বাংলাদেশে সংবাদ ও ব্লগভিত্তিক ৩৫টি ওয়েবসাইট ব্লক করে দিয়েছে সরকার৷ বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে এই পোর্টালগুলো বাংলাদেশে বন্ধ আছে৷ এরমধ্যে অন্তত ৩০টি নিউজ পোর্টাল৷
বিজ্ঞাপন
তবে বন্ধের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পোর্টাল কর্তৃপক্ষ ও গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা৷
জানা গেছে, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করে দিয়েছে৷ বৃহস্পতিবার রাতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা পাঠানোর পর আইআইজিগুলো (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) সাইট বন্ধ (ব্লক) করতে শুরু করে৷
আইআইজি প্রতিষ্ঠান ‘ফাইবার অ্যাট হোম'এর চিফ স্ট্র্যাটেজিক অফিসার সুমন আহমেদ সাবির সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘আমরা সাইটগুলো বন্ধের নির্দেশনা পেয়েছি৷ তবে কী কারণে বন্ধ করা হচ্ছে সে বিষয়ে ওই নির্দেশনায় কিছু উল্লেখ ছিল না৷''
একরামুল হক
বিটিআরসি থেকে পাঠানো নির্দেশনায় দেখা গেছে, বন্ধ হওয়া সাইটগুলো হলো- আরটিনিউজ২৪, হককথা, আমরাবিএনপি, রিয়েলটাইম নিউজ, বিনেশন২৪, নেশননিউজ বিডি, ভোরের আলাপ, বাংলাপোস্ট২৪, ডেইলিটাইমস২৪, মাইনিউজবিডি, লাইভখবর, আরআইখান, শীর্ষনিউজবিডি, নতুনেরডাক, সিলেটভয়েস২৪, সময়বাংলা, প্রথমনিউজ, বাংলালেটেস্টনিউজ২৪, নিউজডেইলি২৪বিডি, আমারদেশঅনলাইন, দৈনিক আমারদেশ, অন্যজগত২৪, আমারবাংলাদেশঅনলাইন, দেশ-বিডি ডট নেট, ক্রাইমবিডিনিউজ২৪, নতুনসকাল, শীর্ষখবর, ওএনবি২৪, দিনকালঅনলাইন, সারাবাংলা, পার্সটুডে, উইকলিসোনারবাংলা ও ২৪বাংলানিউজব্লগ৷
বন্ধ হয়ে যাওয়া সাইটগুলোর মধ্যে ‘উইকলিসোনারবাংলা ডটকম' হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত (এরই মধ্যে সাজা কার্যকর হয়েছে) জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের নিউজপোর্টাল৷ তিনি ছিলেন সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা' পত্রিকার সম্পাদক৷ উইকলিসোনারবাংলা ডটকম হলো মুদ্রিত পত্রিকার ওয়েবসাইট৷ আছে আগেই বন্ধ করে দেয়া দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ ও শীর্ষ নিউজের মতো নিউজ পোর্টাল৷
শফিউল আলম
২০১১ সালের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো শীর্ষ নিউজ ডটকম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ এবার দ্বিতীয় দফায় ব্লক করা হল৷ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন৷ তাঁর পত্রিকাটি বন্ধ থাকলেও অনলাইন ভার্সন প্রকাশিত হতো৷
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দাবি, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই পোর্টালগুলোর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান এবং হেটস্পিচ ছড়ানোর প্রমাণ পেয়েছে৷''
শীর্ষ নিউজের সম্পাদক একরামুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কী কারণে আমাদের নিউজ পোর্টাল ব্লক করা হয়েছে তা আমাদের জানানো হয়নি৷ আমাদের আগে কোনো নোটিশও দেয়া হয়নি৷ আমি তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি তিনিও বিষয়টি জানেন না বলে আমাকে জানিয়েছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকার অনলাইন নীতিমালা করছে৷ তথ্য মন্ত্রণালয় নিউজ পোর্টালের কাগজপত্র জমা নিয়েছে৷ আমরা দিয়েছি৷ কিন্তু এভাবে কোনো কারণ ব্যাখ্যা না করে নিউজ পোর্টাল ব্লক করা স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং বাক স্বাধীনতার প্রতি হুমকি বলে আমি মনে করি৷''
একরামুল হক আরো বলেন, ‘‘আমরা এখনো করণীয় ঠিক করিনি৷ তবে আমরা দাবি করছি আমাদের আনব্লক করা হোক৷''
যে দেশের গণমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা নেই
না দেশটা বাংলাদেশ নয়৷ তবে বাংলাদেশের অবস্থা যে খুব একটা সুবিধাজনক তাও নয়৷ চলুন দেখে নেই, প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী কোন দেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন৷
ছবি: DW/D. Olmos
ইরিত্রিয়া
রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রকাশিত ২০১৬ প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী, যে দেশটিতে গণমাধ্যমের কোনোই স্বাধীনতা নেই, সেটি হচ্ছে ইরিত্রিয়া৷ গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বৈরশাসকের কবলে থাকে দেশটির কমপক্ষে ১৫ সাংবাদিক এই মুহূর্তে জেলে আছেন৷ প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে সবার নীচে আছে ইরিত্রিয়া৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Lopez
উত্তর কোরিয়া
ইরিত্রিয়ার পরই নীচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে উত্তর কোরিয়া৷ কিম জুন-উনের নেতৃত্বাধীন দেশটি গত ১৫ বছর ধরেই প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের একেবারে নীচের দিকে অবস্থান করছে৷ দেশটিতে বিদেশি সাংবাদিকদের ভিসা তেমন দেয়া হয় না, যদিও বা কেউ ভিসা পান, তাঁকে রাখা হয় কড়া নজরদারিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yonhap/Kcna
তুর্কমেনিস্তান
এই দেশটিকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম তথ্য কৃষ্ণ গহ্বর৷ স্বাধীনভাবে কোনো সাংবাদিক কাজ করতে চাইলে তাঁর জন্য মোটামুটি কারাভোগ এবং নির্যাতন নিশ্চিত দেশটিতে৷ ইনডেক্সে তাদের অবস্থান নীচের দিক থেকে তৃতীয়৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
ফিনল্যান্ড
এবার যাওয়া যাক, তালিকার উপরের দিকের অবস্থা৷ গত পাঁচবছর ধরেই প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের শীর্ষে অবস্থান করছে ফিনল্যান্ড৷ দেশটির গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করে৷ তবে সেদেশের অধিকাংশ পত্রিকা দু’টি মিডিয়া গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/van Weel
নেদারল্যান্ডস
প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে গত একবছরে দু’ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে নেদারল্যান্ডস৷ দেশটির গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আইনিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে৷
ছবি: Imago/SylviaxLederer
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে গতবছর চারজন ব্লগার এবং প্রকাশক খুন হওয়ার পরও প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে কিঞ্চিৎ উন্নতি ঘটেছে৷ আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়ে দেশটির অবস্থান এখন ১৪৪তম, তবে গ্লোবাল স্কোর কমেছে মাইনাস ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ৷
ছবি: DW/A. Islam
6 ছবি1 | 6
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার যদি দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে তাহলে কোনো অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করতে পারে৷ তবে তা নিশ্চিত হতে হবে৷ আর খেয়াল রাখতে হবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার প্রতি৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘যেসব পোর্টাল ব্লক করা হয়েছে তারা আদালতে গিয়েও প্রতিকার চাইতে পারে৷''
বিটিআরসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে এক হাজার ৮০০ সংবাদভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল রয়েছে৷ সেগুলো বিভিন্নভাবে মনিটর করা হচ্ছে৷ ৩৫টি ওয়েবসাইট বন্ধের নির্দেশও ওই মনিটরের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা হয়েছে৷ এটা প্রাথমিক ধাপ ধাপ৷ আগামীতে হয়তো আরও এরকম হতে পারে৷
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’