অভিযোগ ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে, পুলিশ আর ল্যাঙ্কাশায়ারের স্থানীয় প্রশাসন এখন উল্টো দায়ী করছে বিবিসি এবং ব্রিটেনের অন্যান্য সংবাদমাধ্যমকেই৷ মুসলিম কিশোর ভুল বানান লিখেনি, বরং সাংবাদিকরাই নাকি ভুলভাবে খবর প্রকাশ করেছেন!
বিজ্ঞাপন
উত্তর ইংল্যান্ডের শহর ল্যাঙ্কাশায়ারের স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের এই বক্তব্য ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) সহ আরো কিছু সংবাদমাধ্যমও ছেপেছে৷
মূল ঘটনা গত ৭ ডিসেম্বরের৷ বিবিসির এক খবরে জানা যায়, ১০ বছর বয়সি এক মুসলিম শিশু স্কুলে ‘টেরেসড হাউজ' লিখতে গিয়ে ভুল করে ‘টেররিস্ট হাউজ' লিখে ফেলায় ব্যাপক পুলিশি হয়রানির মুখে পড়েছে৷ খবরে জানানো হয়, ছেলেটি আসলে বোঝাতে চেয়েছিল ও একটি ‘টেরেসড হাউজ'-এ বাস করে, কিন্তু বানান ভুল করায় স্কুল কর্তৃপক্ষ আতঙ্কিত হয়ে পুলিশে খবর দেয়, ছুটে এসে ১০ বছরের শিশুকেই ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ৷
বিষয়টি নিয়ে ব্রিটেনে খুব আলোচনা হচ্ছে৷ সংবাদমাধ্যম লুফে নিয়েছে খবরটি৷ বাংলাদেশের কিছু পত্রিকাতেও গুরুত্ব পেয়েছে ল্যাঙ্কাশায়ারের এক কিশোরের অকারণে পুলিশি হয়রানির শিকার হওয়ার খবর৷ সব জায়গাতেই সমালোচনার তীর ছোড়া হচ্ছে ল্যাঙ্কাশায়ারের পুলিশ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের দিকে৷
কিন্তু ল্যাঙ্কাশায়ারের পুলিশ কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসন এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘নিছক একটি বানান ভুলের জন্য বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে বলে যে খবর প্রকাশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অসত্য৷' বিবৃতিতে দাবি করা হয়, পুলিশ এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের এমন বিষয় নিয়ে যেভাবে কাজ করার কথা, কাজটি ঠিক সেভাবেই করা হয়েছে৷ যৌথ বিবৃতির কিছু অংশ উল্লেখ করে খবরও প্রকাশ করেছে বিবিসি৷ এবারের খবরের শিরোনাম, ‘‘ল্যাঙ্কাশায়ার ‘টেররিস্ট হাউজ' বিতর্ক ‘ভুল বানানের কারণে' নয়৷''
কিন্তু শিরোনামে ‘ভুল বানানের কারণে নয়' বলা হলেও খবরে কিন্তু তা স্বীকার বা অস্বীকার করা হয়নি৷ শুধু জানানো হয়েছে, বানান ভুলের কারণে ছেলেটিকে জেরা করার বিষয়টি বিবিসি সেই ছেলের এক বোনের কাছ থেকে জেনেছিল৷ মেয়েটি তাদের বলেছে, ‘‘এমন ঘটনা কোনো ৩০ বছর বয়সির সঙ্গেই হয়ত কল্পনা করা যায়, এই বয়সের কোনো শিশুর সঙ্গে নয়৷ এখানে শিক্ষকদের শুধু ওর বানান ভুল নিয়েই দুশ্চিন্তার কিছু থেকে থাকতে পারে, অন্য কিছু নিয়ে নয়৷ এই বাচ্চাটিকে তাঁদের এমন একটি অবস্থায় ফেলা উচিত হয়নি৷ ও এখন লিখতে ভয় পাচ্ছে, কল্পনা শক্তিকে ব্যবহার করতে ভয় পাচ্ছে৷'' নিরাপত্তার স্বার্থে শিশুটির পরিচয় গোপন রাখার প্রয়োজনের উল্লেখ করে এমন বক্তব্য দেয়া মেয়েটির নামও গোপন রেখেছে বিবিসি৷
ঘড়ির কারণে গ্রেপ্তার, তারপরই ‘হিরো’ আহমেদ
ডালাস শহরের ঘরে বসে একটি ঘড়ি বানিয়েছিল আহমেদ মোহামেদ৷ তা নিয়েই শুরু হয়ে গেল হুলুস্থুল৷ প্রথমে গ্রেপ্তার৷ তারপর গ্রেপ্তারের নিন্দা আর আহমেদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ৷ বারাক ওবামাও দাওয়াত দিয়েছে তাকে!
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo/V. Bryant
শিক্ষককে খুশি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার
সুদানি বংশোদ্ভূত আহমেদ মোহামেদ ডালাসের একটি স্কুলে পড়ে৷ ঘরে বানানো একটা ঘড়ি সেই স্কুলেই নিয়ে গিয়েছিল ১৪ বছর বয়সি কিশোর৷ লক্ষ্য ছিল শিক্ষক এবং সহপাঠিদের অবাক এবং খুশি করা৷ উল্টো ফল হয়েছে তাতে৷ এক শিক্ষক দেখে প্রশংসা করেছিলেন ঠিকই, তবে একসময় যেই না ঘড়িটির অ্যালার্ম বেজে উঠল অমনি অন্য ক্লাসের এক শিক্ষক ফোন করে দিল পুলিশে৷ তারপরই হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় আহমেদকে৷
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo/V. Bryant
প্রতিবাদের ঝড়
নিরীহ, আদুরে চেহারার আহমেদকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার একটা ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে৷ সেই ছবি দেখেই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সবাই৷ সবার এক কথা – নিজের বানানো ঘড়ি স্কুলে নিয়ে যাওয়ায় একটি ছেলে গ্রেপ্তার হবে এ কেমন কথা? এ তো ভারি অন্যায়! ছবিতে বাবার সঙ্গে আহমেদ৷
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo/B. Wade
সমর্থনের জোয়ার, ওবামার নিমন্ত্রণ
সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামাও স্কুল এবং টেক্সাস পুলিশের আচরণে প্রতিবাদ জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেননি৷ হোয়াইট হাউসে তাঁর সঙ্গে একটু সময় কাটানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন ওবামা৷ আহমেদের উদ্দেশ্যে টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘‘সুন্দর ঘড়ি, আহমেদ! তুমি কি ওটা হোয়াইট হাউসে নিয়ে আসতে চাও? বিজ্ঞান ভালোবাসো তুমি, তোমার মতো শিশুদের আমরা উৎসাহ দিতে চাই৷ ’’
ছবি: Reuters/J. Ernst
গুগল মেলায় বিশেষ আসন
উদ্ভাবনের নেশা আছে এমন কিশোর আহমেদ মোহামেদের জন্য গুগলও দারুণ এক অফার দিয়েছে৷ তারা জানিয়েছে, মিষ্টি ছেলে আহমেদের জন্য গুগল-এর বিজ্ঞান মেলায় একটি আসন ইতিমধ্য বরাদ্দ করা হয়ে গেছে৷
ছবি: www.google.de
সাকারবার্গও আহমেদের পাশে
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক সাকারবার্গও আহমেদকে কিছুক্ষণের জন্য পাশে চান৷ যখনই সময় হবে আহমেদ যেন একবার ফেসবুকের প্রধান কার্যালয়ে ঘুরে যায় – এই অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
নাসায় আমন্ত্রণ
ঘড়িসহ যখন স্কুল থেকে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় আহমেদের পরনে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা-র লোগো আঁকা টি-শার্ট৷ নাসা তাতে খুবই খুশি৷ তারাও সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছে আহমেদকে৷
ডালাসের স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগে পুলিশ আহমেদকে গ্রেপ্তার করায় হিলারি ক্লিনটনও ক্ষুব্ধ৷ আহমেদ যাতে ভবিষ্যতেও উদ্ভাবনের নেশা না ছাড়ে এমন অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি টুইটারে৷
ছবি: AP
পুলিশের বক্তব্য...
ডালাস পুলিশ বলেছে, আহমেদ মোহামেদের খারাপ কোনো ভাবনা ছিল না, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত৷ স্কুল কর্তৃপক্ষ বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এক মুসলিম কিশোরের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিয়েছে – সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকেই এমন ধারণা প্রকাশ করেছেন৷ তবে টেক্সাসের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘এখন সময়টাই এমন যে কোনো কিছুকেই হালকাভাবে দেখা খুব কঠিন৷ তাছাড়া ডিভাইসটা দেখলে কারো কারো সন্দেহ হতেই পারে৷’’
ছবি: Reuters/N. Wiechec
আহমেদ যা বললো...
ডালাস মর্নিং নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কারো প্রতি বিশেষ কোনো অভিযোগ করেনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়া ১৪ বছর বয়সি মুসলিম কিশোর৷ নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে তার খুব ভালো লাগে – এ কথা জানিয়ে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ও শুধু বলেছে, ‘‘আমি একটি ঘড়ি বানিয়েছিলাম৷ আমি ছোটখাট একটা কিছু দেখাতে চেয়েছিলাম....কিন্তু ওরা ভুল বুঝল আর তাই ওটা বোমার মতো কিছু হতে পারে ভেবে গ্রেপ্তার করা হলো৷’’
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo/V. Bryant
9 ছবি1 | 9
কিন্তু যার বক্তব্যের কারণে এমন তোলপাড়, তার নাম প্রকাশ না করায় আলোচনা-সমালোচনা আরো বেড়েছে৷ নতুন করে যোগ হয়েছে সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীলতার প্রশ্নটি৷ কেউ কেউ জানাচ্ছেন, ল্যাঙ্কাশায়ারের শিশুটিকে ওর এক চাচা প্রায়ই পেটায়৷ সে কারণেই ও লিখেছিল, ‘‘আমার চাচা যখন আমাকে মারে, তখন মনে হয় আমি সন্ত্রাসীদের বাড়িতে থাকি৷'' এই বক্তব্যও ঠিক কিনা তা এ মুহূর্তে ল্যাঙ্কাশায়ারের স্কুল কর্তুপক্ষ এবং পুলিশই বলতে পারবে৷ কিন্তু তদন্তাধীন কোনো বিষয় সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে কিছু বলতে কোনো দেশের পুলিশই বাধ্য নয় এবং তা বলা অনেক ক্ষেত্রে যথার্থ দায়ীত্বশীলতাও নয়৷ অবশ্য ওই শিশু বা ওর পরিবারের কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্য এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে সংবাদমাধ্যমও নিশ্চয়ই বিষয়টি যাচাই করে আবার খবর প্রকাশ করতে পারে৷
বিবিসি কি সব পক্ষের বক্তব্য নিয়ে পুরো বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই না করেই খবর প্রকাশ করেছিল? অনেকের সেরকমই ধারণা৷ তাই এখন যেভাবে পুলিশ ও স্কুল কর্তুপক্ষের বক্তব্য তুলে ধরে নতুন করে আগের খবরই প্রকাশ করা হচ্ছে, তার সমালোচনাতেও মুখর অনেকে৷ কেউ কেউ বলছেন, পুরো বিষয়টিতে এখনো রং চড়ানো হচ্ছে৷
সাংবাদিকদের কি সব পক্ষের বক্তব্য না জেনে খবর প্রকাশ করা উচিত? মন্তব্য জানান নীচের ঘরে৷