সংরক্ষিত অরণ্যে থাকেন বিস্মৃত সব উপজাতির নানা মানুষ, জঙ্গলই যাদের জীবন৷ তাদের জঙ্গলে রাখাটা যেমন সমস্যাকর, তেমনই সমস্যাকর তাদের স্থানান্তর করা৷ ইথিওপিয়া একটি সমাধানসূত্র দেখাচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ইথিওপিয়ায় বন সংরক্ষণের আরেক উপায়
05:39
দক্ষিণ-পশ্চিম ইথিওপিয়ার শেকা অরণ্য৷ প্রায় ২৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই বনানীকে ইথিওপিয়ার ‘ফুসফুস' বলা হয়ে থাকে৷ বহু বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির গাছপালা ও পশুপাখির আশ্রয় এই অরণ্য৷ একটি ‘কোর এরিয়া' আছে, যা পুরোপুরি সংরক্ষিত৷ এছাড়া আছে উন্নয়নের জন্য চিহ্নিত এলাকা৷
মাশা সেই ধরনের একটি এলাকা৷ প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের বাস এখানে৷ গোটা শেকা অরণ্য ইউনেস্কোর বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের মধ্যে পড়ে৷ তার মধ্যে অর্ধেক হলো বিকাশের এলাকা, যেখানে টেকসইভাবে চাষবাস ও বসবাস করা চলে৷ ওদিকে আরো বেশি চাষবাস মানে আরো কম বনজঙ্গল৷ আসেসো উপজাতির প্রধান ডাকিটো আটেস্টা বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন গাঁয়ের বাসিন্দা ও সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করি৷ এভাবে আমরা অরণ্য সংরক্ষণের চেষ্টা করি৷''
গাছ কাটার বিকল্প
মৌমাছি পোষা সেই ধরনের একটি বিকল্প প্রকল্প৷ ইথিওপিয়ার ‘মেল্কা' নামের একটি এনজিও এই মৌমাছি পোষার বাক্সগুলো দিয়েছে৷ ‘মেল্কা' টাকা পায় আন্তর্জাতিক জলবায়ু সুরক্ষা উদ্যোগ থেকে৷ ‘মেল্কা' ত্রাণ সংস্থার আডুগ্না শাভেনো বলেন: ‘‘এই পন্থায় বিভিন্ন গোষ্ঠী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে একসঙ্গে কাজ করছে৷ তার সুবিধেটা কোথায়? ওরা যদি সকলে একসঙ্গে এই আধুনিক মৌচাকগুলোর দেখাশুনো করে, তাহলে গাছ কাটা কমবে৷'' মৌচাষি আয়েলে আলেমায়েহু বলেন, ‘‘মধু বিক্রি করে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়, স্কুলের বইখাতা কিনে দিতে পারি৷ আমরা কর দিই, নিজেদের বাড়িঘর বানাই৷''
আদিবাসীদের কথা
জাতিসংঘের হিসেবে বিশ্বে প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী রয়েছে৷ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ শতাংশই এই গোষ্ঠীর অন্তর্গত৷ ছবিঘরে থাকছে কয়েকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কথা৷
ছবি: picture-alliance/Sandra Gätke
কায়াপো
ব্রাজিলের কায়াপো গোষ্ঠীর এই সদস্যকে দেখলে মনে হতে পারে তাঁরা বোধ হয় অনেক আধুনিক৷ কিন্তু না৷ আসলে তাঁদের অবস্থান বিশ্বের অন্যতম অরক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিতদের দলে৷
ছবি: AP
ইনুইট
ছবিতে গ্রিনল্যান্ডের ইনুইট-দের একজনকে দেখা যাচ্ছে৷ মেক্সিকো ও মধ্য অ্যামেরিকার মায়া গোষ্ঠী থেকে শুরু করে আফ্রিকা কিংবা উপমহাদেশ, প্রায় সব জায়গায় আদিবাসীদের বাস৷ জানা গেছে, ৯০টি দেশে প্রায় পাঁচ হাজার আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে৷
ছবি: Getty Images
ব্যারব্যার
মরক্কোর ব্যারব্যার বা বর্বর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এঁরা৷ উত্তর আফ্রিকার প্রায় নয়টি দেশে এই আদিবাসীদের বাস৷ তাঁদের অনেকেই ‘তামাঝিঘট’ ভাষায় কথা বলেন যেটা আফ্রো-এশিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্গত এবং প্রাচীন মিশরীয় ও ইথিওপীয় ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট৷ আরবি সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচাতে ব্যারব্যারদের অনেক লড়তে হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
ওয়াওরানি
ইকুয়েডরের অ্যামাজন রেনফরেস্ট এলাকায় ওয়াওরানিদের বসবাস৷ সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের একটা অংশ ‘ইয়াসুনি ন্যাশনাল পার্ক’-এ নির্মিত ঘরবাড়িতে বসবাস শুরু করেছে৷ তবে আরেকটা অংশ এখনও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী নয়৷ এর চেয়ে বানর আর পাখি শিকার করে জীবন কাটাতেই পছন্দ করছেন তাঁরা৷
ছবি: AP
ডংগ্রিয়া কোধ
ভারতের ওড়িশার এই আদিবাসীরা সম্প্রতি ব্রিটিশ এক কোম্পানির প্রস্তাবিত খননকাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন রুখে দিয়েছে৷ এই খননকাজে নিজেদের পবিত্র পাহাড় কাটা পড়ার বাস্তবতা তাঁরা মেনে নেননি৷ তবে বিশ্বের অন্য সব আদিবাসীদের পক্ষে যে এভাবে উন্নয়নের নামে এমন সব প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হয়েছে তা নয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বরং উল্টোটাই হয়েছে৷
ছবি: Survival International
শিক্ষার অভাব
আদিবাসী নারী ও মেয়েরা অনেকসময় গুণগত শিক্ষা পায় না৷ তবে পেরুর কুসকো অঞ্চলের আদিবাসীদের শিক্ষা দিতে ‘প্ল্যান’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে৷ সংস্থাটি আদিবাসীদের শিক্ষা কার্যক্রমে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করছে৷
ছবি: picture-alliance/Sandra Gätke
6 ছবি1 | 6
চা'বাগান৷ আগে এজন্য অনেকটা জঙ্গল পুড়িয়ে কিংবা কেটে সাফ করা হতো৷ আজ আর তার অনুমতি পাওয়া যায় না৷ তা সত্ত্বেও আপোশ করার প্রয়োজন পড়ে৷ এক সৌদি বিনিয়োগকারীর এই কফি প্ল্যান্টেশনটি প্রায় দশ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে৷ মাঝখানে একটা আস্ত শহর গজিয়ে উঠেছে৷ মানুষজন এখানে কাজ পায়, যেমন ২১ বছর বয়সি মেসার্ট৷ তার রোজগার মাসে চল্লিশ ইউরো, যা কিনা ইথিওপিয়ার গড় আয় বলা চলে৷
কফিচাষের জন্য ছায়া লাগে, কাজেই গাছ না কাটাই ভালো৷ এ সবই টেকসই ও পরিবেশসম্মত পন্থা, বলেন কফিবাগানের কর্মকর্তা ও অরণ্য সংরক্ষণ বিভাগের প্রতিনিধিরা৷ কিন্তু এখানেও ‘মানিয়ে-গুছিয়ে' নিতে হয়৷ শেকা কৃষি বিভাগের আতানাফু দেগফে বলেন, ‘‘ছায়া বেশি হলে তা যদি কফি ফসলের ওপর প্রভাব ফেলে, তাহলে কিছু কিছু গাছ কাটতে হবে৷ তাতে উৎপাদন বাড়ে, আবার পরিবেশেরও উপকার হয়৷''
বৃক্ষদেবতা
একটি গাছের নাম ‘লুলে' গাছ৷ এই গাছটি বিপন্ন প্রজাতিগুলির তালিকায় পড়ে৷ লুলে গাছটি খাড়া গোষ্ঠীপতি ডাকিটো আটেস্টা-র নিজের বাগানে৷ তাঁকে সম্মান করে চলতে হয়৷ অরণ্য সংরক্ষণ কাজ করে সামাজিক নিয়মকানুনের মাধ্যমে৷ বিনা অনুমতিতে গাছ কাটলে তার সাজা হল, একটি আস্ত ষাঁড় দিতে হবে৷ লুলে গাছ আবার পবিত্রও বটে৷ কাজেই এই গাছ কাটা চলবে না৷
আসেসো প্রধান ডাকিটো আটেস্টা বলেন, ‘‘আমাদের এই পবিত্র স্থানগুলো বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসছে৷ আমাদের পিতৃপুরুষেরা এগুলো খুঁজে বার করেছেন৷ আমরা ওখানে গিয়ে বৃষ্টির জন্য, ভালো ফসলের জন্য প্রার্থনা করি৷ এসব জায়গায় দেবতারা আমাদের প্রার্থনা শোনেন৷''
ইথিওপিয়ায় বন সংরক্ষণের আরেক উপায়
05:39
This browser does not support the video element.
জঙ্গলই জীবন
এটা জঙ্গলের ‘কোর এরিয়া' – এখানে কোনো কিছু করা নিষেধ৷ কিন্তু চুরি করে কাঠ কাটলে দু'চার পয়সা বাড়তি রোজগার করা যায়৷ কাঠ কাটতে হয়, কেননা মরা গাছ বা ঝড়তি-পড়তি ডালপালা দিয়ে রান্নার কাজ চলে না৷
মেঞ্জা উপজাতির মানুষরা জঙ্গলে বাস করেন আর বাঁদরের মাংস খান বলে লোকে এদের নীচু নজরে দেখে৷ কিন্তু মেঞ্জাদেরও বন কেটে চাষের জমি করার অধিকার নেই৷ তাই এরা গাছ পুড়িয়ে কাঠকয়লা তৈরি করেন৷ এখানেও ‘মেল্কা' ত্রাণ সংস্থা একটি বিকল্পের ব্যবস্থা করেছে৷ তারা মেঞ্জাদের ষাঁড় কিনে দেয়৷ সেই ষাঁড় বড় হলে, তাকে বেচে আরো নতুন ষাঁড় কেনেন মেঞ্জারা৷
শেকা-র মানুষেরা জঙ্গলে থাকেন, জঙ্গল থেকেই তাদের দিন চলে৷ জঙ্গল না বাঁচলে তাঁরাও বাঁচবেন না৷ ডাকিটো আটেস্টা বলেন, ‘‘আমাদের পবিত্র স্থানগুলো যদি ধ্বংস করা হয়, গাছ কেটে ফেলা হয়, তাহলে মানুষও আর বেঁচে থাকতে পারবে না৷ বৃষ্টি ছাড়া ফসল হবে না৷ সেটাই হবে অন্তের সূচনা৷''
কাজেই শেকা-র মানুষদের আশা, জঙ্গল যেন আরো বহুদিন, বহু বছর ধরে বেঁচে থাকে৷
কী নেই ভিরুঙ্গা পার্কে!
আফ্রিকার দেশ ডিআর কঙ্গোর ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কে কী নেই? সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন, সাভানা আর বরফে আচ্ছাদিত পর্বতমালা, গোরিলা, বিভিন্ন জাতের পাখি, উদ্ভিদ – আছে সবই৷ কিন্তু তারপরও যেন কী নেই?
ছবি: WWF/Brent Stirton
বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ
সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন, সাভানা আর বরফে আচ্ছাদিত পর্বতমালা সমৃদ্ধ আফ্রিকার দেশ ডিআর কঙ্গোর ‘ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক’৷ তাই ইউনেস্কো ১৯৭৯ সালে এই পার্কের নাম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে৷ এর আগে ১৯২৫ সালে তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসক বেলজিয়াম ভিরুঙ্গাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছিল৷
ছবি: WWF/Brent Stirton
বিভিন্ন জাতের পাখি ও উদ্ভিদ
ভিরুঙ্গা পার্কে প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখি ও দুই হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে৷ পাশের গোমা শহরের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করতে গিয়ে প্রতি বছর পার্কের বনাঞ্চলের একটা বড় অংশ হারিয়ে যাচ্ছে৷ জঙ্গিরাও এই বনের কাঠ কেটে বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে অস্ত্র কিনে থাকে৷
ছবি: WWF/Brent Stirton
গোরিলার বাস
ভিরুঙ্গা পার্কের অন্যতম বাসিন্দা প্রায় ২০০ গোরিলা৷ ইউনেস্কোর এই পার্ককে স্বীকৃতি দেয়ার পেছনে বিলুপ্ত হতে থাকা এই প্রাণীর অবস্থানও একটা কারণ৷
ছবি: WWF/Brent Stirton
তেল অনুসন্ধান নয়
লন্ডন-ভিত্তিক একটি কোম্পানি ‘সোকো ইন্টারন্যাশনাল’ ভিরুঙ্গা পার্কে তেল অনুসন্ধান করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ বা ডাব্লিউডাব্লিউএফ এর প্রতিবাদ জানালে সেই পরিকল্পনা বাদ হয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অনুসন্ধানে যে বিপদ হতে পারতো
তেল অনুসন্ধানের অনুমতি দিলে ভিরুঙ্গা পার্কের এডওয়ার্ড লেকের পানি দূষিত হয়ে পড়তো৷ এতে ঐ লেকের ধারে বাস করা প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের সমস্যা হতো৷ কারণ তাঁরা পানি পান ও রান্নার কাজের প্রয়োজনীয় পানি ঐ লেক থেকেই সংগ্রহ করে থাকেন৷ এছাড়া লেকে থাকা মাছগুলোও মরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল৷ এই মাছ ঐ পরিবারগুলোর আয়ের একটা বড় উৎস৷
ছবি: WWF/Brent Stirton
যুদ্ধ থেকে পালিয়ে
মহিলারা পার্কের একটি স্থানীয় বাজারে শুঁটকি বিক্রি করছেন৷ ডিআর কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী সক্রিয় থাকায় ভয়ে সেখান থেকে অনেক মানুষ পালিয়ে এই পার্কে অবস্থান নিয়েছে৷ অবশ্য এই পার্কেরও একটা অংশে এক সময় অনেক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: WWF/Brent Stirton
লোকদের বোঝাতে হবে
পার্কের ডিরেক্টর ইমানুয়েল দ্য মেরোড বলেন, ‘‘ভিরুঙ্গাকে বাঁচাতে হলে আমাদের মানুষদের বোঝাতে হবে যে বন সংরক্ষণের একটা আর্থিক দিক রয়েছে৷’’
ছবি: Getty Images
সংরক্ষণের আর্থিক দিক
ডাব্লিউডাব্লিউএফ বলছে ভিরুঙ্গা পার্ককে ঘিরে প্রায় ৪৫ হাজার চাকরি সৃষ্টি করা যেতে পারে৷ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, মৎস্য উৎপাদন, ইকো ট্যুরিজম, গবেষণা, শিক্ষা – এ সব খাতে এই চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব৷ ঠিকমতো পরিকল্পনা করলে এই পার্ক থেকে বছরে প্রায় দশ লক্ষ ইউরো আয় করা সম্ভব৷