বাংলাদেশে গত ছয় বছরে কর্মক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছেন৷ তারা ভবন ধস, আগুনসহ নানা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন৷ আর এককভাবে এই শ্রমিকদের বড় অংশ তৈরি পোশাক কারাখানার৷
বিজ্ঞাপন
‘সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি' ও ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)' তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত শতাধিক ঘটনায় এসব শ্রমিক নিহত হন৷ এর মধ্যে শুধু চলতি বছরে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ২১৭টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৬০ জন শ্রমিক৷ এর মধ্যে অগ্নিকাণ্ডে ১২ জন৷
পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মোট ৩০৩৬ শ্রমিক নিহত হয়েছেন৷ যার মধ্যে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন ২৪৭ জন৷ আর ভবন ধসে প্রায় ২০০০ শ্রমিক নিহত হয়েছেন৷ মোট নিহত শ্রমিকদের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি তৈরি পোশাক কারখানার৷
বাংলাদেশে পোশাক কারখানার নিরাপত্তা
পশ্চিমা বিশ্বের একদল পরিদর্শক বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে ভয়াবহ নিরপত্তা ঝুঁকি দেখতে পেয়েছেন৷ রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তারা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
রানা প্লাজা বিধ্বস্তের পর...
২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হলে নিহত হয় অন্তত ১,১০০ পোশাক শ্রমিক৷ এ ঘটনার পর পশ্চিমা যেসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়, তারা পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়৷ সম্প্রতি বেশ কিছু নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছেন৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ঝুঁকি
পরিদর্শকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ পোশাক কারখানায় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা এবং ভবনের কাঠামোর বিষয়ে অন্তত ৮০,০০০ নিরারপত্তা ইস্যু খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷
ছবি: Kamrul Hasan Khan/AFP/Getty Images
২,২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য
বাংলাদেশে পোশাক খাতে বাণিজ্যের পরিমাণটি বিশাল৷ অর্থের অঙ্কে প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার৷
ছবি: DW/C. Meyer
পোশাক রপ্তানিতে মন্দা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে গার্মেন্টসগুলো তাদের ক্রেতা হারাচ্ছে৷ ফলে পোশাক রপ্তানির হার হ্রাস হয়েছে৷
ছবি: Reuters
পোশাক কারখানা পরিদর্শন
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম এবং ইনডিটেক্সসহ ১৮০টিরও বেশি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি ও সদস্যরা অন্তত ১,১০৬টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ তাঁরা জানিয়েছেন, প্রতিটি কারখানায় বৈদ্যুতিক ঝুঁকির পাশাপাশি, ভবনের কাঠামো ও অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাতে গাফিলতি খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷ এমনকি অনেক কারখানায় ফায়ার অ্যালার্ম ও ফায়ার এক্সিটও নেই৷
ছবি: DW/C. Meyer
অবিলম্বে খালি করার নির্দেশ
১৭টি কারখানা অবিলম্বে খালি করে বন্ধের নোটিস দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিদর্শকরা৷ কারণ ঐ ১৭টি কারখানা যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা৷ এছাড়া ১১০টি কারখানার ভবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলেও জানা গেছে৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা
এর আগে নর্থ অ্যামেরিকান কোম্পানি ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর মতো বেশ কিছু কোম্পানির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের ৫৮০টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ উদ্দেশ্য একই, নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা৷ দেশের অন্তত ৩০০টি কারখানায় ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর পোশাক তৈরি হয়৷
ছবি: AP
আশঙ্কায় শ্রমিকরা
তবে যেসব কারখানা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেসব শ্রমিকরা বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন৷ কেননা পরিদর্শকরা শ্রমিকদের বেতন দেয়ার কথা বললেও মালিকরা এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি৷
ছবি: Imago/Xinhua
পরবর্তী পদক্ষেপ
পরিদর্শকরা বেশিরভাগ কারখানার মালিক ও প্রকৌশলীদের নিয়ে আলোচনায় বসে কী কী ইস্যুতে পরিবর্তন আনা দরকার, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে৷ এরপর আবারো তাঁরা পরিদর্শনে আসবেন নিজেদের নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়ন হলো, তা দেখার জন্য৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্যপরিষদের আহবায়ক সিরাজুল ইসলাম রনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কারখানাগুলো শ্রমিক নিরাপত্তার দিকে নজর না দেয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘রানা প্লাজা ধসের পর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপে পোশাক কারখানার মালিকরা কারখানায় শ্রমিক নিরপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে সত্য কিন্তু তা সর্বক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয়৷ আর পোশাক কারখানা ছাড়া অন্য যেসব কারখানা রয়েছে সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ রয়েই গেছে৷ সেদিকে নজর দেয়ার কেউ নেই৷''
সিরজুল ইসলাম বলেন, ‘‘শ্রমিক নিরাপত্তা আইন পর্যাপ্ত নয়৷ আর দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণের বিধানও কার্যকর নয়৷ যা আছে তা যত্সামান্য৷ শ্রমিকদের গ্রুপ বীমার নামে যা চালু আছে তা হাস্যকর৷ তাজরীন ফ্যাশানস-আগুন লাগার পর দেখা গেছে গ্রুপ বীমার নামে সর্বোচ্চ ৫০ জন শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পাবেন৷ তাও জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকার কম৷''
এদিকে মানবাধিকার নেতা এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব৷ কিন্তু বাংলাদেশে তা হচ্ছে না৷ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পোশাক কারখানায় শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ শুরু হয়েছে৷ কিন্তু নিজেদের তাগিদ থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে না হলে সেই কাজ শেষ পর্যন্ত কতটুকু নির্ভরযোগ্য হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷''
২৪শে এপ্রিল, ২০১৩৷ সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছের সুউচ্চ ভবন ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ল বিকট শব্দে৷ ধসের আশঙ্কাকে আমলে না নেয়ার পরিণাম ১,১৩৫ জন পোশাক শ্রমিক, করুণ মৃত্যু৷ আহত এক হাজারেরও বেশি মানুষের এখনো দিন কাটে আতঙ্কে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাঁচা আর বাঁচানোর লড়াই
ভবন মালিক সোহেল রানার অর্থলিপ্সার নির্মম শিকার পোশাক শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য সরকারি উদ্যোগের অপেক্ষায় বসে থাকেননি সাধারণ মানুষ৷ দূর দূরান্ত থেকে ছুটে এসে একরকম খালি হাতেই অনেকে নেমে পড়েন উদ্ধার কাজে৷ নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে বহু পোশাক শ্রমিককে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters
অসহায়ত্ব
আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকলেও, ঘটনাস্থলে উদ্ধারকর্মীর কমতি ছিল না৷ তবুও অনেকেই চলে গেছেন স্বজনদের কাঁদিয়ে৷ এ ছবির মতো অবস্থাতেও উদ্ধার করতে হয়েছে অনেক মৃতদেহ৷ ৮০০-রও বেশি মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা গেলেও, অনেকের পরিচয় আজও জানা যায়নি৷ কিছু লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে৷ কিন্তু ৮৭ জনের জন্য নতুন করে নমুনা চাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রেশমার ফেরা
রানা প্লাজা ধসের ১৭তম দিনে ঘটে বিস্ময়কর এক ঘটনা৷ ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে আর কাউকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব নয় ভেবে সাধারণ উদ্ধারকারীদের অনেকে যখন ঘরে ফিরছেন, তখনই প্রায় সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২২ বছর বয়সি পোশাক শ্রমিক রেশমাকে৷
ছবি: Reuters
এখনো কাঁদে প্রাণ
ধসের পর ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন অনেকে৷ বিজিএমইএ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা৷ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা হয়েছে ঠিকই, তবে বিতরণ করা হয়েছে ২২ কোটি টাকা৷ ভবন ধসের বর্ষপূর্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের মুখে শোনা গেছে হতাশা আর ক্ষোভের কথা৷ পপি বেগমকে কেড়ে নিয়েছে রানা প্লাজা৷ ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে তাঁর কবর জিয়ারত করতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন বোন রোজিনা৷
ছবি: DW/M. Mamun
মায়ের কান্না
জুরাইন কবরস্থানে রশিদা খাতুনের কবরের পাশে সফুরা খাতুন৷ ভবন ধসের প্রায় দশ মাস পর, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি পেয়েছিলেন সন্তানের লাশ খুঁজে পাওয়ার সান্ত্বনা৷
জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করতে মূলত তাঁদের পরিবারের সদস্যরাই এসেছিলেন৷ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তিতে আয়োজন ছিল অনেক, তবে জুরাইন কবরস্থানে ভিড় ছিল না তেমন৷ সেখানে এভাবেই হারানো স্বজনের ছবি হাতে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছিলেন এক নারী৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রদর্শনী
রানা প্লাজা ধসের ছবি নিয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী৷ বাংলাদেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত ৬০ জন আলোকচিত্র সাংবাদিকের তোলা ছবি স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ফুলের জলসা
রানা প্লাজা ধসে নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছে বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠন৷
ছবি: DW/M. Mamun
মোনাজাত
জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত৷
ছবি: DW/M. Mamun
10 ছবি1 | 10
‘‘শ্রম মন্ত্রণালয় বা কারাখানা পরিদর্শকরাও তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেন না৷ ফলে শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে এত বেশি হারে দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছেন'' বলে মনে করেন নূর খান৷
অন্যদিকে মজুরি কমিশনের সাবেক প্রধান ইকতেদার আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি ২০১৪ সালের সংশোধিত শ্রম আইনে পরিস্কার করা হয়েছে৷ কিন্তু এই আইন মানা হচ্ছেনা৷ সরকারের দায়িত্ব হল এই আইন যাতে সবাই মানেন তার ব্যবস্থা করা৷ কিন্তু সরকার তা করছে বলে মনে হয়না৷'' তিনি বলেন, ‘‘আহত বা নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের যে বিধান তা সামান্য৷ আর তা আদায় করাও জটিল৷ মামলা ছাড়া তা আদায় করা যায় না৷ দরিদ্র শ্রমিকরা মামলা করতে পারেন না৷ আর ক্ষতিপূরণও পান না৷ রানা প্লাজা ধসের পর যেটুকু ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে তাও ত্রিপক্ষীয় চুক্তির কারণে৷''
‘সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি' ও ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)' তাদের প্রতিবেদনে গার্মেন্টসের মতো প্রতিটি সেক্টরে নিরাপত্তা কার্যক্রম বাড়ানো এবং রাজউক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরসহ আইন বাস্তবায়নকারী অন্যান্য সংস্থার দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধি করাসহ ছয়টি সুপারিশ করেছে শ্রমিক নিরাপত্তার জন্য৷