সিনজার গণহত্যার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি ইরাকের ইয়াজিদিরা৷ ২০১৪ সালের আগস্টে ইসলামিক স্টেট জঙ্গিরা হামলা চালায় ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ওপর৷ কয়েক হাজার ইয়াজিদিকে হত্যা ও অপহরণ করা হয়৷ এখনও নিখোঁজ অনেকে৷
কয়েক মাস বন্দী থাকার পর মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনা হয়৷ কিন্তু এখনও নাসরিনের মতো প্রায় দুই লাখ ইয়াজিদি নিজের শহরে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন৷ ২৫ বছর বয়সি নাসরিন বলেন, ‘‘ছয় বছর ধরে আমরা সাহায্য চাচ্ছি, কিন্তু কেউই আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসছে না৷ দুঃখজনকভাবে কেবল মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আমাদের ভুলিয়ে রাখা হয়৷'' এখন উত্তর ইরাকের মাম রাশান শরণার্থী শিবিরে দিন কাটছে নাসরিনের৷
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষ এখন মনে করে তারা একা, সবাই তাদের ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছে৷ কিন্তু আমাদেরও অন্যদের মতো বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে৷''
ইরাকে অন্তত চার লাখ ইয়াজিদির বাস৷ ইয়াজিদিরা খ্রিস্ট ধর্ম, জরাথ্রুস্ট মতবাদ এবং ইসলামের বেশ কিছু নীতি মেনে চলেন৷ কিন্তু তাদেরকে ‘শয়তানের উপাসনাকারী' আখ্যা দিয়ে আইএস জঙ্গিরা ইয়াজিদিদের মূল আবাসস্থল মাউন্ট সিনজার অঞ্চলে হামলা চালায়৷ হাজার হাজার ইয়াজিদি সেসময় হত্যার শিকার হন, অনেককে অপহরণ করা হয়, অনেকে এখনও নিখোঁজ৷ জাতিসংঘ এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা বলে আখ্যা দিয়েছে৷
ইরাকের মোট ইয়াজিদিদের অর্ধেকেরও বেশি এখন বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন৷ অনেক ইয়াজিদি সিনজারে ফিরে গেলেও তাদের সেখানে জল, স্বাস্থ্যসেবা বা বিদ্যুৎ ছাড়াই বাস করতে হচ্ছে৷ গণহত্যার বার্ষিকীর আক আয়োজনে নোবেলজয়ী নাদিয়া মুরাদ জানান এখনও তিন হাজারেরও বেশি ইয়াজিদি নিখোঁজ রয়েছেন৷ নাদিয়া নিজেও আইএস জঙ্গিদের হাতে যৌনদাসি হিসেবে বন্দি ছিলেন৷
নাদিয়া বলেন, ‘‘শান্তি ও নিরাপত্তা চায় ইয়াজিদিরা৷ জবাবদিহিতা ও বিচার তাদের প্রাপ্য৷ বিশ্বনেতারা কবে নড়েচড়ে বসবেন, সেজন্য যারা বেঁচে এসেছেন তারা আরো চয় বছর অপেক্ষা করতে পারবেন না৷৷''
মুক্ত জীবনেও ওরা অসহায়
আইএস জঙ্গিদের অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছে তারা৷ শৈশবেই হয়েছে ধর্ষণের শিকার, বাধ্য হয়েছে বিয়ে করতেও৷নির্যাতনের মুখে যুদ্ধও করতে হয়েছে অনেক শিশুকে৷ ছবিঘরে থাকছে তাদের কথা...
ছবি: picture-alliance/Y. Akgul
হত্যাযজ্ঞ
২০১৪ সালে সিরিয়ায় অন্তত ১০হাজার ইয়াজিদিকে হত্যা করে আইএস৷ নিহতরা সবাই পুরুষ৷ ১২ বছরের বেশি বয়সি সব ছেলে শিশুকেও হত্যা করে আইএস জঙ্গিরা৷ এ পর্যন্ত অন্তত ৭০টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
নারী ও শিশু অপহরণ, নিপীড়ন, ধর্ষণ
১২ বছরের বেশি বয়সি সব পুরুষকে হত্যা করলেও সাত হাজার নারী ও শিশুকে অপহরণ করে নিপীড়ন করা হয়, ধর্ষণ করে বিক্রি করে দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/Y. Akgul
পরিবারে ফিরেছে যারা
আইএসকে যুদ্ধে হারিয়ে দুই হাজার শিশুকে উদ্ধার করে কুর্দি যোদ্ধারা৷ পরে নিজ নিজ পরিবারে ফিরিয়ে দেয়া হয় তাদের৷ তবে পরিবারে ফিরলেও আইএস শিবিরের দুঃসহ স্মৃতি তাদের ছাড়েনি৷
ছবি: Reuters/R. Said
পুরুষ মানেই আতঙ্ক
সিরিয়ার বাগুজে আইএস-কে হারানোর পর সেখান থেকে এক হাজার ৪১ জন শিশুকে উদ্ধার করে কুর্দি যোদ্ধারা৷ উদ্ধার করা শিশুদের মধ্যে এমন কিশোরীও রয়েছে যাদের ধর্ষণ, নির্যাতনের পর বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়৷ বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি তাদের মনে এখনো তাজা, এখনো পুরুষ দেখলেই ভয় পায় তারা৷ এমনকি নিজের বাবা বা ভাইকে দেখলেও আঁতকে ওঠে তারা৷
ছবি: DW/F. Campana
প্রাণ বাঁচাতে যোদ্ধা
ছেলে শিশুদের গল্পটা অন্যরকম৷ বয়স ১২ বছরের চেয়ে কম ছিল বলে আইএস তাদের হত্যা করেনি৷ তবে পরে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করেছে৷ অ্যামনেস্টিকে সাহির নামের এক শিশু জানিয়েছে, যুদ্ধ করতে রাজি না হওয়ায় আইএস যোদ্ধারা কয়েকদিন খেতে দেয়নি, প্রতিদিন প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে পিটিয়েছে৷ ক্ষুধা আর নির্যাতন সইতে না পেরে একসময় যুদ্ধ করতে রাজি হয়ে যায় সাহির৷
ছবি: DW/D. Cupolo
ওদের সাহায্য দরকার
আইএস শিবির থেকে উদ্ধার করা শিশুদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ ‘লিগেসি অফ টেরর : দ্য প্লাইট অফ ইয়াজিদি চাইল্ড সারভাইভার্স অফ আইসিস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, উদ্ধার করা ইয়াজিদি শিশুদের মানসিক সুস্থতা ফেরাতে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ সহায়তা দরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
তাড়া করছে ভয়
অপহৃত হওয়ার পর নাসরিনকে বিভিন্ন শহরে নিয়ে গিয়েছে অপহরণকারীরা৷ পরবর্তীতে তাকে সিরিয়া নিয়ে গিয়ে নিজের বিশ্বাস ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়৷ এরপর দুইবার তাকে যৌনদাসি হিসেবে আইএস যোদ্ধার কাছে বিক্রি করা হয়৷ পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে কঠিন শাস্তির মুখোমুখিও হতে হয়েছিল তাকে৷ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি৷
নাসরিন যে এলাকায় শরণার্থী শিবিরে বাস করেন, সেখানে এখনও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়৷
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ইয়াজিদি নারী জানান তার সামনেই ২০১৪ সালে তার আত্মীয়কে হত্যা করে আইএস জঙ্গিরা৷ ৩১ বছর বয়সি এ নারী বলেন, ‘‘আমার পরিবারের অনেক সদস্যই এখনও নিখোঁজ৷ আজও আমরা ভয় আর উদ্বেগের মধ্যে বাস করছি৷ আমাদের নিরাপত্তা প্রয়োজন৷ এখন তিনি তুরস্ক সীমান্তে এক শরণার্থী ক্যাম্পে বাস করছেন৷
ক্ষতিপূরণের আশ্বাস
ইরাকের প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ রোববার জানিয়েছেন যৌন দাসত্ব থেকে বেঁচে ফেরা ইয়াজিদিদের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ, শিক্ষা, বাসস্থান এবং চাকরি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশটির পার্লামেন্ট খুব শিগগিরই একটি আইন পাস করতে পারে৷
তবে এ ব্যবস্থা গ্রহণে এতো দেরি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই৷ ইরাকি পার্লামেন্টের ইয়াজিদি সদস্য সাইব খিদির বলেন, ‘‘আমাদের তো এই দাবি বারবার তোলারই কথা না৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তো বটেই, স্থানীয় পর্যায়েও এ বিষয়কে অনেক অবজ্ঞার সঙ্গে দেখা হচ্ছে৷''
জাতিসংঘে সিনজার গণহত্যার বার্ষিকীর আয়োজনে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করা আইনজীবী আমাল ক্লুনি বলেন, তিনি গত বছরও আইএসকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ কিন্তু এখনও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷
জাতিসংঘ ও ইরাক সরকারের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে আইএস জঙ্গিদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব বলেও মনে করেন ক্লুনি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা যদি এখনই ব্যবস্থা না নেই, তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে৷ সিরিয়ায় অস্থায়ী যেসব কারাগারে আইএস যোদ্ধাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে যেকোনো দিন পালিয়ে যেতে পারে জঙ্গিরা৷ গত অক্টোবরে শত শত বন্দি কিছু কারাগার থেকে পালিয়েছে৷''
ইরাক এরই মধ্যে কয়েক হাজার সন্দেহভাজন আইএস যোদ্ধার বিচার শুরু করেছে৷ জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো কিছু ইউরোপীয় দেশও তাদের দেশে ফেরা জঙ্গিদের বিচার শুরু করেছে৷ কিন্তু নাসরিন এখনও ইরাকে থাকতে ভয় পাচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে আমার অনেক বড় বড় স্বপ্ন ছিল, সুন্দর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ছিল৷ কিন্তু এখন আমার ভবিষ্যত হারিয়ে গিয়েছে, আমি জানি না আমার ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে৷''
অত্যাচারিত ইয়াজিদি নারীদের জন্য নতুন আশা
ইরাকে গড়ে তোলা হয়েছে তখাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর নির্যাতনের শিকার ইয়াজিদি নারীদের জন্য নতুন সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সেন্টার৷ সে অঞ্চলে এমন চিকিৎসাকেন্দ্র এটাই প্রথম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
এক নির্যাতিতা
ছবির এই ইয়াজিদি নারীর নাম পেরভিন আলি বাকু৷ ২৩ বছর বয়সি পেরভিনকে তাঁর তিন বছরের মেয়েসহ ধরে নিয়ে গিয়েছিল আইএস৷ দু’বছরেরও বেশি সময় অকথ্য নির্যাতন সইতে হয়েছে তাঁকে৷ এখন তিনি ইরাকের এক শরণার্থী শিবিরে৷ আইএস-এর কবল থেকে মুক্ত৷ তবু আতঙ্ক কাটেনি৷ এখনো কেউ একটু জোরে কথা বললেই মনে হয় এই বুঝি বর্বর লোকগুলো এলো, এই বুঝি আবার শুরু হলো অত্যাচার-নির্যাতন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
যে কারণে স্বস্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকি সেনাবাহিনীর আক্রমনে আইএস অনেকটাই দিশাহারা৷ পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে তারা৷ তাদের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে অনেক ইয়াজিদি নারী৷ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে জার্মানির বাডেন ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্য৷ রাজ্যটি ইতিমধ্যে আইএস-এর কবল থেকে মুক্ত ১১শ ইয়াজিদি নারীকে জার্মানিতে নিয়ে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
শরণার্থী শিবিরে বাড়ছে ইয়াজিদি নারী
আইএস-এর কাছ থেকে মু্ক্ত হয়ে প্রায় নিয়মিতই ইয়াজিদি নারীরা আসছেন শরণার্থী শিবিরে৷ জার্মানিতে অবস্থানরত ইয়াজিদিদের উদ্যোগে অত্যাচারের শিকার ওই নারীদের কেউ কেউ আবার আশ্রয় পাচ্ছেন জার্মানিতে৷ জার্মানিতে প্রায় এক লক্ষ ইয়াজিদির বসবাস৷ তাদের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে ইয়াজিদি নারীদের নিয়ে আসার জন্য ইতিমধ্যে ৯ কোটি ৫০ লক্ষ ইউরোর বাজেট অনুমোদন করেছে বাডেন ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্যের সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
তাঁদের কোনো চিকিৎসা নেই
মোসুলে আইএস কোণঠাসা হয়ে পড়ায় প্রতিদিনই সেখান থেকে ইয়াজিদিরা ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলে আসছেন৷ মোসুল থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের এই শরণার্থী শিবিরে তেমন কোনো চিকিৎসা সুবিধা নেই৷ অত্যাচারের ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে ফেরা নারীদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসারও ভালো ব্যবস্থা নেই৷ ৫৫ লাখ কুর্দির এই অঞ্চলে আছে মাত্র ২৬ জন মনরোগ চিকিৎসক৷ কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ইয়াজিদি নারীদের চিকিৎসা করছেন তাঁরা৷
অবশেষে আশার আলো
বয়স যখন মাত্র ছয়, তখনই ইরাক ছেড়ে জার্মানিবাসী হয়েছিলেন ইয়াজিদি ট্রমা স্পেশালিস্ট ইয়ান কিজিলহান৷ ইরাকের ডোহুকে সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সেন্টার গড়ে তোলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
প্রশিক্ষণের সুযোগ
ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আগামী তিন বছরে ইরাকের ৩০ জন সাইকোথেরাপিস্টকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে৷ আগামী দশ বছরে অন্তত হাজারখানেক প্রশিক্ষিত সাইকোথেরাপিস্ট তৈরির উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ধীরে ধীরে উন্তত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
পাশে দাঁড়ানোটা দায়িত্ব
এ পর্যন্ত কয়েক হাজার ইয়াজিদি নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন কিজিলহান৷ তাঁদের কাছ থেকে জেনেছেন নির্যাতনের ভয়ংকর সব কাহিনি৷ জার্মানিতে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ট্রমা স্পেশালিস্ট ইয়ান কিজিলহান জানালেন, তাঁর কাছে অসহায় ওই নারীদের সহায়তা করা এখন অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য৷