1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছয় বছর পেরিয়েও আশাহীন, দিশাহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী

আজাদ মজুমদার
২৫ আগস্ট ২০২৩

রহিমা বেগম একজন সাধারণ রোহিঙ্গা নারী। ছয় বছর আগে ভয়াবহ বর্বরতা ও রোহিঙ্গা ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

গত এক বছরে যত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের বড় একটা অংশ মাঝি
গত এক বছরে যত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের বড় একটা অংশ মাঝিছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images

প্রথম কিছুদিন স্বস্তিতে কাটলেও ইদানীং আবার তার দিন কাটছে আতঙ্কে।

রাত নামলেই বাড়ছে দুশ্চিন্তা। রহিমার ভাষায়, "দুষ্কৃতকারীরা যখন গুলি ছোড়ে, তখন পুলিশের ধাওয়া এবং বড় বড় গুলির আওয়াজে ঘুমাতে পারি না, কলিজা পর্যন্ত কেঁপে উঠে আমাদের।"

রহিমার দুশ্চিন্তার কারণ একাধিক। তার স্বামী একটি ক্যাম্পে সাব-মাঝির দায়িত্বে আছেন। মাঝিরা এখন নানা কারণে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তু। বিভিন্ন প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের সহযোগিতা করতে হয়, যা ক্যাম্পে সক্রিয় অনেক গোষ্ঠীর পছন্দ নয়। গত এক বছরে যত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের বড় একটা অংশ মাঝি। রহিমার কথায়ও যা স্পষ্ট, "আমার স্বামী মাঝি বলেও আমাদের আতঙ্কের শেষ নেই। কারণ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাঝিরাই বেশি ঝুঁকিতে, যদিও তিনি নির্দোষ ও ভালো মানুষ। কোনো খারাপ কাজে তিনি লিপ্ত নেই। ভালো মানুষগুলো এখন এখানে বেশি বিপদে পড়ে, তাই তাকে মাঝির দায়িত্ব ছেড়ে দিতেও বলতে পারছি না।"

রহিমার দুশ্চিন্তা কেবল স্বামী নয়, চার সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তাও প্রায়ই তাকে বিমর্ষ করে রাখছে। রহিমার বড় সন্তানের বয়স এখন ১২। আর কিছুদিন পর কৈশোর পেরিয়ে গেলে তাকেও জীবনযুদ্ধে নামতে হবে। কিন্তু রহিমা জানেন না এটা কিভাবে সম্ভব হবে। সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ এখানে সীমিত। কর্মের নিশ্চয়তা নেই, নেই জীবনের নিরাপত্তাও। "আমি, আমার ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে আতঙ্কে আছি। ছেলেগুলো যত বড় হচ্ছে, ভয় তত বাড়ছে।"

পরিস্থিতি শান্ত হলে রহিমা আশা করছেন, মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু আপাতত সেই সম্ভাবনাকেও সুদূর পরাহত মনে করছেন সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই। রোহিঙ্গাদের এই পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বর্ণনা করেছেন একটি আশাহীন সময় হিসেবে। "এই বিপুল জনগোষ্ঠীর এরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, কর্ম দক্ষতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, কর্ম স্পৃহা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং এটার মধ্য দিয়ে আশাহীন সমাজ বা আশাহীন একটি জাতি হিসেবে রোহিঙ্গারা সামনে চলে আসছে," বলছিলেন লিটন।

'বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা গোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত'

This browser does not support the audio element.

যখন কারো অতীত হয় বিভীষিকাময়, বর্তমান কাটে আতঙ্কে আর ভবিষ্যৎ থাকে অনিশ্চয়তায় ভরা, অন্ধকার তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে। বাংলাদেশে বসবাসরত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গারও সময় কাটছে এখন একরকম অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। আর তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। মাদক ব্যবসায় ব্যবহৃত হচ্ছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা তরুণ, যাদের এই মুহূর্তে অন্য কোনো কাজ নেই। এর ফলে হত্যা, রাহাজানি- এসবই হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নৈমিত্তিক ঘটনা।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ২০২২ সালে রোহিঙ্গা শিবিরে ৪০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে হত্যা করেছে এবং ২০২৩ সালে এসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আরো অনেক বেড়েছে। বছরের প্রথমার্ধেই কেবল ৪৮ জন শরণার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ জন মাঝিও আছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। মুক্তিপণের জন্য অসংখ্য শরণার্থীকে অপহরণ করা হয়েছে এবং হুমকি দেওয়া হয়েছে বা নির্যাতন করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিয়ে এবং শিশু নিয়োগে সশস্ত্র গোষ্ঠীর জড়িত থাকার কথা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছে।

ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে আর্মড পুলিশ ব্যটেলিয়নের তিনটি ইউনিট। আর্মড পুলিশ ব্যটিলিয়ন-৮-এর এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, কেবল মাত্র তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ক্যাম্পগুলোতেই এ বছর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ২৮ জন রোহিঙ্গা৷ তবে ব্যাটেলিয়ন অধিনায়ক, বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহা পরিদর্শক আমির জাফর দাবি করেছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে।

"এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দুই-তিনটি সংগঠন কাজ করে। এলাকায় আধিপত্য বিরাজ থেকে মাদক ব্যবসা চালানোর জন্য তারা প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে, এটা নিয়ে মাঝে মাঝে কিছু সহিংস ঘটনাও ঘটে। সেক্ষেত্রে আমাদের এপিবিন পুলিশ এখানে ২৪ ঘন্টাই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, পরিশ্রম করে যাচ্ছে, এবং আইন-শৃঙ্খলার যেন অবনতি না হয়, এখানে সাধারণ রোহিঙ্গা যারা আছে, তাদের জীবনযাত্রা যেন স্বাভাবিক থাকে, সে জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি," বলেছেন তিনি।

'পুলিশ ২৪ ঘণ্টা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরলস কাজ করে'

This browser does not support the audio element.

"এই মুহূর্তে আইন-শৃঙ্খলা পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়তো কিছু ঘটে, কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে, শুটিংয়ের ইনসিডেন্ট হয়৷ সেক্ষেত্রে আমরা আইনগত ব্যবস্থা দ্রুত নেই. দ্রুতই যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের শনাক্ত করে লোকাল থানায় সোপর্দ করি এবং পরবর্তীতে বিচারিক প্রক্রিয়ার দিকে সেটা যায়।"

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই মুহূর্তে সন্ত্রাসী হামলার জন্য যাদের দায়ী করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), মুন্না গ্যাং, ইসলামী মাহাজ অন্যতম। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হিসেবেই এই মুহূর্তে ক্যাম্প গুলোতে অন্তত ১১টি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।

মাদক চোরাচালান এবংমানব পাচারের সাথে জড়িত বেশ কয়েকটি অপরাধী চক্র রোহিঙ্গা শিবিরগুলিতে বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে, যার অসহায় শিকার হচ্ছেন সাধারণ শরণার্থীরা। অ্যাক্টিভিস্ট, শিক্ষিত রোহিঙ্গা এবং মাঝিরাই অধিকাংশ সময় এদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন, যা রোহিঙ্গা নাগরিক সমাজের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। অনেক রোহিঙ্গাই মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে অভিযোগ করেছেন, নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েও তারা পাননি। কারো কারো ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা করাই তাদের নিজের এবং পরিবারের জন্য কাল হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের এই অসহায়ত্ব প্রতিফলিত হয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটনের বক্তব্যে। "দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মিয়ানমার আর্মি দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশে আসার পর আজকে ক্যাম্পে যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটা কোনোভাবেই সুখকর কিছু না। ভালো কোনো কিছু না। বরং এখন যেটা দেখা যাচ্ছে যে, ক্যাম্পে দলীয় কোন্দল, অর্থ্যাৎ সশস্ত্র যে গ্রুপগুলো বাস করছে, তাদের এক ধরনের প্রতিযোগিতা, প্রতিহিংসা এবং বর্বরতার শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। এখানেও নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পুলিশি অভিযান বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে অভিযান, সে অভিযানেও কিন্তু সাধারণ রোহিঙ্গারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সন্দেহের ভিতর পড়ছে এবং তাদের জীবন এমন বিভীষিকাময় হচ্ছে যে স্বাধীনভাবে তারা যে চলাফেরা করবে, ক্যাম্পের ভেতর সেই নিরাপত্তাটাও কিন্তু দেওয়া যাচ্ছে না।"

ক্যাম্পের বর্তমান পরিস্থিতিকে ভয়াবহ হিসেবে বর্ণনা করে রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী ক্য উইন তাদের জন্য আরো বেশি নিরাপত্তা দাবি করে বলেছেন, "বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এখন ক্যাম্প পরিস্থিতি তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ না আমরা বাড়ি ফিরে আসি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের শিবিরে মানুষ হিসাবে ঘুমাতে এবং খেতে সহায়তা করা উচিত।"

পুলিশি নিরাপত্তার পাশাপশি নুর খান লিটন রোহিঙ্গাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে বলছেন। যদিও এই পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রত্যাবর্তনে, অথবা তৃতীয় কোনো দেশে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনকেই সমাধান মনে করছেন বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা। কিন্তু এখানেও পরিস্থিতি এক রকম আশাহীন হিসেবে বর্ণনা করেছেন তারা।

প্রত্যাবাসন উদ্যোগে যে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই এটা প্রায় সবারই জানা। চীনের প্রচেষ্টায় পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের যে উদ্যোগ, সেটা বাস্তবায়িত হলে মিয়ানমার ফিরে যেতে পারবেন মাত্র ১,১৭৬ জন।

তৃতীয় কোনো দেশে দেশে পুনর্বাসনের চেষ্টায় সফলতা কণামাত্র। জোহনেসবার্গের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছেন, উন্নত দেশগুলোকে তারা এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন, কেউ কেউ তাতে সাড়াও দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অ্যামেরিকা গ্রহণ করেছে মাত্র ৬২ জন, কানাডা ৩ জন। বাকিরা সময় কাটাচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশাহীন বিভীষিকায়।

রোহিঙ্গা মেয়েদের জন্য ‘মাইয়া স্কুল’

02:05

This browser does not support the video element.

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ