার এল্টন জন, মাইক টাইসন, ডেভিড লয়েড, সাইমন কাওয়েল সহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি উইগানের ভাস্কর্য তাঁদের সংগ্রহে রেখেছেন৷
ছবি: Willard Wigan
8 ছবি1 | 8
তিনি যে ছায়াটি চান – অর্থাৎ কল্পনা করছেন, সেটাকে এঁকে দেওয়ালে সেঁটে দেন৷ তারপর একটি ছোট বাতির আলো ফেলে তিনি ঠিক সেই ভাস্কর্যটি গড়েন, যা থেকে তাঁর পরিকল্পিত ছায়াটি সৃষ্টি হতে পারে৷ টেওডোসিও-র ভাষায়:
‘‘প্রথমেই আমি ছায়ার আকারটা কল্পনা করি৷ ছায়াটা কী হবে, তা থেকেই সব কিছুর সূচনা৷ তারপরে ভাবি, সেই ছায়াটা তৈরি করতে আমার কী কী বস্তু লাগবে৷ আমি ‘মেটাল', মানে ধাতু নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসি, কেননা ধাতুর মধ্যে অবিনশ্বর কিছু একটা রয়েছে৷ আমার উদ্দেশ্য হলো, অনন্য-অদ্বিতীয় এমন একটা কিছু সৃষ্টি করা, যা অমর হয়ে থাকবে৷''
অনুকরণ নয়, উদ্ধৃতি
ধাতব ভাস্কর্যগুলোকে স্বমহিমায় শিল্পকলা বলা চলে৷ অপরদিকে তারা অনুকরণ নয়, উদ্ধৃতি৷ যেমন পাবলো পিকাসো-র সুবিখ্যাত ‘গ্যার্নিকা' ছবির ত্রিমাত্রিক ধাতব সংস্করণ তৈরি করেছেন অরেয়া৷ স্পেনীয় চিত্রকার পিকাসো ছবিটি আঁকেন ১৯৩৭ সালে৷ টেওডোসিও-র ব্যাখ্যা শুনুন:
‘‘গ্যার্নিকা ছবিটা কালো, সাদা, ছাই রংয়ে আঁকা – আমি আলোছায়া দিয়ে যা আঁকি, তাতে যা প্রতিফলিত হয়েছে৷ আমার কাজটা হলো পাবলো পিকাসো-র প্রতি শ্রদ্ধাতর্পণ৷ আধুনিক চিত্রকলায় ইনস্টলেশন, ভিডিও, পারফর্মেন্স, কত কী দেখা যায়৷ আমার কিন্তু আগেকার দিনের ওস্তাদ আঁকিয়েদেরই ভালো লাগে, কেননা তাঁরা হাতের কাজ জানতেন৷''
টেওডোসিও সেক্টিও অরেয়া প্রেরণা পান দা ভিঞ্চি ও মিকেলঅ্যাঞ্জেলো (বানানভেদে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো), পিকাসো ও সালভাদোর দালি-র মতো শিল্পীদের কাছ থেকে৷ তাঁর নিজের শিল্পকলাও আজ বিক্রি হয় কয়েক হাজার ইউরো মূল্যে৷