‘ছোট’ সংঘর্ষে বড় সংঘাতের শঙ্কা, ইইউ মিশনের উদ্বেগ
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩শনিবারের ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ মঞ্চ দখলের খবরও পাওয়া গেছে৷ বিএনপি অভিযোগ করেছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে৷ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সিরাজগঞ্জে তাদের শান্তি মিছিলে বিএনপির হামলার অভিযোগ তোলা হয়েছে৷ সেখানে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুনও দেয়া হয়েছে৷
গত সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম থেকে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ শুরুর সময় থেকেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাল্টা কর্মসূচি দেয়া শুরু হয়৷ তখন থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশের দিন যানবাহন বন্ধে পরিবহণ শ্রমিক ও নেতাদের কাজে লাগানো হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়৷ আর সেটা ডিসেম্বরে ঢাকায় সমাবেশের সময় চরম আকার ধারণ করে৷ এরপর থেকে বিএনপির কোনো কর্মসূচিই আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচির বাইরে ছিল না৷ আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে৷ দলটি বলছে, বিএনপি যাতে ‘নাশকতা' করতে না পারে সেজন্য দল হিসেবে সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষায় তারা মাঠে থাকছে৷ আর বিএনপি মনে করে, তাদের কর্মসূচি পণ্ড করতে আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচির দিনই পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে৷ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সামনে তারা হরতাল অবরোধের মতো আরো কঠিন যত কর্মসূচি আছে তা দেবেন৷
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনের কথা, ‘‘দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিএনপির কর্মসূচির দিনে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিচ্ছে৷ শুধু পুলিশ প্রশাসন থাকলে ওরা যে-কোনো দিন অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে৷ সেই কারণে আমরা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বাজায় রাখতে মাঠে আছি৷ কারণ, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল৷ আর তাদের সঙ্গে জামায়াত আছে৷ তারা চায় দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে৷ এছাড়া আমাদের নেতা-কর্মীরা মাঠে থাকলে বিএনপির যারা সন্ত্রাসী, জামায়াত, তারা আতঙ্কে থাকে৷ তারা প্রেশারে থাকে৷ ফলে তারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে ভয় পায়৷”
তার দাবি, ‘‘আওয়ামী লীগ বিএনপির কর্মসূচিতে কখনো হামলা করেনি, বরং বিএনপি করেছে৷ সিরাজগঞ্জে বিএনপি হামলা করেছে৷ পুলিশ হয়ত তাদের কখনো কখনো বাধা দেয়৷ পুলিশের কাছে সে ধরনের তথ্য থাকে বলেই বাধা দেয়৷''
আওয়ামী লীগের এই নেতার পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘আমরা তো দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ চাই৷ হামলা হলে তো দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ হবে৷ আমরা কেন দেশকে অস্থিতিশীল করবো?”
এর জবাবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, রাজনীতিতে এই অশান্তির দায় আওয়ামী লীগ ও সরকারের৷ তারা সংঘাত ও সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই বিএনপির কর্মসূচির দিনে পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে৷ তারা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়৷”
তার কথা, ‘‘আওয়ামী লীগ ও সরকার একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিএনপি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে তা বাধাগ্রস্ত করতে চায়৷ বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দমন-নিপীড়ন শুরু করতে চায়৷ কিন্তু এসব করে আন্দোলন দমন করা যাবে না৷”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বিএনপিকে পাহারা দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রয়োজন নেই৷ তারা পাহারা দেয়ার নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে৷ তারা গণতন্ত্রের পাহারাদার হয়ে গণতন্ত্র খেয়ে ফেলেছে৷ তারা এখন চৌকিদারে পরিণত হয়েছে৷ ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রায় তারা বিএনপির ওপর হামলা চালিয়েছে৷ তারা পুলিশের ছত্রছায়ায় হামলা চালিয়েছে৷ বিএনপি কোনো সন্ত্রাস করে না, সন্ত্রাস করে আওয়ামী লীগ৷”
তিনি আরো বলেন, "এই পরিস্থিতি চললে অবস্থা আরো খারাপ হবে৷ আমাদের নেতারা তো বলেছেন আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচিগুলোর তারিখ ঘোষণা করুক আমরা ওইসব দিনে কর্মসূচি দেবো না৷ আওয়ামী লীগ তা করছে না কেন? এ থেকেই তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়৷”
বাড়ছে উদ্বেগ ও শঙ্কা
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জোটটির সদস্য দেশগুলোর ঢাকা মিশন৷
রোববার এক টুইট বার্তায় ঢাকায় ইইউ ডেলিগেশনের পক্ষ থেকে এই উদ্বেগের কথা জানানো হয়৷
সেখানে বলা হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাম্প্রতিক সহিংসতার খবরে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন৷ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত সব পক্ষকে তারা শান্তিপূর্ণ ও আইনানুগ পদ্ধতিতে রাজনীতি করার জন্য দৃঢ়ভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, বিএনপি আর আওয়ামী লীগের এভাবে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলতে থাকলে দেশে সংঘাতের রাজনীতি অনিবার্য৷ তার কথা, "রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে একই দিনে কর্মসূচি না দেয়া৷ বিএনপি একদিন কর্মসূচি দিলে আওয়ামী লীগের সেই দিন কর্মসূচি দেয়া ঠিক না৷ একইভাবে বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ বিএনপি তো এর আগে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের দিন কর্মসূচি পরিবর্তন করে অন্যদিন নিয়ে গিয়েছিল৷ আর যদি একই দিনে কর্মসূচি দিতেই হয়, তবে নেতাদের দায়িত্ব নিতে হবে৷ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি যে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রার কর্মসূচি পালন করেছে সেটাকে আমি ইতবাচক হিসেবে দেখি৷ কারণ, আমাদের এখানে অনেক দিন ধরে আমরা সুস্থ রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখিনি৷ এই যে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা, এটা শান্তিপূর্ণ এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড৷ তবে আশঙ্কার জায়গা হলো, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি৷ নেতারা দায়িত্বশীল না হলে এতে সংঘাত সৃষ্টি হয়৷”
তার কথা, ‘‘আগে আমরা দেখেছি, একটি দল এক দিন কর্মসূচি দিলে আরেকটি দল অন্যদিন কর্মসূচি দেয়৷ কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে সেটা নতুন৷ আগে এরকম খুব বেশি দেখা যায়নি৷’’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীও মনে করেন, " যা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে রাজনীতি অনিবার্যভাবেই সংঘাতের দিকে যাচেছ৷ আর এতে বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে৷ সেটা হলে তা হবে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক৷”
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি এখন পর্যন্ত যতগুলো কর্মসূচি পালন করেছে, সেখানে কোনো সংঘাত বা সহিংসতা হয়নি৷ এখন আওয়ামী লীগ একই দিনে পাল্টা কর্মসূচি দেয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে৷ এজন্য আমি আওয়ামী লীগকেই দায়ী করবো৷ এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সংঘাত, সংঘর্ষ তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়বে, যা অনেক বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে৷”
তিনি মনে করেন, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে গণতান্দ্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা৷”