বাংলাদেশে একই দিনে জঙ্গিদের হাতে দু'জন নিহত হয়েছেন৷ তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করাকে জঙ্গিদের কৌশল পরিবর্তন বলে অপরাধ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন৷
বিজ্ঞাপন
রবিবার সকালে জঙ্গিরা চট্টগ্রামের পাঁচলাইসের জিইসি মোড় এলকায় গুলি করে হত্যা করে পুলিশ সুপার(এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে৷ মিতু তাঁর ছেলেকে স্কুলে দিতে গিয়ে জঙ্গিদের হামলার শিকার হন৷ তাঁর স্বামী এসপি বাবুল আক্তার জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আলোচিত এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ চট্টগ্রাম এলাকায় তাঁর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে অনেক জঙ্গি আস্তানা তছনছ হয়ে গেছে, আটক হয়েছে অনেক জঙ্গি৷
অন্যদিকে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় রবিবার দুপুরে সুনীল গোমেজ (৬০) নামের এক খ্রিষ্টান ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ আইএস এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে৷
মিতু হত্যাকান্ড সম্পর্কে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার মো. ইকবাল বাহার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘কে বা কারা কী জন্য এ খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তা জানার জন্য তদন্ত করা হচ্ছে৷ বাবুল আক্তার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন৷ এ কারণে জঙ্গিরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কিনা এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছি না৷ প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড৷''
জিয়া রহমান
মিতুকে অতীতের বেশ কিছু ঘটনার মতো মোটর সাইকেল আরোহীরাই হত্যা করেছে৷ এরইমধ্যে ওই এলাকার একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে তা স্পষ্ট হয়েছে৷ মোটর সাইকেলে মোট তিনজন আরোহী ছিলেন৷ পুলিশ সেই মটরসাইকেলটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছে৷
গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে একই স্টাইলে ৪৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ এতে নিহত হয়েছেন ৪৭ জন৷ এসব হামলার অনেকগুলোরই দায় স্বীকার করেছে আইএস ও আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের কথিত বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম৷
জঙ্গিরা এর আগে পুলিশ হত্যা করেছে৷ ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর ঢাকায় গাবতলিতে জঙ্গিরা পুলিশের চেকপোস্টে এক সাব-ইন্সপেক্টরকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় শিল্প পুলিশের এক কনস্টেবলকে৷ মিতুর হত্যাকারীরাও মোটর সাইকেলেই এসেছিল৷
পুলিশ পরিবারের সদস্যকে হত্যার ঘটনা এই প্রথম৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজেই বলেছেন, ‘‘অব্যাহতভাবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে, জঙ্গিদের দমন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের পুলিশ ফোর্স যেভাবে বীরত্বের সঙ্গে কাজ করছে, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য, এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে বলে আমরা মনে করছি৷''
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার পর এটা স্পষ্ট যে, জঙ্গিরা তাদের কৌশল পরিবর্তণ করছে৷ তারা ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন ধর্ম এবং বিদেশি হত্যার পর এখন পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য হত্যা করল৷ তারা আগে পুলিশ হত্যা করেছে, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের ওপর আঘাত এই প্রথম৷ তারা এখন পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যারা জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সক্রিয়, তাদের এভাবে দুর্বল করে দিতে চাইছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘জঙ্গিরা এর আগেও তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে এবং টার্গেট বিস্তৃত করেছে৷ এখন তারা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করেছে৷ এর মাধ্যমে তারা বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দিতে চায়৷''
অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান আরো বলেন, ‘‘আমার মনে হয়েছে, পুলিশই এখনো জঙ্গিদের ব্যাপারে সিরিয়াস নয়৷ এখন আসলেই সিরিয়াস হওয়ার সময় এসেছে৷''