বুধবার পাকিস্তানে এক ছাত্র খুন করেছে শিক্ষককে৷ কারণ তিনি ছেলে মেয়ে সবাইকে নিয়েই কলেজের একটি সংবর্ধনা আয়োজন করেছিলেন৷ ঐ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷
বিজ্ঞাপন
ছুরিকাঘাতে নিহত ঐ শিক্ষকের নাম খালিদ হামিদ৷ পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের শহর ভাওয়ালপুরের একটি সরকারি কলেজের ঘটনা এটি৷ নাম সাদিক এগার্টন কলেজ৷ বার্তা সংস্থা এএফপিকে পুলিশ জানিয়েছে যে, মূলত একটি মিশ্র সংবর্ধনা আয়োজনের কারণেই ঐ ছাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে৷
‘‘নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এই সংবর্ধনা আয়োজন করেছিলেন ঐ প্রফেসর,'' এএফপিকে বলেন স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ তিনি জানান যে, বৃহস্পতিবার সংবর্ধনাটি হবার কথা ছিল৷
পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ছাত্রের কাছে মনে হয়েছে, এই সংবর্ধনা আয়োজন করে শিক্ষক ‘অশ্লীলতা' ছড়িয়েছেন!
‘‘ছেলে-মেয়ের একসঙ্গে সংবর্ধনা করা ইসলামের শিক্ষার বিরুদ্ধে এবং আমি তাঁকে সতর্ক করেছিলাম,'' পুলিশকে এমন কথা বলেছেন ঐ ছাত্র৷
প্রফেসরের পুত্র ওয়ালিদ খান ঘটনার সময় বাবার সঙ্গেই ছিলেন৷ তিনি বলেন যে, সেই খুনি ছাত্র তাঁর বাবার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন৷
‘‘যখনই আমার বাবা তাঁর অফিসে পা রাখলেন, তখনই তিনি ছুরি নিয়ে বাবাকে আঘাত করেন৷ তিনি মাথা ও পেটে আঘাত করেন,'' এএফপিকে বলেন ওয়ালিদ৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার বাবা মাটিতে পড়ে যান এবং আমি দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে যাই৷ তখন সেই ছাত্র ছুরি হাতে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি তাঁকে খুন করেছি, আর আমি বলেছিলাম যে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে সংবর্ধনা ইসলামবিরোধী'৷''
এরপর সেই ছাত্র ছুরি ফেলে দেন এবং প্রহরীরা তাকে আটক করেন৷
পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার টুইটারে জানায় যে, সেই ছাত্রকে আটক করা হয়েছে এবং মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছেন৷
পাকিস্তানে এমন নয় যে, ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে সংবর্ধনা হয় না৷ তবে বেসরকারির চেয়ে সরকারি কলেজগুলোতে মাঝে মাঝে এমন বাধার মুখে পড়তে হয়৷ সম্প্রতি পাঞ্জাবের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের বড় গলার জামা, হাতাকাটা শার্ট, টাইটস, আঁটোসাঁটো জিন্স ও ক্যাপ্রি প্যান্ট পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷ অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী জোড়ায় জোড়ায় বসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে৷ এমনকি ছেলে-মেয়ের মধ্যে ‘অনুপযুক্ত' যোগাযোগের ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷
জেডএ/ডিজি (এএফপি)
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন ও একজন আসিয়া বিবি
আসিয়া বিবি পাকিস্তানের এক খ্রিষ্টান নারী৷৷ ২০১০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের এক আদালত ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ কে এই আসিয়া, কেনই বা তাঁর এই মামলা কেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর?
ছবি: picture alliance/dpa
পানি নিয়ে বিরোধ
২০০৯ সালে পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলায় এক মাঠে কাজ করার সময় মহানবি হযরত মোহাম্মদকে অপমান করার অভিযোগ ওঠে আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে৷ মাঠে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কিছু নারী কাজ করছিলেন৷ আসিয়া বিবি পানি নিতে গেলে ‘অমুসলিম’ বলে তাঁকে পানির পাত্র ধরতে দেননি তাঁরা৷ তারপর তাঁরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আসিয়া বেগমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পর্শকাতর বিষয়
মাঠের বাকবিতণ্ডার পর আসিয়ার বাসায় কিছু ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ হামলা চালায় বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম৷ পরে পুলিশ আসিয়াকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা ব্লাসফেমির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে৷ ৯৭ শতাংশ মুসলিমের দেশ পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননাকে বেশ স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Arif Ali/AFP/Getty Images
বিতর্কিত আইন
১৯৮০ সালে সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ব্লাসফেমি আইন চালু করেন৷ অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, অনেকক্ষেত্রেই এই আইনকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হয়৷ খ্রিস্টান, হিন্দু, এমনকি ইসলামের সংখ্যালঘু গোত্র আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধেও এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়৷
ছবি: Noman Michael
রাষ্ট্র বনাম আসিয়া
২০১০ সালে এক আদালত আসিয়াকে ধর্ম অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে৷ বাদীর আইনজীবী অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ কিন্তু আদালত আসিয়ার ফাঁসির রায় দেন৷ ২০১০ সাল থেকেই আসিয়ার পরিবার ভয়ের মধ্যে বাস করছে৷ তখন থেকে আসিয়ার মুক্তির জন্য তাঁর স্বামী আশিক মাসিহ আইনি-যুদ্ধ করে চলেছেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
গুপ্তহত্যার শিকার সমালোচকরা
২০১০ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সালমান তাসির আসিয়ার পক্ষে দাঁড়ান৷ ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারেরও দাবি তুলে তিনি৷ তাঁর এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয় চরমপন্থিরা৷ ২০১১ সালে ইসলামাবাদে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তাসির৷ একই বছর ব্লাসফেমি আইনের আরেক সমালোচক তৎকালীন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন৷
ছবি: AP
হত্যাকারীকে সংবর্ধনা
তাসিরের হত্যার পর চরমপন্থি নেতা কাদরি রীতিমতো নায়কে পরিণত হন৷ তাকে কারাগারে নেয়ার সময় লাল গোলাপ ছিটিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়৷ ২০১৬ সালে কাদরিকে ফাঁসি দেয়া হয়৷ কাদরির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজার হাজার ইসলামপন্থি জড়ো হয়েছিলেন৷ এমনকি কাদরির নামে তার স্মরণে একটি মাজারও প্রতিষ্ঠা করে তার সমর্থকরা৷
ছবি: AP
বিচার বিভাগে ভীতি
ব্লাসফেমি আইনের সমালোচকদের হত্যাকাণ্ডে ভয় ঢুকেছে আইনজীবীদের মধ্যেও৷ আসিয়ার পক্ষে হাই কোর্টে লড়তে কোনো আইনজীবীই সম্মতি জানাননি৷ ২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্ট আসিয়ার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে৷ ২০১৬ সালে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলেও এক বিচারক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে তাতে অংশ নিতে রাজি হননি৷
ছবি: Reuters/F. Mahmood
আইনের খাড়া
অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পাকিস্তানে অন্তত ৪০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সেক্যুলার মুসলিমদের এই আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়৷ এখনো এই আইনের আওতায় কারো বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা না হলেও ক্ষুব্ধ জনতার হাতে মৃত্যুর উদাহরণ রয়েছে অনেক৷
ছবি: APMA
ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন
পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রায়ই আইনি ও সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগ করেন৷ গত কয়েক বছরে প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে অনেক খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে৷
ছবি: RIZWAN TABASSUM/AFP/Getty Images
ইসলামপন্থিদের হুমকি
আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায় পালটে গেলে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির’ হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, বিশেষ করে তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান- টিএলপি৷ দেশটির খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের আশংকা, বিচারকরা রায় পালটানোর সিদ্ধান্ত জানালে পুরো দেশজুড়ে তাঁদের ওপর নৃশংসতা শুরু হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. K. Bangash
আন্তর্জাতিক সমর্থন
বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠন আসিয়ার মামলার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে৷ আসিয়ার মেয়ে ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে দেখা করে এসেছেন৷২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্টের রায়কে ‘ভয়াবহ অবিচার’ আখ্যা দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিস আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের নিন্দা জানিয়েছে৷