1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশ : বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা যাবে?

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত প্রথম ধাপের ছয় কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব কমিশনের সুপারিশগুলো এরই মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

নানা খাতে সংস্কারের জন্য গঠন করা ছয়টি কমিশন এরই মধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেছবি: CA Press Wing

কমিশনগুলোর প্রস্তাবে এমন কিছু সুপারিশ উঠে এসেছে, যেগুলোর কথা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল। বাংলাদেশের নানা খাতে গেড়ে বসা নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূ্র করার জন্য এই সুপারিশগুলো যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে ততই মঙ্গল। তবে অনেকগুলো সুপারিশ আবার আকাশ-কুসুম কল্পনায় ভরা। নিজেদের কর্মপরিধির বাইরে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় সুপারিশও স্থান পেয়েছে। কিছু সুপারিশ বিদ্যমান আইন, এমনকি আদালতের নির্দেশনার সাথেও সাংঘর্ষিক। আবার কিছু সুপারিশ এমনভাবে করা হয়েছে যা দেখে প্রতীয়মান হয়, সুপারিশগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য প্রণীত হয়েছে। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো যতটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তাতে এগুলো বাস্তবায়ন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আদৌ সম্ভব কীনা? কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো এমন কোনো অস্ত্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সাময়িকভাবে ব্যবহার করতে চাইবে না, যেটি ভবিষ্যতে তার বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র হয়ে ব্যবহৃত হতে পারে।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়াসহ প্রতিষ্ঠানটির সংস্কারে মোট ৪৭টি সুপারিশ করেছে দুদক সংস্কার কমিশন। এসব প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য জোর দেয়া হয়েছে। তবে সংস্কার প্রতিবেদনে যেমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাব আছে, তেমনি কিছু প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। দুদক সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের প্রথম ১০টি সুপারিশ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও আইনি সংস্কার বিষয়ে। এর মধ্যে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদের অধীনে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দানের যে কোনও রাষ্ট্রীয় চর্চা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করা, যথাযথ আইনি কাঠামোর মাধ্যমে কোম্পানি, ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশনের প্রকৃত বা চূড়ান্ত সুবিধাভোগীর পরিচয়-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি রেজিস্ট্রারভুক্ত করে জনস্বার্থে প্রকাশ নিশ্চিত করার মতো – সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড কমে আসতে পারে। দুদক সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে দুদকের মর্যাদা, গঠন, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, তদন্ত ও বিচারের ওপর যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ততটাই অনুপস্থিত বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণগুলো কী কী। মানুষ যেহেতু নির্বস্তুক কোন সত্তা নয়, সেহেতু দুর্নীতি কোনো একক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। দুর্নীতির কারণগুলো শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, এগুলো প্রেক্ষাপটমূলকও বটে। কিন্তু দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো থেকে এটি প্রতীয়মান হওয়া অমূলক নয় যে, দুর্নীতি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক একটি প্রক্রিয়া, যেটি থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিষ্ঠান ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মুক্ত করা গেলে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে। আইন থাকলে এবং আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে হলেই দুর্নীতি রোধ করা যাবে – এমন ধারণা পোষণ করলে সেটি হবে সামাজিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। মানুষের মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা যদি রাষ্ট্র দিতে না পারে, তাহলে সে রাষ্ট্রে কখনোই কঠোর আইন ও শক্তিশালী দুদক দিয়ে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়। অভাব ও প্রয়োজন – এমন বাস্তবতা যা বন্যার পানির মতো, যেটি দরকার লাগলে বাঁধও মানে না। মানুষের দুটি মৌলিক চাহিদা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। এ দুটির নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই দুটি খাতই বেসরকারি ও বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। একজন পুলিশ কনস্টেবেলের বেতন থেকে কর কর্তনের পরও রাষ্ট্র তার সন্তানের সুচিকিৎসা ও সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছে না। এই দায় ওই কনস্টেবলকেই মেটাতে হচ্ছে। ফলে মৌলিক অধিকারের অপূর্ণতা রাষ্ট্রের ব্যষ্টিক পর্যায়ে দুর্নীতির প্রসার ঘটাচ্ছে, যেটি হাজারও আইন দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এই মৌলিক বিষয়টির অনুপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

অনেকদিন ধরে বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক পাগলা ঘোড়া হিসেবে পরিচিত। এই বাহিনীর সংস্কারের যে আলাপ তা বহু পুরানো। বৃটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত বাহিনীটির সংস্কারের জন্য কমপক্ষে ১০টি কমিশন গঠিত হয়েছিল। সবশেষ ২০০৭ সালে খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশও প্রণীত হয়েছিল। তবে জুলাই অভ্যুত্থান দমনে ছাত্র–জনতার বিপক্ষে পুলিশের সহিংস ভূমিকার কারণে পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট দিয়েছে। ১১০ পৃষ্ঠার রিপোর্টে পুলিশের ১৩টি বিষয়ে ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া বাহিনীর সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে কমিশন। সংস্কার রিপোর্টে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য পুলিশ কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও পুলিশ কমিশনই কীভাবে প্রভাবমুক্ত থাকবে সেটি পরিষ্কার নয়। যে দেশে সংসদীয় কমিটিগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়, বিচারিক এবং আধা-বিচারিক কমিটিগুলো পর্যন্ত রাজনৈতিক লেজুড়ভিত্তিতে চলে সে দেশে পুলিশ কমিশনকে কীভাবে স্বাধীন রাখা যাবে, সেটি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে পুলিশ বরাবরের মতই রাজনীতির পাগলা ঘোড়া হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আবার রিপোর্টে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে যেগুলো খুবই অস্পষ্ট। যেমন পুলিশের পদায়ন ও পদোন্নতির জন্য সততা ও নিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। অথচ এসবের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়নি। এই অস্পষ্টতা নতুন করে দুর্নীতির পথ খুলে দিতে পারে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, রাষ্ট্রের সামর্থ্যসহ অনেক কিছু বিবেচনা করলে আটক বা গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ বিষয়ে সুপারিশকৃত অনেক পয়েন্ট ভবিষ্যতে নতুন করে সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আদালতের আদেশ ছাড়া এফআইআর–বহির্ভূত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রে আদেশের জন্য অপেক্ষা করলে অভিযুক্ত যদি পালিয়ে যায়, তাহলে সামাজিক মাধ্যমে পুলিশের কনভিকশন দিতে দেরি করবে না আমজনতা। তবে পুলিশের প্রশিক্ষণ, কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট রাখা, অতিরিক্ত ডিউটির জন্য প্রণোদনা, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টে করার সুপারিশগুলো পুলিশের পেশাদারিত্ব বাড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু থানায় যে নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে সেটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক নিরাপত্তা কমিটি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিতর্ক ও প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। সমালোচকদের ভাষ্য হলো, কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তার অধিকাংশই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এই সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে দুই শতাধিক সুপারিশ করা হয়েছে। যার মধ্যে পুরনো চারটি বিভাগ নিয়ে আলাদা চারটি প্রদেশ এবং ঢাকা ও আশপাশের এলাকা নিয়ে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট বা রাজধানী মহানগর সরকার' করতে বলেছে কমিশন। কিন্তু এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে প্রাদেশিক পরিষদ, অফিস-আদালতসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে অর্থনৈতিক সামর্থ্য দরকার, তা বাংলাদেশের আদৌ আছে কিনা সে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। ক্যাডারগুলো ভেঙে ছোট ছোট করার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সেটি জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে ঢুকতে (এসইএস) উপসচিব পদে প্রশাসন ৫০ এবং অন্য ক্যাডার ৫০ পদোন্নতির যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেটির কোনো ব্যাখ্যা কমিশনের রিপোর্টে নেই। আবার একজন সরকারি চাকুরে ১৫ বছর চাকরি করার পর সব সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারার যে সুপারিশ করা হয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের মতো গরীব দেশের অর্থ অপচয়ের নতুন সুযোগ তৈরি করবে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টটি মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তবে এই কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যেমন হাইকোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স ৭০ করার প্রস্তাবটি বাংলাদেশের মত দেশের জন্য যেখানে বেকারত্বের হার অনেক বেশি সেখানে এটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার বিভাগীয় পর্যায়ে হাই কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করার প্রস্তাবটি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে যেতে পারে। কারণ এ ধরনের প্রস্তাব এরই মধ্যে আদালত একবার বাতিল করে দিয়েছিল।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন মোট ১৬টি অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে দুই শতাধিক সুপারিশ দিয়েছে। নির্বাচনি ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য বেশ কিছু কার্যকরী প্রস্তাব এই কমিশনের সুপারিশে তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনার সুপারিশটি বাস্তবায়িত হলে রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহিতার সুযোগ অনেক বেড়ে যাবে। তবে এই কমিশন এমন কিছু সুপারিশ করেছে যেগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতায় মনে হতে পারে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যেমন, বিচারিক আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার দিন থেকেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণার সুপারিশ করেছে এই কমিশন। এটি সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক। নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা সংবিধানের মাধ্যম নির্ধারিত হওয়ার কথা। আবার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন কেন গণভোটের সুপারিশ করবে সেটি কোনোভাবে বোধগম্য নয়। এই কমিশনের কোনো কোনো সুপারিশ দেখে মনে হতে পারে, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন, সুপারিশ করা হয়েছে, বেসরকারি সংস্থার কার্যনির্বাহী পদে আসীন ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ওই পদ থেকে তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ সংক্রান্ত আরপিও ধারা বাতিল করা। আবার নারীদের ঘুর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের যে প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে সেটি অযৌক্তিকই শুধু নয়, অবৈজ্ঞানিকও বটে।

পাঁচ খণ্ডের বিশাল সুপারিশ দিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশন সাতটি মূল সুপারিশ করেছে। কমিশন সংবিধানের ৭(ক), ৭(খ), ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪১(খ), ১৪১(গ) ও ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বিলুপ্তি এবং এই সংশ্লিষ্ট পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফশিল সংবিধানে না রাখার সুপারিশ করেছে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০। নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে, সরাসরি ভোটে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারাও নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। এর মধ্যে ১০০ জন নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক পদ্ধতিতে। এই আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের প্রস্তাবটি এরই মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করেছে। অনেকের অভিযোগ, কিছু ক্ষয়িষ্ণু এবং কম জনপ্রিয় দলকে বিশেষ সুবিধা দিতে এ ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ' করার সুপারিশ জমা দিয়েছে কমিশন। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক' ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ' শব্দগুলো থাকছে। সেক্ষেত্রে ‘পিপলস রিপাবলিক'-এর বাংলা ‘‘জনগণতন্ত্রী' কীভাবে হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। সংবিধান সংস্কার কমিটি ‘রিপাবলিকের' বাংলা করতে চায় ‘নাগরিকতন্ত্র'। তাহলে সে হিসেবে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ' নাম হতে হবে ‘জননাগরিকতন্ত্রী বাংলাদেশ'। আরো কিছু অদ্ভুত জটিলতা আছে এই সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে। যেমন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার স্পিকার এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যেসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সেগুলো অনাবশ্যক জটিলতা ও সমস্যা তৈরি করবে। বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি রয়েছে সেগুলো হলো, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতির মধ্যে শুধু গণতন্ত্রকে প্রস্তাবিত নতুন পাঁচ মূলনীতির একটি হিসেবে রাখা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ করা নতুন পাঁচটি মূলনীতি হলো, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। আগের চারটির চেয়ে এই পাঁচটির মধ্যে কী এমন তুমুল পার্থক্য তা কমিশনের বিশাল ৫টি খণ্ড পড়ে বুঝা দায়। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে দেয়ার প্রস্তাবটি। তার চেয়ে হাস্যকর মনে হতে পারে বাহাত্তরের সংবিধানকে ফ্যাসিবাদের বীজ হিসেবে আখ্যায়িত করা। অতীতের সবকিছু খারাপ, আমি যা করবো তা সবই ভালো – এমন ধারণা নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়।

ছয়টির মধ্যে বেশিরভাগ সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট কিছু সাধারণ (কমন) দোষে দুষ্ট। প্রথমত, প্রায় সবগুলো সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের শাসনামলের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার প্রতিবেদনে সবশেষ আওয়াম লীগ সরকারকে চৌর্যতান্ত্রিক (ক্লেপ্টোক্রেটিক) সরকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে এমন কোনো সরকার পাওয়া যাবে যার আমলে চৌর্যতান্ত্রিকতার চর্চা হয়নি। আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে চৌর্যতান্ত্রিকতা নতুন নতুন মডেল আবিষ্কৃত ও চর্চিত হয়েছে বটে, কিন্তু অতীতেও এ ধরনের চর্চা ছিল। সেদিক থেকে অতীতে মডেলগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে না নিলে ভবিষ্যতের জন্য সংস্কারের একটি সামগ্রিক রূপরেখা পাওয়া নাও যেতে পারে। ড. ইউনূসের সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টগুলোর এটি বড় একটি দুর্বলতা। বাংলাদেশে যতবারই রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে ততবরাই অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার নতুন নতুন মডেলের প্রয়োগ ঘটেছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের কোনো সরকারের আমলকে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের দোষে দুষ্ট না করে উপায় নেই। একইভাবে নির্বাচন কমিশন সংষ্কার প্রস্তাবেও বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ ও পাতানো নির্বাচন বলতে বিগত তিনটি নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে ১২টি। তার মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে ৪টি। অন্য আটটি নির্বাচন হয়েছে রাজনৈতিক সরকারের অধনে। এই আটটি নির্বাচনই কোনো না কোনো মাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য। প্রকৃত অর্থে এগুলোতে জনগণ তাদের মতের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। সেখানে শুধু তিনটি নির্বাচনের কথা তুলে ধরার অর্থ হলো সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের যাত্রাই শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের পর থেকে।

আরেকটি দুর্বলতা হলো, কয়েকটি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট দেখে মনে হতে পারে, কিছু কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করার চেয়ে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের আলোচনার ভিত্তিতে রিপোর্টগুলো তৈরি করেছে। যেমন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা চালু করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা এবং এই ব্যবস্থা কেমন হবে এগুলো সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাজ। কিন্তু নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের রিপোর্টেও আমরা একই ধরনের প্রস্তাব দেখতে পায়। নির্দিষ্ট আওতার বাইরে গিয়ে অন্য কমিশনের একই ধরনের সুপারিশ করার এই প্রবণতা দেখে মনে হতে পারে, সরকার গঠিত কমিশনগুলো সরকারের চাওয়াকে রি-ইনফোর্সিং করছে। যা আসলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ব্যবস্থার সংস্কারের চেয়ে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের ইচ্ছেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। যেমন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুইবার করা ইত্যাদি প্রস্তাবগুলো কোনোভাবেই নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে থাকার কথা নয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের যথার্থতা বোঝানোর জন্য অনাবশ্যকভাবে তা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনে তুলে ধরা হয়েছে।

আবার কোনো কোনো সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের কিছু অংশ দেখলে মনে হতে একটি কমিশন যেটিকে অসম্ভব মনে করছে অন্য কমিশন সেটি বাস্তবায়নের সুপারিশ করছে। যেমন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার রিপোর্টের ৬ নম্বর সুপারিশে বলা হয়েছে, নির্বাচনি আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। অথচ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে, নির্বাচনি ব্যয়ের যেসব চোরা পদ্ধতি আছে সেগুলো ঠেকানো প্রায় অসম্ভব।

অনেক কমিশনই নিজেদের কর্মপরিধির বাইরে বেশ কিছু প্রস্তাব করেছে, যেগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে সমালোচনা হচ্ছে। যেমন, জেলা পরিষদ বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। অথচ এই বিষয়টি হলো স্থানীয় সরকারের বিষয়। আবার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন দাবি করেছে, তারা নির্বাচন কমিশনের আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে, যেটিকে কমিশন সমন্বিত আইন বলে দাবি করেছে। কিন্তু কমিশনের যে কার্যপরিধি ঠিক করে দেয়া হয়েছিল সেখানে কোথাও আইন প্রণয়নের কথা বলা নেই। আবার এই কমিশনের যে আটজন সদস্য তাদের কেউই আইন বিশেষজ্ঞ নন। অন্যদিকে কমিশন নিজেই জমা দেয়া রিপোর্টে বলেছে, বর্তমানে নির্বাচনী আইনকানুন পরিবর্তনের জন্য নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। নির্বাচন কমিশন আইন পরিবর্তন স্পিকারের নেতৃত্বে সংসদের উচ্চকক্ষের একটি সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে হওয়া উচিত। আইনের খসড়া তৈরি করার মধ্য দিয়ে কমিশনের প্রস্তাব প্রকান্তারে নিজেই লঙ্ঘন করলো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।সমালোচনা যা-ই থাকুক, সংস্কার যে প্রয়োজন সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু যেটি সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেটি হলো রাজনৈতিক ইচ্ছা। অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এই সঙ্কট আরো বাড়তে পারে। যদি তা হয় তাহলে সংস্কার কমিটিগুলোর সুপারিশ হবে ‘গ্রন্থগত বিদ্যা পরহস্তে ধনের' মতো।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ