বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার আট বছর পূর্ণ হল৷ এই আট বছরে ২৭টি জঙ্গিবিরোধী বড় অপারেশন চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ এতে ৭৩ শীর্ষ জঙ্গি নিহত হয়েছে৷ তবুও থেমে নেই জঙ্গিদের কার্যক্রম৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্লেষকেরা বলছেন, হামলার মতো বড় অপারেশন চালানোর সক্ষমতা হয়তো নেই, তবে তাদের কার্যক্রমও থেমে নেই৷ সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি চলছে অনলাইন কার্যক্রম৷
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জঙ্গিদের বড় ধরনের অপারেশনের সক্ষমতা হয়ত নেই৷ কিন্তু তাদের কার্যক্রমও কিন্তু থেমে নেই৷ আমরা সাধারণত জঙ্গি বিষয়টি বলতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকে বুঝি৷ অথচ জঙ্গিদের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পার্ট অত্যন্ত সামান্য৷ যাদের মস্তিষ্কে এটা ঢুকে গেছে, তাদের তো আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিছু করতে পারবে না৷ সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না৷ এখানে আমাদের কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে৷
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ নিহত হন মোট ২২ জন৷ তাদের মধ্যে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা৷ জঙ্গিদের গুলি ও বোমায় আহত হন পুলিশের অনেকে৷ কয়েকবার প্রস্তুতি নেওয়া সত্ত্বেও স্পর্শকাতর বিবেচনায় রাতে হোলি আর্টিজানে অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোদের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার, নিহত হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি৷
জঙ্গিদের তৎপরতা প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেটা আমি বলব না৷ তবে, নিয়ন্ত্রণে আছে৷ জঙ্গিবাদের সুপ্ত বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে৷ আমরাও কিন্তু বসে নেই৷ আমরা আমাদের কাজটা করে যাচ্ছি৷’’
এর আগে শনিবার সকালে গুলশানে হোলি আর্টিজান জঙ্গি হামলায় শহীদ দুই পুলিশ সদস্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের কমিশনার বলেন, ‘‘দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতে বিভিন্ন জঙ্গি হামলা ঘটানো হয়৷ হোলি আর্টিজান হামলার পর আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে থাকে৷ তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুলিশ ও জনগণ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়৷ সব উন্নয়ন সহযোগীদের স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়, বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিদের উৎখাত করব, আপনারা ফিরে আসেন৷ তারপর আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা দেশে ফিরে আসেন এবং আমাদের উন্নয়ন যাত্রা অব্যাহত রয়েছে৷ এরপর থেকে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করা, গ্রেফতার ও বিচারে সোপর্দ করা অব্যাহত ছিল৷ যারাফলে সমগ্র বাংলাদেশে জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আছে৷’’
জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে না গেলেও নিয়ন্ত্রণে আছে
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামানও বলেন, ‘‘বর্তমানে দেশে জঙ্গিদের ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিস করার কোনো সামর্থ্য নেই৷ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সুযোগ তারাও নিয়েছে৷ সাইবার স্পেসে তাদের প্রচার-প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু সিটিটিসির তৎপরতার কারণে তারা ফিজিক্যালি তাদের কার্যক্রম চালাতে পারছে না৷ ২৪/৭ ঘণ্টা সাইবার স্পেসে আমাদের পেট্টোলিং চলছে৷ এমন অনেককে আমরা শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি৷’’
নিহতদের প্রতি বিভিন্ন দূতাবাসের শ্রদ্ধা
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে সকালে নিহত ব্যক্তিদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তারা৷ শনিবার সকালে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর প্লটের ওই ভবনের সামনে অস্থায়ী বেদিতে প্রথমেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা৷ এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতোনাওকি৷ এ ছাড়া ইটালি ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান৷ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল ১০টার দিকে হোলি আর্টিজানের মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
হোলি আর্টিজান হামলার টাইমলাইন
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় পাঁচ জঙ্গিসহ ২৯ জন নিহত হয়৷ হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
হামলা শুরু
২০১৬ সালের ১ জুলাই শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে ঢাকার গুলশান দুই-এর ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর বাড়ির হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
হামলাকারী
সরাসরি হামলায় অংশ নেন পাঁচজন৷ তারা হলেন: রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ৷ শনিবার সকালে সেনা কমান্ডো অভিযানে তারা সবাই নিহত হন৷ ছবিতে হামলাকারী নিবরাস ইসলামকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Courtesy SITE Intel Group
নিহত
মোট ২৯ জন প্রাণ হারান৷ এর মধ্যে পাঁচ জঙ্গিসহ এক রেস্তোরাঁ কর্মী ও একজন শেফ কমান্ডো অভিযানে নিহত হন৷ বাকি ২২ জনের মধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রাণ হারান দুই পুলিশ৷ তাঁরা হলেন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানীর ওসি মো. সালাহউদ্দিন খান৷ বাকি ২০ জনের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি, নয়জন ইটালীয়, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয়৷ নিহত বাংলাদেশিরা হলেন ইশরাত আকন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও অবিন্তা কবীর৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
কমান্ডো অভিযান
২ জুলাই শনিবার সকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান চালান৷ এতে পাঁচ জঙ্গিসহ সাতজন নিহত হন৷ অভিযান শেষে নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
মামলা দায়ের
২০১৬ সালের ২ জুলাই সন্ত্রাস দমন আইনে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেন গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস৷
ছবি: Reuters/M. Hossain Opu
চার্জশিট
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়৷ তদন্তে হামলায় ২১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে ১৩ জন কমান্ডো অভিযান ও পরবর্তীতে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন৷ সে কারণে ওই ১৩ জনকে বাদ দিয়ে আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/abaca
যাদের আসামি করা হয়নি
জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে (ছবি) গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পরে আসামি করা হয়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Asad
জঙ্গিবিরোধী অভিযান
বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত আটজন হলেন: তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান, তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ, নুরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকোলেট, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও রায়হান কবির ওরফে তারেক৷
ছবি: DW/ISPR
বিচারকাজ শুরু
চাজশিট দেয়ার প্রায় চার মাস পর ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করে৷ আদালত ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে ২৭ নভেম্বর রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
রায়
বিচার শুরুর এক বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর আট আসামির মধ্যে সাত জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ তারা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগান, মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ৷ মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেয়া হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
স্বীকারোক্তি
ছয় আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন৷ মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মামুনুর রশিদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদ জবানবন্দি দেননি৷
ছবি: bdnews24.com
11 ছবি1 | 11
ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষ হতে পারে এ বছরই
সেই হামলা-হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে বিচারিক (নিম্ন) আদালতে সাত জঙ্গির ফাঁসির রায় হয়৷ এ মামলার বিচার শুরুর সময় আট আসামির ছয়জন কারাগারে ছিলেন৷ বিচার চলাকালে বাকি দুইজন গ্রেপ্তার হন৷ পরে রায়ে মামলার আট আসামির সাত জনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত৷ ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এ রায় দেন৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন: জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন৷
এরপর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়েছে৷ ঘটনার সাত বছরের মাথায় আলোচিত সন্ত্রাসী হামলার নৃশংস ঘটনায় দ্বিতীয় ধাপের বিচারের অপেক্ষায় পুরো জাতি৷ হাইকোর্টের বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে আলোচিত এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি হচ্ছে৷ গত জানুয়ারিতে মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে৷ এরপর গত মে মাসে ৪ দিন শুনানি হয়৷ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যেহেতু মামলাটির শুনানি শুরু হয়েছে, ফলে চলতি বছরেই হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় আলোচিত মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) এবং আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শেষ হতে পারে৷
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, ‘‘হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়েছে৷ কিন্তু বেঞ্চের এক বিচারক হজে যাওয়াই শুনানি মুলতবি রয়েছে৷ তিনি ফিরে আসলে জুলাইয়ে আবারও শুনানি হবে৷ আমি মনে করি জুলাই মাসের শেষ দিকে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় আলোচিত মামলায় ডেথ রেফারেন্স এবং আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শেষ হতে পারে৷ আশা করছি, দণ্ডিত আসামিদের সাজা যেন বহাল থাকে৷ যেহেতু মামলাটি দেশে এবং বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, ফলে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে বিশ্ববাসী দেখবে জঘন্য এ হত্যাকাণ্ডের বিচার৷’’
হোলি আর্টিজানের পর ২৭ অপারেশনে ৭৩ জঙ্গি নিহত
২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান হামলার পর কল্যাণপুর, নায়াণগঞ্জ, গাজীপুরে ২৭টি অপারেশন পরিচালনা করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও র্যাব৷ এসব অভিযানে ৭৩ জন জঙ্গি নিহত হয়৷
জঙ্গিদের অপারেশনের সক্ষমতা না থাকলেও কার্যক্রম থেমে নেই
সিটিটিসির তদন্ত শেষ করা দুটি মামলায় রায় হয়েছে৷ যেখানে ১২ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সিটিটিসির অভিযানগুলোর জন্য জঙ্গিদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে৷ হোলি আর্টিজানে নৃশংস হামলার পর গত সাত বছরে সিটিটিসি একের পর এক সফল অভিযানের মাধ্যমে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে প্রতিহত করেছে৷ আমাদের ২৩টি হাই-রিস্ক অপারেশনে ৬৩ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়৷ অন্যদিকে র্যাবের চারটি অপারেশনে ১০ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে৷
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দৃশ্যত আমরা জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি৷ কিন্তু তাদের কার্যক্রম যে থেমে নেই সেটা তো আমরা সবাই জানি৷ এখন তারা অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে৷ তাদের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমও চলছে৷ মানুষকে মোটিভেট করার কার্যক্রম তারা চালাচ্ছে৷ ফলে অপারেশনের পাশাপাশি এই দিকে আমাদের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে৷’’
আলোচিত কয়েকটি জঙ্গি হামলা
১৯৯৯ সালে উদীচী দিয়ে শুরু৷ এরপর বেশ কয়েকটি আলোচিত হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথা৷
ছবি: bdnews24.com
উদীচীর সমাবেশে হামলা
১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়েছিলেন৷ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে৷ হরকাতুল জিহাদ (হুজি) উদীচীর সমাবেশে হামলা করেছিল বলে পুলিশের ঐ ইউনিট জানিয়েছে৷ উপরের ছবিটি প্রতীকী৷
ছবি: bdnews24.com
বাংলা বর্ষবরণে হামলা
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন৷ এই ঘটনায় শতাধিক আহতের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন৷ এই হামলার মধ্য দিয়ে হুজি তাদের শক্ত অবস্থানের জানান দিয়েছিল৷ হামলার দায়ে ২০১৪ সালে হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২৫ মে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল৷ এতে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হয়েছিলেন৷ আনোয়ার চৌধুরীসহ অর্ধশত মানুষ আহত হন৷ হামলার দায়ে ২০০৮ সালে হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ (ছবি) তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১৭ সালের এপ্রিলে মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: A.M. Ahad/AP/picture alliance
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন প্রাণ হারান৷ ২০১৮ সালে মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়৷ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের জঙ্গিরা হামলায় অংশ নেয়৷ তবে ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তখনকার জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
৬৩ জেলায় বোমা হামলা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷ এই হামলায় দুজন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হয়েছিলেন৷
ছবি: DW/H. U.R.Swapan
ব্লগার হত্যা
জঙ্গি হামলায় বেশ কয়েকজন ব্লগার ও মুক্তমনা নিহত হয়েছেন৷ ২০১৩ সালে আহমেদ রাজিব হায়দার হত্যা দিয়ে শুরু৷ এরপর ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন হত্যার শিকার হন৷ ২০২১ সালে অভিজিৎ হত্যার মামলার রায়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷ তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷
ছবি: Robert Richter
হোসেনি দালানে হামলা
২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর আশুরা উপলক্ষ্যে হোসেনি দালানের শোক মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা৷ এ ঘটনায় একজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ চলতি বছরের মার্চে দেয়া রায়ে জেএমবির দুই সদস্যকে দশ ও সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
শিয়া মসজিদে হামলা
২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর বগুড়ার এক শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ হামলার প্রায় ১৪ মাস পর আদালতে দাখিল করা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল জেএমবি এবং ইসলামি ছাত্রশিবির হামলায় অংশ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোলি আর্টিজানে হামলা
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হন৷ পাঁচজন জঙ্গি অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে বেকারিতে ঢোকার পর সবাইকে জিম্মি করেন৷ এরপর পুলিশ ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশের দুই কর্মকর্তা জঙ্গিদের গুলি ও বোমার আঘাতে মারা যান৷ কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও জঙ্গিরা অন্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ জঙ্গিরা সবাই সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত হয়৷ ইসলামিক স্টেট এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷
ছবি: bdnews24.com
জাফর ইকবালের উপর হামলা
২০১৮ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক তরুণ ছুরি নিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায়৷ এই ঘটনায় এ বছরের এপ্রিলে ফয়জুল হাসান নামের একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ফয়জুল কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য কিনা তা প্রমাণিত হয়নি৷ তবে তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে জিহাদি প্রবন্ধ ও বই ডাউনলোড করে পড়ে, উগ্রবাদী বক্তাদের বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন৷