হোলি আর্টিজান বেকারিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস জঙ্গি হামলা নিয়ে বই লিখেছেন অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু৷
বিজ্ঞাপন
‘হোলি আর্টিজান: একটি জার্নালিস্টিক অনুসন্ধান' নামের বইটিতে সেই রাতের ঘটনা আর উদ্ধার অভিযান তুলে ধরেছেন সবিস্তারে৷
হোলি আর্টিজেনের ঘটনাটি এমন এক ঘটনা ছিল যে, সেদিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন বলে মনে করেন নুরুজ্জামান লাবু৷ নৃশংস সেই হামলার তৃতীয় বছরে এসে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘জিম্মি ঘটনায় কিভাবে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে হয়, সে বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অতীতের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না৷ ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সারাদেশের মানুষকে রাতটি পার করতে হয়েছে৷''
জঙ্গিবাদের হুমকি
নুরুজ্জামান লাবু জানান, হোলি আর্টিজানের পর আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে নব্য জেএমবির অনেক শীর্ষ নেতা অভিযানে নিহত হয়েছেন, আবার কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন৷ কিন্তু এখনও তাদের সাংগঠনিক কাজের খবর পাওয়া যায়৷ কিছুদিন আগে ঢাকার দুটি জায়গায় পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা বিস্ফোরণ করা হয়েছে৷ আইএস ঘটনার দায় স্বীকার করলেও কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ৷
লাবু বলেন, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও নিজস্ব সূত্রে জানতে পেরেছি, নব্য জেএমবি এখনো তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে৷'' লাবু মনে করেন, ‘‘তারা (নব্য জেএমবি) কিছুটা ব্যাকফুটে রয়েছে৷ তবে সুযোগ পেলে আবারো মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াবে৷''
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে একই সঙ্গে, অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে: নুরুজ্জামান লাবু
নুরুজ্জামান লাবু বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের আরেক জঙ্গি সংগঠন বেশ তৎপর ছিল৷ তারা বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগার, লেখক আর প্রকাশকদের টার্গেট করে হত্যা করেছে৷ এই সংগঠনটি মূলত আল কায়েদা অনুসারী৷ তাদের শীর্ষ নেতা দেশের সামরিক বাহিনী থেকে বহিস্কৃত মেজর জিয়া৷ তিনি এখনো পলাতক রয়েছেন৷ ফলে এই বিষয়টিকে আশঙ্কা হিসেবে দেখছেন এই সাংবাদিক৷
তাঁর মতে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে৷ একই সঙ্গে, অপরাধের ধরন এখন পাল্টে যাচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি৷
লাবু জানালেন, জঙ্গিবাদে জড়িতরা আগের মতো আস্তানা করে থাকেন না৷ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করছে৷ এ কারণে এই এনক্রিপ্টেড ডেটা থেকে তথ্য উদ্ধার করাটা পুলিশের পক্ষে মুশকিল বলে মনে করেন লাবু৷ তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কৌশল পাল্টানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে বলেও অভিমত তাঁর৷
জঙ্গিবাদ দমনে করণীয়
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স নীতি' নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এছাড়াও, সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি৷ এক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাগুরুদের এগিয়ে আসারও অনুরোধ জানিয়েছেন সরকারপ্রধান৷
সরকারের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে লাবু বলেন, ‘‘আমাদের দেশের একটা প্রবণতা হচ্ছে, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সরকার কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে৷ কিন্তু কিছুদিন অতিক্রান্ত হলেই সেটা ঝিমিয়ে পড়ে৷''
স্তম্ভিত করে দেয়া গুলশান হামলা
ঘটনাটি কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়, আলোড়ন উঠেছিল দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে৷
ছবি: bdnews24.com
গুলশানে হামলা
বিশ্ব মানচিত্রে পরস্পরের সঙ্গে লাগোয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ অর্ধ শতাব্দী পূর্বে স্বাধীন হয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনায়৷ দেড় দশক ধরে নানা জায়গায় মুসলিম জঙ্গিবাদ ছড়ালেও খানিকটা যেন নিরাপদেই ছিল দেশটি৷ রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল৷ তার অনেকগুলোতে জঙ্গিদের ব্যবহারের কথাও তদন্তে উঠে আসে৷ তবে ঘোষণা দিয়ে বড় ধরণের হামলা আর হয়নি৷ এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছে গোটা দেশ৷
ছবি: bdnews24.com
যেভাবে শুরু
তখন ছিল রমজান৷ ঘটনার দিন ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে একদল অস্ত্রধারী গুলশানের একটি রেস্টুরেন্ট ঢুকে পড়ে৷ স্প্যানিশ ওই রেস্টুরেন্টটির নাম হোলি আর্টিজান৷ ঢোকার সময়ই তারা বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে৷
ছবি: bdnews24.com
জিম্মি দশা
অস্ত্রধারীরা রেস্টুরেন্টে ঢোকার পর সেখানে জিম্মি সংকট শুরু হয়৷ বাইরে চলে নানা গুজব৷ হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন রেস্টুরেন্টকর্মী বের হয়ে আসতে সক্ষম হন৷ বাংলাদেশে এর আগে ১৯৭৭ সালে ঢাকায় আরেকটি জিম্মি সংকট ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়েছিল৷ তখন মুম্বাই থেকে টোকিওগামী একটি জাপানি বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে বিমানটি ঢাকায় নামিয়েছিল দেশটির বামপন্থি বিদ্রোহী দল ‘ইউনাইটেড রেড আর্মি’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
কোথায়
অবস্থানগত কারণেও এই ঘটনা আলোচনায় ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে৷ কারণ, রেস্তোরাঁটি ঢাকার গুলশান এলাকায়৷ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস রয়েছে এই এলাকায়৷ কয়েকটি দূতাবাস তো রেস্টুরেন্টের একেবারেই কাছে৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press Agency/M. Hasan
টার্গেট বিদেশি, টার্গেট হোলি আর্টিজান
ঢাকার অভিজাত এই এলাকার রেস্টুরেন্টটিতে পোষা প্রাণী নিয়ে প্রবেশ করা যেতো৷ এর ভেতরে উন্মুক্ত লন ছিল, সেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করতে পারতো৷ ওই এলাকায় থাকা বিদেশিদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল রেস্টুরেন্টটি৷ বিদেশিদের টার্গেট করতেই এই রেস্টুরেন্টকে বেছে নেয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন৷
ছবি: bdnews24.com
প্রাণহানি পুলিশেরও
জিম্মি সংকট শুরুর পর ঘটনা সামলাতে এগিয়ে যায় পুলিশ বাহিনী৷ কিন্তু প্রথম দিকেই জঙ্গিদের হামলায় বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম প্রাণ হারান৷ এতে আতঙ্ক আরো বাড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর
পুলিশ হতাহত হওয়ার পর অভিযান নিয়ে নতুন করে চিন্তা শুরু হয়৷ এক পর্যায়ে জঙ্গিদের কবল থেকে ওই রেস্টুরেন্টটি মুক্ত করার অভিযান রাতে কার্যত স্থগিত হয়ে যায়৷ শেষ পর্যন্ত ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর৷ সাঁজোয়া যান নিয়ে সেনা সদস্যরা অভিযান পরিচালনা করেন৷
ছবি: bdnews24.com
আইএস সংশ্লিষ্টতা
রাতে জিম্মি দশা চলাকালে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আইএস হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর আসতে থাকে৷ তবে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তা অস্বীকার করে৷
ছবি: Reuters/A.Konstantinidis
কিভাবে ঘটনার শেষ
ঘটনার অবসান হয় প্রায় ১২ ঘণ্টা পর সেনা অভিযানে৷ অবশ্য তার আগেই জঙ্গিরা সেখানে থাকা ২০ জনকে খুন করে৷ মরদেহ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারির জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে৷ জীবিত উদ্ধার করা হয় এক জাপানি ও দুই শ্রীলঙ্কানসহ মোট ১৩ জনকে৷
ছবি: bdnews24.com
আলোচিত সেই বাড়ি
ঘটনার পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় গুলশানের সেই বাড়ি৷ যে রেস্টুরেন্টে হামলা হয়েছিল, তার মালিক ঘটনার পর বাড়িটি ফিরিয়ে নেন৷
ছবি: bdnews24.com
নতুন ঠিকানায় হোলি আর্টিজান
গত বছরের ১ জুলাই রাতে যখন হামলা হয়, তখন হোলি আর্টিজান ছিল গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর বাড়িতে৷ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর জানুয়ারিতে এসে গুলশান এভিনিউর র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় নতুন করে চালু হয় রেস্টুরেন্টি৷
ছবি: bdnews24.com
জঙ্গিবাদ ও বিচার
এই ঘটনার পর আইএস দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার এর জন্য স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পুনর্গঠিত একটি শাখাকে দায়ী মনে করে৷ ঘুরে ফিরে এর সঙ্গে জড়িত হিসাবে একই ব্যক্তিদের নাম আসতে থাকে৷ সরকার তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করে৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর আগাম পদক্ষেপে তাদের বহু ঘাঁটি ও অবস্থানস্থল ধ্বং হয়ে গেছে৷ সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এই ঘটনার তদন্ত শেষ করতে ৫ ব্যক্তিকে খোঁজা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
12 ছবি1 | 12
জঙ্গিবাদ নির্মূলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই লেখক৷ তাঁর মতে, ‘‘জঙ্গিবাদ একটি মতাদর্শ৷ ভ্রান্ত মতাদর্শ হলেও সেটি বিশ্বাস করে জঙ্গিরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে থাকে৷ এর ফলে মতাদর্শকে মতাদর্শ দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে৷''
গত সপ্তাহে সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক সপ্তাহ পালন করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট৷ এমন আয়োজন আরো বড় আকারে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া দরকার বলেও মনে করেন নুরুজ্জামান লাবু৷ প্রতিটি মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব৷
লাবু বলেন, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েই জঙ্গিরা তরুণদের ভুল পথে পা ফেলতে বাধ্য করছে৷ ফলে এই অপব্যাখ্যার বিপরীতে সঠিক ব্যাখ্যাটি অনেক বেশি প্রচার করা দরকার৷ এজন্য ইমাম-আলেমদের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি৷
জুম্মার নামাজের খুৎবায় জঙ্গিবাদের খারাপ দিক সম্পর্কে বর্ণনার একটা উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার৷ কিন্তু সেটা আকারে ক্ষুদ্র বলে মনে করেন এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক৷ তিনি জানান, অন্য উদ্যোগগুলোর মতো এটাও কিছুদিন পর ঝিমিয়ে পড়েছে৷