বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো দল আওয়ামী লীগ৷ এমনকি উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলগুলোর মধ্যে একটি এটি৷ কিন্তু একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলটি মানুষের আশা-আকাঙ্খার কতোটা পূরণ করতে পেরেছে?
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে৷ দেশের উন্নতি-অগ্রগতি অনেক কিছুই এসেছে এই দলের হাত ধরে৷ কিন্তু সহযোগী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানোসহ অনেক কিছুই এখনো না করতে পারার অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে৷
শনিবার ছিল দলটির ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী৷ দিনটি উদযাপনে বিশেষ কর্মসূচি পালন করে দলটি৷ সকালে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়৷ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে নবনির্মিত প্রধান কার্যালয়ের সামনে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন ও নতুন কার্যালয় উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী ও দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা৷
সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ সেখানে তৃণমূল থেকে আসা ৪ হাজার ১৩৪ জন নেতা অংশ নেন৷ নির্বাচন নিয়ে ওই বৈঠকে দিকনির্দেশনা দেন দলীয় সভাপতি৷
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পথে মানুষের রায়কে গুরুত্ব দিতে দলের নেতাদের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা৷ দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি৷
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে৷ এরপর বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ৷ আগামী ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে৷
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১ বার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য৷
ছবি: Anupam Nath/AP/picture alliance
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সে সময় ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়৷ আর সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ১৫টি৷ ঐ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ৭ এপ্রিল, তেজগাঁওয়ে অবস্থিত তখনকার জাতীয় সংসদ ভবনে৷ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়লাভ করে৷ বঙ্গবন্ধু সে সময় ঢাকা-১২ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন৷
ছবি: AP
দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন, প্রথম নারী সাংসদ
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ হয়৷ সেবার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ৩০টি৷ তবে ঐ সংসদেই প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ ভোটে একজন নারী সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ খুলনা-১৪ থেকে নির্বাচিত হন সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ৷ প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২ এপ্রিল৷ নির্বাচনে মাত্র মাস ছয়েক আগে প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি ২০৭টি আর আওয়ামী লীগ ৫৪টি আসন পেয়েছিল৷
ছবি: imago stock&people
তৃতীয় সংসদ নির্বাচন
ভোটগ্রহণ হয় ১৯৮৬ সালের ৭ মে৷ জাতীয় পার্টি ১৫৩টি, আওয়ামী লীগ ৭৬টি আর জামায়াতে ইসলামী ১০টি আসন পায়৷ বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছিল৷
ছবি: http://www.parliament.gov.bd
চতুর্থ সংসদ নির্বাচন
১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ আওয়ামী লীগ, বিএনপি সহ বেশ কয়েকটি দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিল৷ জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছিল ২৫১টি৷ সংরক্ষিত মহিলা আসন সংক্রান্ত আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এই সংসদে মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩০০টি৷
ছবি: http://www.parliament.gov.bd
পঞ্চম সংসদ নির্বাচন
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি, আওয়ামী লীগ ৮৮টি আর জাতীয় পার্টি ৩৫টিতে জয়লাভ করে৷ এছাড়া নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ৩০ জন মহিলাকে সাংসদ নির্বাচিত করা হয়৷ অবশ্য তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সংবিধানের অংশ ছিল না৷ পরের সংসদে সেই বিল পাস হয়েছিল৷
ছবি: Getty Images
ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি৷ আওয়ামী লীগ সহ অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করেছিল৷ ফলে মোট ভোট গৃহীত হয়েছিল মাত্র ২১ শতাংশ৷ ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি ২৭৮টিতে জয়লাভ করেছিল৷ মাত্র চার কার্যদিবসে সংসদ বসার পর তা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়৷ এই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়৷
ছবি: picture-alliance/Dinodia Photo
সপ্তম সংসদ নির্বাচন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৬ ও জাতীয় পার্টি ৩২টি আসনে জয়লাভ করে৷ পরে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ৷
ছবি: Reuters
অষ্টম সংসদ নির্বাচন
ভোটগ্রহণ হয় ২০০১ সালের ১ অক্টোবর৷ অষ্টম সংসদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০০টি৷ কারণ সংরক্ষিত মহিলা আসন সংক্রান্ত আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শুরুতে কোনো মহিলা আসন ছিল না৷ পরে আইন করে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ এ উন্নীত করা হয়৷ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ আর আওয়ামী লীগ ৬২টি আসনে জয়ী হয়েছিল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
নবম সংসদ নির্বাচন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত সবশেষ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর৷ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার পেয়েছিল ২৬৩টি আসন৷ আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট পায় ৩৩টি আসন৷
ছবি: picture-alliance/A.A./N. Kumar
দশম সংসদ নির্বাচন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি৷ ফলে ১৫৩ জন সাংসদ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই সাংসদ নির্বাচিত হন৷
ছবি: DW/M. Mamun
একাদশ সংসদ নির্বাচন
বাংলাদেশের সবশেষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৮ সালে৷ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া এই নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের ২৮৮টিই পেয়েছিল ক্ষমতাসীন দল ও মহাজোট৷ সেই নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট পড়েছে পাঁচ ভাগের চার ভাগ৷ ঘটেছে নজিরবিহীন ঘটনাও৷ ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে৷ প্রায় আট হাজার কেন্দ্রে পড়েছে ৯০ শতাংশের বেশি৷
ছবি: Anupam Nath/AP/picture alliance
11 ছবি1 | 11
বিশ্লেষকরা বলছেন, সমালোচনা সহ্য করতে না পারার ফলে দলটিতে গণতান্ত্রিক চর্চা কমে গেছে৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘মুসলিম শব্দটি ফেলে দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ জনগণের দলে পরিণত হয়েছিল৷ দেশ স্বাধীন হয়েছে এই দলের হাত ধরেই৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের কাজটিও শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের হাত ধরেই৷ দেশের জনগণের জন্য অনেক কিছুই করেছে দলটি৷''
Pof. Sayed Anwar Hossain 23.06.18 - MP3-Stereo
তবে দলটি কিছু ক্ষেত্রে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বলেও মনে করেন তিনি৷ তাঁর মতে, দলের নীতিনির্ধারকরা ‘‘পারেননি সহযোগী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করতে৷ পারেননি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে৷ তবে দারিদ্রের হার কমেছে এটা স্বীকার করতেই হবে৷ আবার হেফাজতের মতো স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মানুষের আশা-আকাঙ্খাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে৷''
আওয়ামী লাগের রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে যখন দলটি গড়ে ওঠে, তখন জনসম্পৃক্ততা ছিল৷ সোহরাওয়ার্দীর সময়ে কিছু সমস্যা ছিল৷ তবে শেখ সাহেব দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর রাতারাতি জনপ্রিয় দলে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ৷ বিশেষ করে ৬ দফা দেয়ার পর থেকেই৷''
Pof. Abul Kasam Fajlul Haq 23.06.16 - MP3-Stereo
কিন্তু আত্মসমালোচনা না করা দলটির সবচেয়ে বড় ঘাটতি বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘দলের মধ্যে গণতন্ত্র বা আত্মসমালোচনা একেবারেই নেই৷ সবাই ভুল করে৷ তারাও যে ভুল করতে পারে সেটা তারা একেবারেই স্বীকার করে না৷ ১৯৯৬ সালে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যদি আমরা কোন ভুল করে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দিয়েন৷ এরপর আর তাঁরা ভুলের কথা কখনও বলেনি৷ এই জায়গাটায় একটা বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে বলেই আমার মনে হয়৷''
তবে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে নারাজ আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সারা বিশ্বেই যুব সমাজের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে৷ উন্নত দেশগুলোতেও অস্থিরতা চলছে৷ সেখানে স্কুলে ঢুকে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে৷ আমরা তো বিশ্বের বাইরে নয়৷ এ কারণে এখানে কিছু অস্থিরতা আছে৷ তবে সেটা বড় কিছু নয়৷''
AL Mahabubul Alam Hanif 23.06.18 - MP3-Stereo
স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে সখ্যতার অভিয়োগ বিষয়ে হানিফ বলেন, ‘‘এটা নিয়ে মানুষ ভুল বোঝে। ১৯৯৬ সালে যখন বিএনপি একতরফা নির্বাচন করল, তখন আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে৷ সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পেছনে অনেকেই এসেছে৷ জামায়াতে ইসলামীও এসেছিল৷ আওয়ামী লীগ তো তাদের আনিনি৷ জোটও করেনি৷ এটা নিয়ে অপপ্রচার করা হয়, যেটা আদৌ সত্য নয়৷ আওয়ামী লীগ বিরোধীরাই এটা করে৷''