মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ঢাকার আদালত এলাকা থেকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত বলে আটক জঙ্গিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে৷ মামলার এজাহারে এ কথা উল্লেখ করা হয়৷
বিজ্ঞাপন
তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুলিশ বা কারাগারের ভিতরের কারো হাত আছে কিনা এ প্রশ্নও উঠেছে৷
রবিবার জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশ যে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে তা স্পষ্ট৷ এই ঘটনায় তাই পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷ আর জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ২০১৪ সালেও পুলিশ ভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়া হয়৷ শুধু জঙ্গি নয়, পুলিশ হেফাজত থেকে আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷
রবিবার ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করেছে৷ মামলায় বলা হয়েছে , যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তাদের আগে থেকেই জানানো হয়েছিল যে, আনসার আল ইসলামের সদস্যরা আদালতের কাজ শেষে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেবে৷ মোট চারজনকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল৷ এজন্য তিনটি মোটরসাইকেলও প্রস্তুত ছিল৷ কিন্তু দুইজনকে নিতে পারলেও বাকি দুইজনকে পারেনি৷ তারা একটি মোটর সাইকেলও ফেলে রেখে যায়৷
ওই চার জঙ্গিসহ মোট ১২ জন আসামিকে আদালতে নেয়া-আনার জন্য মাত্র তিনজন কনেস্টবল দায়িত্বে ছিলেন৷
আদালতে কাজ শেষে বের হওয়ার সময় ওই চার জঙ্গির সঙ্গে মাত্র একজন কনেস্টবল ছিল৷ পাবলিক প্রসিকউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “তাদের নিরাপত্তা ছিল খুবই ঢিলেঢালা৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি এবং সাধারণ আসামিদের একই সঙ্গে আনা হয়৷ জঙ্গিদের এক হাতে হ্যান্ডকাফ ছিল৷ কোনো ডান্ডাবেড়ি পরানো ছিল না৷ আর একজন কনস্টেবল মাত্র তাদের নিরাপত্তায় ছিল৷”
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেয়া হয়নি: মো. জসিম উদ্দিন
তার কথা, ‘‘এইভাবে সাধারণ আসামিদের মতো তাদের আদালতে আনায় আমি বিস্মিত হয়েছি৷ এখানে দায়িত্বে অবহেলা স্পষ্ট৷’’
বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আদালতে আটক আসামি আনার প্রক্রিয়া হলো, যে থানার মামলায় আসামিদের হাজিরা, সেই থানার পুলিশ কারাগারে গিয়ে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে আসবেন৷ এরপর আদালত এলাকায় এনে প্রসিকিউশন পুলিশকে (কোর্ট পুলিশ) বুঝিয়ে দেবেন৷ তারা আসামিদের প্রথমে কোর্ট হাজতে রেখে তারপর আদালতে হাজির করবেন৷ আদালতের কাজ শেষে তারাই প্রিজন ভ্যানে উঠিয়ে দেবেন৷ এরপর আবার কারাগার পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ নিয়ে গিয়ে কারাগারকে বুঝিয়ে দেবেন৷
এই দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রসিকিউশন বা কোর্ট পুলিশের কাছে থাকা অবস্থায়৷ তবে হ্যান্ডকাফ, হেলমেট ডান্ডাবেড়ি এগুলো কারাগার থেকেই পরানোর কথা৷
আলোচিত কয়েকটি জঙ্গি হামলা
১৯৯৯ সালে উদীচী দিয়ে শুরু৷ এরপর বেশ কয়েকটি আলোচিত হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথা৷
ছবি: bdnews24.com
উদীচীর সমাবেশে হামলা
১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়েছিলেন৷ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে৷ হরকাতুল জিহাদ (হুজি) উদীচীর সমাবেশে হামলা করেছিল বলে পুলিশের ঐ ইউনিট জানিয়েছে৷ উপরের ছবিটি প্রতীকী৷
ছবি: bdnews24.com
বাংলা বর্ষবরণে হামলা
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন৷ এই ঘটনায় শতাধিক আহতের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন৷ এই হামলার মধ্য দিয়ে হুজি তাদের শক্ত অবস্থানের জানান দিয়েছিল৷ হামলার দায়ে ২০১৪ সালে হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২৫ মে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল৷ এতে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হয়েছিলেন৷ আনোয়ার চৌধুরীসহ অর্ধশত মানুষ আহত হন৷ হামলার দায়ে ২০০৮ সালে হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ (ছবি) তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১৭ সালের এপ্রিলে মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: A.M. Ahad/AP/picture alliance
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন প্রাণ হারান৷ ২০১৮ সালে মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়৷ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের জঙ্গিরা হামলায় অংশ নেয়৷ তবে ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তখনকার জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
৬৩ জেলায় বোমা হামলা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷ এই হামলায় দুজন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হয়েছিলেন৷
ছবি: DW/H. U.R.Swapan
ব্লগার হত্যা
জঙ্গি হামলায় বেশ কয়েকজন ব্লগার ও মুক্তমনা নিহত হয়েছেন৷ ২০১৩ সালে আহমেদ রাজিব হায়দার হত্যা দিয়ে শুরু৷ এরপর ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন হত্যার শিকার হন৷ ২০২১ সালে অভিজিৎ হত্যার মামলার রায়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷ তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷
ছবি: Robert Richter
হোসেনি দালানে হামলা
২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর আশুরা উপলক্ষ্যে হোসেনি দালানের শোক মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা৷ এ ঘটনায় একজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ চলতি বছরের মার্চে দেয়া রায়ে জেএমবির দুই সদস্যকে দশ ও সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
শিয়া মসজিদে হামলা
২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর বগুড়ার এক শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ হামলার প্রায় ১৪ মাস পর আদালতে দাখিল করা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল জেএমবি এবং ইসলামি ছাত্রশিবির হামলায় অংশ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোলি আর্টিজানে হামলা
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হন৷ পাঁচজন জঙ্গি অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে বেকারিতে ঢোকার পর সবাইকে জিম্মি করেন৷ এরপর পুলিশ ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশের দুই কর্মকর্তা জঙ্গিদের গুলি ও বোমার আঘাতে মারা যান৷ কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও জঙ্গিরা অন্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ জঙ্গিরা সবাই সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত হয়৷ ইসলামিক স্টেট এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷
ছবি: bdnews24.com
জাফর ইকবালের উপর হামলা
২০১৮ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক তরুণ ছুরি নিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায়৷ এই ঘটনায় এ বছরের এপ্রিলে ফয়জুল হাসান নামের একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ফয়জুল কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য কিনা তা প্রমাণিত হয়নি৷ তবে তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে জিহাদি প্রবন্ধ ও বই ডাউনলোড করে পড়ে, উগ্রবাদী বক্তাদের বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন৷
ছবি: bdnews24.com
10 ছবি1 | 10
ওই জঙ্গিদের ঢাকার আদালতে আনা হয়েছিল কাসিমপুর কারাগার থেকে৷ কাসিমপুর কারাগারের জেল সুপার তরিকুল ইসলাম দাবি করেন, “আমাদের দায়িত্ব হলো কারাগারের ভিতরে৷ আদলাতে আসামিদের নেয়া এবং কারাগারে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব কোর্ট পুলিশ ও থানা পুলিশের৷ আমরা তাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে আসামিদের রেডি রাখি৷ তারা কীভাবে নেবেন, হ্যান্ডকাফ বা ডান্ডাবেড়ি পরাবেন কিনা তা তাদের দায়িত্ব৷ হ্যান্ডকাফ তারাই নিয়ে আসেন৷”
প্রসিকিউশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন জানান, ‘‘আসামিদের নিরাপত্তার জন্য জেল কোডেই বলা আছে৷ কাদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হবে, কাদের শুধু হ্যান্ডকাফ- এটা জেলখানাই নির্ধারণ করে৷ আমরা কারাগারকে আগেই জানিয়ে দিই আসামি কী প্রকৃতির৷ আমরা এই জঙ্গিদের ব্যাপারেও জানিয়েছিলাম৷’’
তার মতে, “ওই জঙ্গিদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেয়া হয়নি৷ মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের কারাগার থেকেই হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও ডান্ডাবেড়ি পরানোসহ আরো যেসব নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল তা নেয়া হয়নি৷ তাদের সাধারণ আসামিদের সঙ্গে আনাও ঠিক হয়নি৷ আমরা জঙ্গি বা দুর্ধর্ষ আসামিদের আলাদাভাবে আনতে বলি৷”
আমাদের দায়িত্ব হলো কারাগারের ভিতরে: তরিকুল ইসলাম
তবে আদালতে আনার পর জঙ্গিদের নিরাপত্তার বিষয়টি যথাযথভাবে নেয়া হয়নি বলে তিনি স্বীকার করেন৷ তিনি এজন্য জনবলের অভাবকে দায়ী করেন৷ তিনি বলেন, “আমার জনবলের সংকট আছে৷ প্রত্যেকদিন গড়ে ৫০০-৬০০ আসামি আসে৷ তাদের জন্য আমার আছে ১৫০ জন পুলিশ সদস্য৷ তাই পর্যাপ্ত পুলিশ জঙ্গিদের সঙ্গে দেয়া যায়নি৷”
এখন পর্যন্ত জঙ্গিদের ঘটনায় যে পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তারা সবাই প্রসিকিউশনের৷
আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার অবশ্য বলেন, “২০১৭ সালের মার্চে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো নিষিদ্ধ করেন৷ এটা জেলখানার মধ্যে কোনো অপরাধ করলে তার একটি শাস্তি৷ তবে আদালত আসামিদের ধরন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তার কথা বলেছে৷ আসামিদের অপরাধ ও ধরন বুঝে এটা করতে বলা হয়েছে৷”
তিনি বলেন, “জেল কোড অনুযায়ী, আসামিদের আদালত পর্যন্ত আনা এবং নিয়ে যাওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব৷ বাকিটা দেখে প্রসিকিউশন পুলিশ৷”
এসব বিষয় নিয়ে আইজি প্রিজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি৷
পুলিশের সাবেক ডিআইজি এবং গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সৈয়দ বজলুল করিম মনে করেন, “এখানে গোয়েন্দা ব্যর্থতাও আছে৷ এমনকি এই ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদেরও হাত থাকতে পারে৷ তা না হলে জঙ্গিরা আগে থেকে কীভাবে জানবে যে তাদের ছিনিয়ে নেয়া হবে৷ জঙ্গিদের সাথে তো কারো দেখা করার সুযোগ থাকার কথা না৷ আর মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জঙ্গি জানার পরও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা উদ্দেশ্যমূলকও হতে পারে৷”
গ্রেপ্তারকৃতের সঙ্গে আচরণ: আইন যা বলে, বাস্তবে যা হয়
গ্রেপ্তারকৃতদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে তা বলা রয়েছে বিভিন্ন আইন আর পুলিশের অপরাধ তদন্ত নির্দেশিকাতেও৷ কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই তা মানছে না৷ আইনের বরখেলাপ ঘটছে গণমাধ্যমের আচরণ ও সংবাদ পরিবেশনেও৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
কখন অপরাধী?
আইন অনুযায়ী আদালতে একজন ব্যক্তি অপরাধী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি নির্দোষ৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তারের পর তাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করে৷ গ্রেপ্তারকৃতের শরীরে ‘আমি জঙ্গি’, ‘চোর’, ‘মাদক ব্যবসায়ী’, ‘ইয়াবা কারবারি’, ‘ধর্ষক’-এমন পরিচয় ঝুলিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায়৷ গণমাধ্যমেও তাদের সেই ছবি, পরিচয় প্রকাশ ও প্রচার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
আদালতের আগে গণমাধ্যমে
২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া কোনো ব্যক্তিকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করার নির্দেশ দেয়৷ বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মিন্নিকে দেওয়া জামিন সংক্রান্ত রায়ে বলা হয়েছে, অপরাধের তদন্ত চলার সময় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করার আগেই গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অমর্যাদাকর এবং অ-অনুমোদনযোগ্য৷
ছবি: bdnews24
মিডিয়া ট্রায়াল
বিচারের আগেই কোন ব্যক্তিকে গণমাধ্যমে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপনের প্রবণতা মিডিয়া ট্রায়াল নামে পরিচিত৷ সম্প্রতি এমন মিডিয়া ট্রায়ালের ঘটনা বাড়ছে৷ যাচাই, বাছাই ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যের ভিত্তিতে কাউকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে৷ অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে এমন প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ সংশ্লিষ্ট আইন এবং সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতার নীতিমালাও অনুসরণ করা হচ্ছে না৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
হাতকড়া ও রশির ব্যবহার
পুলিশের অপরাধ তদন্ত নির্দেশিকায় বলা হয়েছে গ্রেপ্তারকৃত আসামি বা বিচারাধীন বন্দিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানোর সময় পলায়ন বন্ধের জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কঠোর ব্যবস্থা নেয় উচিত নয়৷ হাতকড়া ও দড়ির ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদাকর৷ অথচ নিখোঁজের ৫৪ দিন পর ২০২০ সালের মে মাসে সাংবাদিক কাজলকে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয়৷ সেই ছবি সমালোচনার জন্ম দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
শিশুদের সঙ্গে আচরণ
শিশু আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী, শিশুকে কোনোমতেই হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাবে না৷ কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এর ব্যাত্যয় ঘটায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ ২০১৯ সালের আগস্টে চট্টগ্রামে দুই শিশুকে হাতকড়া পরিয়ে হাজির করা হয়৷ ঢাকার আদালতে এমন একাধিক ঘটনার খবর বেরিয়েছে গণমাধ্যমে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Weigel
শিশুর ছবি
শিশু আইন ২০১৩-এর ৮১ ধারায় কোনো মামলায় বা অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনায় কোনো শিশুর ছবি বা পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷ বলা হয়েছে, বিচারাধীন কোনো মামলায় কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে কোনো শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, যার দ্বারা শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়৷ কিন্তু আদালতে শিশুদের হাজিরার শনাক্তযোগ্য ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
যেন পরিচয় প্রকাশ না পায়
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ (১) ধারায় সংবাদমাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ রয়েছে৷ বলা হয়েছে, এ ধরনের অপরাধের শিকার নারী, শিশুর সংবাদ এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে তাদের পরিচয় প্রকাশ না পায়৷ তবে এ ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম ঘটছে৷ ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, পরিচয় প্রকাশ করার ঘটনা ঘটেছে অনেক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Keystone USA Falkenberg
রিমান্ড মানে কি নির্যাতন?
কোনো মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশ আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে হেফাজতে নিতে পারে৷ কিন্তু শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করার এখতিয়ার নেই৷ এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনাও রয়েছে৷ কিন্তু বাংলাদেশে রিমান্ড আর নির্যাতন অনেকটা সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে৷ অনেক সময়ই রিমান্ডে নিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ শোনা যায়৷ পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও আছে৷