‘‘সন্ত্রাসীরা জানে একটা-দু’টো হামলা চালিয়ে সরকার পরিবর্তন হবে না৷ এমনকি সমাজ পরিবর্তনও হবে না৷ তাই তারা সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চায়৷ এটা তো স্বতঃসিদ্ধ যে, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে তাদের প্রতিরোধ শক্তিও কমে যায়৷’’
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে জঙ্গিদের কৌশলকে এভাবেই ব্যাখা করলেন প্রখ্যাত আলেম ও শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ৷ বললেন, জনপ্রতিরোধের শক্তি হ্রাস করতে পারলে জঙ্গিদের কাজ করা সহজ হবে৷ তাই ‘‘তারা এই কৌশল নিয়ে বড় বড় জায়গায় হামলা চালাচ্ছে৷ অভাবিত জায়গায় হামলা চালাচ্ছে তারা৷''
জঙ্গিদের আসল ‘টার্গেট' হয়ত ছিলেন এই মাওলানা – শোলাকিয়া ঈদগাহের পাশে জঙ্গি হামলার তদন্তকারীরা বলছেন এমনটাই৷ কারণ কয়েকদিন আগে তিনিই লাখো আলেমের স্বাক্ষর নিয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন, যা অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি৷
ডয়চে ভেলে: ধর্মের নামে যারা মানুষ হত্যা করছে, তাদের কীভাবে দেখা হয়, হচ্ছে?
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ: মানুষ হত্যা অপরাধ৷ আর ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা জঘন্যতম অপরাধ৷ ইসলামে বলা হয়েছে, কোনো কারণ ব্যতীত, কারণ বলতে যদি সেই ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে থাকে – এমন কারণ ব্যতীত যদি কাউকে হত্যা করা হয়, তাহলে গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করা হয়৷ অন্যদিকে কারো যদি প্রাণ রক্ষা করা হয়, তাহলে তার মাধ্যমে গোটা মানবজাতিরই প্রাণ রক্ষা করা হয়৷
প্রখ্যাত আলেম ও শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ
ধর্ম প্রচারে কাউকে হত্যা কি আদৌ করা যায়?
এটা একেবারেই জায়েজ নয়৷ ইসলামে কঠোরভাবে এটি নিষেধ করা হয়েছে৷ দীনের ব্যাপারে কোনোরকম জবরদস্তি হতে পারবে না৷ বলা হয়েছে, ‘তোমরা ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি করো না৷' কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের আমি দুনিয়াতে দারোগা বানিয়ে পাঠাইনি যে, তোমরা ধর্মের নামে জবরদস্তি করবে৷ তোমরা মানুষকে হেকমতের সঙ্গে, সুন্দর বচনের সঙ্গে এবং সুন্দর বিতর্কের সঙ্গে দাওয়াত দাও৷' এটা কোরআন শরিফের নির্দেশ, এটা আয়াতে আছে৷
নবীজীর আমলে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যে যুদ্ধ হয়েছিল এবং এখন ধর্মের নামে যে হত্যা হচ্ছে – এ দু'টোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
রসুল করিম (সা.) কখনও ধর্মান্ধকরণের জন্য যুদ্ধ করেননি৷ সেই যুদ্ধগুলো তো রসুলের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ রসুল করিম (সা.) মদিনা পর্যন্ত এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ সেখানেও তারা তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না৷ আক্রমণের পর আক্রমণ করেছে৷ দেখুন, বদরের ময়দান কি মদিনার কাছাকাছি না মক্কার কাছাকাছি? খন্দকের যুদ্ধে তো তারা মদিনায় এসে আক্রমণ করল৷ তা আপনার ঘরে আক্রমণ করলে আপনি তাদের প্রতিহত করবেন না? একটাও যুদ্ধ সেখানে হয়নি ধর্ম প্রচারের জন্য বা ধর্মান্ধকরণের জন্য৷ ইসলামে একটা জিনিস আছে ‘জিহাদ'৷ জিহাদ বলতে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করার জন্য কাজ করা৷ জিহাদ আর সন্ত্রাস এক জিনিস না৷ সন্ত্রাস কোরআনের পরিভাষায় দু'টি শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে – একটা ফিতনা আর একটা ফাতাহ৷ সন্ত্রাস হত্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর৷ তাই রসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না৷ আল্লাহ সন্ত্রাসীদের পছন্দ করেন না৷'
ধর্মের রাজনীতি ও তরুণ প্রজন্ম
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে উৎসাহ, উদ্বেগ দুই-ই আছে৷ আর সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল ও ইসলামপন্থিদের উত্থানের বিষয়টিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ৷ ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছে আজকের প্রজন্ম?
ছবি: Reuters
পিয়ান মুগ্ধ নবীর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী পিয়ান মুগ্ধ নবীর কাছে ধর্ম বিষয়টা পুরোপুরি ব্যক্তিগত হলেও রাজনীতি ব্যক্তিগত বিষয় নয়৷ তবে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে তিনি কখনোই সমর্থন করেন না৷
ছবি: DW
শিবরাজ চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শিবরাজ চৌধুরী৷ তার মতে, ধর্ম এবং রাজনীতি কখনোই এক হতে পারে না৷ ধর্মের মূল বিষয় মনুষত্ব বা মানুষের মধ্যকার শুভবোধ৷ তবে ধর্মের নামে যদি কখনো মৌলবাদ কিংবা চরমপন্থা চলে আসে, সেটা কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়৷
ছবি: DW
শিহাব সরকার
ঢাকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শিহাব সরকার৷ তার মতে, ধর্ম ধর্মের জায়গায় আর রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়৷ বলা বাহুল্য, ধর্মের নামে রাজনীতি তিনিও সমর্থন করেন না৷
ছবি: DW
আসিফ হামিদী
আসিফ হামিদীও মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন৷ তিনিও মনে করেন ধর্ম এবং রাজনীতি কখনোই এক হতে পারে না৷ তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘোর বিরোধী তিনি৷
ছবি: DW
মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর
ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর৷ তাঁর মতেও রাজনীতি ধর্মভিত্তিক হতে পারে না৷ তবে আল্লাহ এবং রাসুলের কিংবা ইসলামের উপর কোনোরকম আঘাত আসলে তার বিরোধীতা করা সব মুসলমানের নৈতিক দ্বায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW
সাদমান আহমেদ সুজাত
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান আহমেদ সুজাত৷ তাঁরও ঐ এক কথা৷ ‘‘ধর্ম এবং রাজনীতি কখনো এক হতে পারে না৷’’ তিনি জানান, ‘‘ধর্ম আমরা সাধারণত জন্মগতভাবে পাই, কিন্তু রাজনীতিকে আমরা অনুসরণ করি৷’’
ছবি: DW
সাজ্জাদ হোসেন শিশির
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন শিশির৷ তাঁর মতে, রাজনীতি সবসময়ই ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া উচিত৷ তাঁর বিশ্বাস, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেললে তার ফল কখনো ভালো হয় না৷
ছবি: DW
দাউদুজ্জামান তারেক
ঢাকার আরেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দাউদুজ্জামান তারেক মনে করেন, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কখনো মিল হতে পারে না৷ কারণ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা একই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসরণও করতে পারেন৷
ছবি: DW
8 ছবি1 | 8
যারা এ ধরনের সন্ত্রাস করছে তারাও তো মুসলমান৷ শোলাকিয়ার মতো জায়গায়তেও তারা হামলা করতে চলে গেল৷ ধর্মে এদের ব্যাপারে ব্যাখা কী রকম?
আপনি বলুন, একজন মুসলমান কি মসজিদে হামলা করতে পারে? এতেই তো বোঝা যায়, যে ছেলেগুলোকে মাঠে নামিয়েছে, যে তাদের এতটাই বিভ্রান্ত করেছে যে তারা ন্যায়-অন্যায়কে ভুলে গেছে, যারা এদের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে, তারা নিঃসন্দেহে ইসলাম এবং মুসলমানের শত্রু৷ এরা হলো বিভ্রান্ত৷ আমরা এক লাখ আলেমের যে ফতোয়াটা বের করেছি, সেখানে কোরআন-হাসিদের রেফারেন্স নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমরা৷ আলোচনা করেছি – এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা, এটাকে জিহাদ বলা যায় কিনা, আত্মঘাতী হামলা ইসলামের দৃষ্টিতে কী ধরনের অপরাধ, কোনো নিরিহ বান্দাকে হত্যা করা, মুসলিম সমাজে বসবাস করা কোনো অমুসলিমকে হত্যা করা কোন ধরনের অপরাধ৷ রসুল তো বলেছেন, এরা বেহেস্ত তো দূরের কথা, বেহেস্তের গন্ধও পাবে না৷
এই যে পরপর দু'টি হামলা হয়ে গেল...এখন আমাদের আলেম সমাজের এই হামলা বন্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
আমি তো মনে করি, এখন সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব আলেমদের৷ কেন? কারণ যেহেতু তাঁরা ধর্মের নামে কাজ করছে, বেহেস্ত পাওয়ার আশায় কাজ করছে৷ তাই এখন আলেমদেরই বিষয়টি স্পষ্ট করা মানুষকে বোঝানো উচিত৷ তাছাড়া এ কাজটা আলেমরাই করতে পারেন৷ কারণ অন্যরা করলে তো সাধারণ মানুষ তা গ্রহণ করবে না৷ তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যাঁরা, তাঁদেরকেই ইসলাম সম্পর্কে ধারণাটা স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে৷ ইসলামে জঙ্গিবাদের পথকে ধর্মের পথ বলা হয়নি, বেহেস্তের পথ বলা হয়নি৷ এটা জাহান্নামের পথ৷ তাই আলেমদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি৷ এখন আলেমদের উচিত এবং অন্যতম প্রধান কর্তৃব্য হলো তরুণদের যে মনোবৈকল্য ঘটছে, বিভ্রম ঘটছে, এই বিভ্রান্তি থেকে তাদের উদ্ধার করা৷
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগারদের উপর বিভিন্ন হামলায় মাদ্রাসা এবং সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার কথা বলছে গোয়েন্দারা৷ এই নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মহলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে
২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বা এনএসইউ-এর পাঁচ ছাত্র৷ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়৷ এরা সকলেই ছিল আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মগজ ধোলাই
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের ভুলিয়েভালিয়ে দলে নিচ্ছে জঙ্গিরা, এমন ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা তাই জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য আগামীতে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার কথাও ভাবছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-এর ছাত্র মোহাম্মদ নুরউদ্দনি এবং আবু বারাকাত মোহাম্মদ রফকিুল হাসান হাসানকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করে পুলিশে দেয়া হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
হিযবুত তাহরীরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়ের আইবিএ-র শিক্ষক ছিলেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রয়েছে
কওমি মাদ্রাসাগুলোকে জঙ্গিবাদের কারখানা বলা হতে একসময়৷ সেই বাস্তবতা মুছে যায়নি৷ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটক দু’জন নিজেদের মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দাবি করেছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
সতর্ক পুলিশ
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং জঙ্গি বিষয়ক বিশেষ সেলের সদস্য সানোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের একাংশ এখন জঙ্গি তৎপরতার দিকে ঝুঁকছে৷ আর যারা অপারেশনে অংশ নিচ্ছে, তারাও বয়সে তরুণ এবং ছাত্র৷''
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
6 ছবি1 | 6
আপনি যখন এক লাখ আলেমের স্বাক্ষর নিয়ে মিডিয়ার কাছে দিলেন, তখন একটা গ্রুপ এর বিরোধিতাও করেছে৷ এই সব হামলার সঙ্গে তাদের কোনো যোগসূত্র বা অন্য কোনো সংশ্লিষ্টতা আপনি কি দেখছেন?
তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আমি জানি না৷ তবে তাদের কথায় সন্ত্রাসীরা যে উৎসাহিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ ওরা কিন্তু ফতোয়ার সত্যতাকে অস্বীকার করতে পারেনি৷ ওরা বলছে, ফতোয়া দেয়ার জন্য মুফতি হতে হবে৷ এই কথাটা ওরা জানে না বলেই বলছে৷ কারণ ইসলাম সম্পর্কে যার জানাশোনা আছে, যিনি বিশেষজ্ঞ, একমাত্র তিনিই এটা দিতে পারেন৷ এ কথা সর্বজন স্বীকৃত৷ আমাদের সুপ্রিম কোর্টে ফতোয়া সম্পর্কে যে রায় আছে, সেখানে এটা উল্লেখ আছে৷ মুফতি হওয়া কোনো শর্ত নয়৷
জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সরকারের কী ভূমিকা রাখা উচিত?
সরকারকে এ ব্যাপারে আরো ক্ষিপ্র এবং কৌশলী হতে হবে৷ তাদের দেশের সমস্ত জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে জনপ্রতিরোধের কাজে লাগাতে হবে৷ কারণ জনপ্রতিরোধ ছাড়া একা সরকারের পক্ষে এটা দমন করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না৷ সন্ত্রাসীরা যে কৌশল নিয়েছে, এটা জেনেই নিয়েছে যে, একটা-দু'টা হামলা চালিয়ে সরকার পরিবর্তন হবে না৷ এমনকি সমাজ পরিবর্তনও হবে না৷ তাই তাদের সমর কৌশল হলো – সমাজের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া৷ কারণ এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, মানুষের মধ্যে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের প্রতিরোধ শক্তি কমে যায়৷ আতঙ্কিত মানুষের প্রতিরোধ শক্তি হ্রাস পায়৷ জঙ্গিরা মনে করেছে, তারা যদি জনপ্রতিরোধ শক্তি হ্রাস করতে পারে তাহলে তাদের জন্য কাজ করা সহজ হবে৷ তাই তারা এই কৌশল নিয়ে বড় বড় জায়গায় হামলা চালাচ্ছে, অভাবিত জায়গায় হামলা চালাচ্ছে তারা৷
ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথককরণ
তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের আমল থেকে ‘‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিচ্ছেদ’’ কথাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু৷ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে এই সমস্যার মূল্যায়ন ও সমাধান আজও আলাদা৷ তার কিছু নমুনা৷
ছবি: Jewel Samada/AFP/Getty Images
অস্ট্রেলিয়া
কমনওয়েলথ দেশটির সংবিধানে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা বা সরকারি পদ গ্রহণের জন্য কোনো ধর্ম পরীক্ষা নিষেধ করা আছে৷ অপরদিকে যে কোনো ধর্ম মুক্তভাবে পালন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ (ছবিতে সিডনির সংসদ ভবনের উপর অস্ট্রেলিয়ার লোগো)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/L. Coch
ব্রাজিল
ব্রাজিলের বর্তমান সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে; কোনো রাষ্ট্রীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তাদের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের ‘‘জোট গঠন বা নির্ভরতা’’ নিষিদ্ধ৷ (ছবিতে ব্রাজিলের কনগ্রেসো নাসিওনাল বা জাতীয় কংগ্রেস, যার দুই কক্ষ হলো সেনেট এবং চেম্বার অফ ডেপুটিজ)৷
ছবি: Voishmel/AFP/Getty Images
চীন
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘‘কোনো সরকারি বিভাগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নাগরিকদের কোনো ধর্মে বিশ্বাস করতে বা না করতে বাধ্য করতে পারবে না; এছাড়া যে সব নাগরিক কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন অথবা করেন না, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা চলবে না৷’’ (ছবিতে বেইজিং-এর গ্রেট হল অফ দ্য পিপল, যেখানে প্রতিবছর ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
ফ্রান্স
ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদকে ফরাসিতে বলা হয় ‘লাইসিতে’৷ ফ্রান্সে ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পরস্পরের থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, অপরদিকে সরকারি ক্ষমতাকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ (ছবিতে প্যারিসের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সম্মেলন)৷
ছবি: picture-alliance/ZB/M. Tödt
জার্মানি
জার্মান সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, যদিও জার্মানিতে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে পুরোপুরি বিচ্ছেদ নেই৷ সরকারিভাবে স্বীকৃত গির্জাগুলিকে পাবলিক কর্পোরেশনের মর্যাদা দেওয়া হয়, তাদের প্রাপ্য কিছু কিছু কর সরকার আদায় করে দেন – তবে বিনামূল্যে নয়৷ ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয় নয়৷ (ছবিতে বার্লিনের বুন্ডেসটাগ বা জার্মান সংসদ)৷
ছবি: imago/Schöning
জাপান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন দখলদারির সময় ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মার্কিন ধ্যানধারণা জাপানে আরোপিত হয়৷ জাপানের সংবিধানে ধর্মপালনের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করা হয়েছে, অপরদিকে সরকার ধর্মপালনের জন্য কোনোরকম চাপ দিতে পারবেন না, অথবা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে সরকারি অর্থ ব্যয় করতে পারবেন না৷ (ছবিতে টোকিও-র সংসদভবন)৷
ছবি: Reuters
সুইজারল্যান্ড
সুইশ কনফেডারেশনের ফেডারাল সংবিধানে ‘‘ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা’’-র গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে৷ বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে, ‘‘কোনো ব্যক্তিকে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বা অঙ্গ হতে, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বা ধর্মীয় নির্দেশ অনুসরণ করতে বাধ্য করা চলবে না’’৷ (ছবিতে বার্ন শহরের বুন্ডেসহাউস বা ফেডারাল প্যালেস, যেখানে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন বসে)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Klaunzer
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যের চার্চ অফ ইংল্যান্ডের প্রধান হলেন ব্রিটিশ নৃপতি স্বয়ং, তিনিই গির্জার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করেন৷ হাউস অফ লর্ডস-এও ২৬ জন বিশপের আসন আছে৷ সব সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ সীমিত, যুক্তরাজ্যে সরকারি শাসনও অপেক্ষাকৃতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ৷ ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধান অনুযায়ী অপরাপর ধর্মীয় গোষ্ঠীও ব্যাপক স্বাধীনতা উপভোগ করে৷ (ছবিতে প্যালেস অফ ওয়েস্টমিনস্টার)৷
ছবি: Mohammad Karimi
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সম্পর্কে জেফারসনের প্রখ্যাত উক্তি মার্কিন সংবিধানে উল্লিখিত নেই৷ ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্টে বলা হয়েছে যে, ‘‘(মার্কিন) কংগ্রেস কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে, বা মুক্তভাবে ধর্মপালন নিষিদ্ধ করে কোনো আইন প্রণয়ন করবে না’’৷ (ছবিতে ক্যাপিটল হিল-এ মার্কিন কংগ্রেসের আসন)৷
ছবি: Jewel Samada/AFP/Getty Images
9 ছবি1 | 9
এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে, মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে আপনার আহ্বান কী হবে?
আমার আহ্বান হবে দু'টো৷ প্রথমত, দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আমার আহ্বান হবে – তাঁরা যেন আতঙ্কিত না হয়ে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন৷ কোরআন-হাদিসের নির্দেশও তাই৷ আর দ্বিতীয়ত, বিভ্রান্ত এই তরুণদের আমি আহ্বান জানাবো – হে তরুণ, তুমি বেহেস্ত পাওয়ার আশায় যে পথে অগ্রসর হচ্ছো, সেই পথ বেহেস্তের পথ নয়৷ সে পথ জাহান্নামের৷ তাই তুমি তাড়াতাড়ি শান্তির পথে, ইসলামের পথে, ইসলামের মৌল চেতনার পথে ফিরে এসো৷ আমরা অভিভাবকরা অবিবেচক নই, তোমার জন্য আমদের হৃদয় আজও উন্মুক্ত, এখনও খোলা৷
যেসব পরিবার থেকে এ সব তরুণরা জঙ্গিবাদের দিকে যাচ্ছে, সেই সব পরিবারের প্রতি আপনার আহ্বান কী?
এই তরুণদের বিভ্রান্তির পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ কাজ করছে, তা হলো পারিবারিক ব্যর্থতা এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা৷ পারিবারিক ব্যর্থতা হলো – আমরা জবরদস্থি করে একটা তিন বছরের বা সাড়ে তিন বছরের ছেলের ঘাড়ে বইয়ের বোঝা দিয়ে আতাদের ইংরেজিতে হাসতে শেখাচ্ছি, কাঁদতে শেখাচ্ছি, ইংরেজিতে টয়লেটে যেতে শেখাচ্ছি৷ ফলে সে একটা শিকড় বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ে উঠছে৷ এক্ষেত্রে সমাজপতিদের হুঁশ হওয়া দরকার৷ সাধারণ মানুষেরও ভাবা দরকার যে, সমাজকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? সন্তানদের কোথায় ঠেলে দিচ্ছি অসহায়ভাবে? আমার এই আহেবানই থাকবে যে, সন্তানই সব৷ তাই তাই সন্তানের দিকে ফিরে এসো, সন্তানকে আদর করতে শেখো৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷