বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত নয় মাসে ছয় বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ৷ এই ছয় ব্যাংক হচ্ছে- আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক৷
বিজ্ঞাপন
এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা৷ যা ব্যাংকিং খাতে চলমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে৷
চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে ৪৩ বেসরকারি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৩৪ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল এই ছয় প্রতিষ্ঠানের৷
এই ছয় ব্যাংকের মধ্যে বছরের প্রথম নয় মাসে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি সবচেয়ে বেশি৷ যা ছয় হাজার ৬৫৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা৷
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘‘সম্প্রতি আমরা খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ আদায় করেছি৷ তাই বছরের শেষ প্রান্তিকে আমাদের খেলাপির পরিমাণ কম হবে৷''
তবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তাদের আরও কিছু সময় প্রয়োজন বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা৷
প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক এবি ব্যাংকের গত নয় মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৮ দশমিক ছয় শতাংশ বেড়ে পাঁচ হাজার ৯৪১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে৷
চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের (বিসিবি) খেলাপি ঋণ ৩৮ দশমিক আট শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা৷ বিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘বিসিবির বিতরণ করা মোট ঋণের ৬০ শতাংশ খেলাপি৷'' খেলাপি ঋণের উচ্চহারের কারণে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ৫৪২ কোটি টাকা৷
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের চিত্র
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি সবচেয়ে শোচনীয়৷ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত প্রতি ১০০ টাকার ২০ টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে৷ আরো জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
খেলাপি ঋণ কী
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহক তার ঋণ বা এর উপর আরোপিত সুদ পরিশোধ না করলে তা খেলাপি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়৷ বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে৷ ছয় থেকে ১৮ মাসের বকেয়া ঋণকে নিম্নমানের, ১৮ থেকে ৩০ মাসের বকেয়াকে সন্দেহজনক এবং তার বেশি সময় পরিশোধ না হলে তা অনাদায়ের ঝুঁকিতে থাকা মন্দ ঋণ৷
ছবি: Mika Volkmann/picture alliance
আট শতাংশ
আইএমএফ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত মেনে আগস্টে প্রকাশিত বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে গত বছরের খেলাপি ঋণের বিশদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ সেই হিসাবে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের আট শতাংশের বেশি৷ সবশেষ মার্চের হিসাবে তা বেড়ে আট দশমিক আট শতাংশ হয়েছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি
বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, এই পরিসংখ্যানেও খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না, কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায়ই নানা সুবিধা দিয়ে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে৷ সেগুলো তখন আর খেলাপির তালিকায় রাখা হয় না৷ ২০২২ সালে এমন বকেয়া পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা৷ আর বকেয়া খেলাপি ঋণ ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
দেশের বাজেটের অর্ধেক
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা৷ অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের অর্ধেকের সমপরিমাণ৷
ছবি: Xinhua News Agency/picture alliance
৮৮ শতাংশই মন্দ ঋণ
মোট খেলাপি হওয়া ঋণের সাড়ে ৮৮ শতাংশই আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে অনাদায়ী৷ অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো গ্রাহককে তাগাদা দিয়েও সেগুলো আদায় করতে পারছে না বা পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের শ্রেণি অনুযায়ী, যা মন্দ বা না পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ঋণ৷
ছবি: MD Mehedi Hasan/ZUMA Press/picture alliance
পাঁচ ব্যাংকেরই অর্ধেক
বাংলাদেশে এখন মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি৷ এর মধ্য মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৬ শতাংশ ৫টি ব্যাংকের গ্রাহক৷ আর প্রথম দশটি ব্যাংকের প্রায় ৬৫ শতাংশ৷ আটটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের বেশি৷ এর তিনটি সরকারি, তিনটি বেসরকারি, একটি বিদেশি আর একটি বিশেষায়িত৷ ৩৮টি ব্যাংকের খেলাপির হার পাঁচ শতাংশের কম৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারি ব্যাংকে ২০%
সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত প্রতি ১০০ টাকার অন্তত ২০ টাকাই খেলাপি৷ বিশেষায়িত ব্যাংকে এটি প্রায় ১৩ শতাংশ৷ অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকে এই হার পাঁচ শতাংশের কিছু বেশি৷ তবে বেসরকারি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ বেশি হওয়ায় তাদের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ সরকারি ব্যাংকেরই সমান৷ খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে কম বিদেশি ব্যাংকগুলোর যা পাঁচ শতাংশেরও কিছু কম৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারিতে বাড়ছে, বেসরকারিতে কমছে
গত এক বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ এক শতাংশ বেড়েছে৷ কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকে উল্টো দশমিক এক-আট শতাংশ কমেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক
খেলাপি ঋণে সবচেয়ে এগিয়ে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানগুলো৷ মোট খেলাপির প্রায় ২৭ শতাংশ আছে তাদের কাছে৷ সব মিলিয়ে খেলাপির ৫৫ ভাগই শিল্প খাতের৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফিরে দেখা
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশে পৌঁছায়৷ সত্তর ও আশির দশকে ব্যাংকগুলো যাথযথ নিয়ম মেনে ঋণ প্রদান না করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে৷ তবে নজরদারি বৃদ্ধির কারণে ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১১ সালের দিকে খেলাপি ঋণের হার ৬.১ শতাংশে নামে৷ কিন্তু পরের বছর তা দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অন্যান্য দেশ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি৷ বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় ভারতে এই হার সাড়ে ছয় শতাংশ, পাকিস্তানে সাত দশমিক তিন, নেপালে দুই দশমিক চার, শ্রীলংকায় প্রায় পাঁচ, মালদ্বীপে প্রায় ছয় শতাংশ৷ যেখানে বাংলাদেশ খেলাপি ঋণের হার আট শতাংশের বেশি৷
ছবি: Indranil Mukherjee/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
গত বছর আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া ওয়ান ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত সেপ্টেম্বর শেষে ২১ দশমিক আট শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৪১ কোটি টাকা৷ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর মফিজ বলেন, ‘‘আমরা এখন নতুন ঋণ বিতরণের চেয়ে ঋণ পুনরুদ্ধারের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি৷''
গত নয় মাসে পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সাত দশমিক তিন শতাংশ বেড়ে তিন হাজার ৬৭২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা হলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এটি ছিল ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের ৬৩ দশমিক সাত শতাংশ৷ পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রদান নির্বাহী তারেক রিয়াজ খান স্বীকার করেছেন যে ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে পদ্মা ব্যাংক তাদের নথিতে ঋণের প্রকৃত পরিমাণ কমিয়ে দেয়৷ তিনি বলেন, ‘‘রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না৷ তবে এর পরিমাণ কমাতে আমরা নানান আইনি উদ্যোগ নিচ্ছি৷''
বিলুপ্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে জন্ম নেওয়া আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৬৮৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা৷ এটি গত বছর শেষে ছিল ৬৮৬ কোটি ১০ লাখ টাকা৷ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ বলেন, ‘‘যে ঋণ ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বিতরণ করেছে তা আমাদের নয়৷''
ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘ছয় ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ গড় হারের তুলনায় বেশি বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়৷''
‘‘সব ধরনের ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে৷ ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়,'' বলে মন্তব্য করেন তিনি৷