ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আসন্ন নির্বাচনের আগে যে ‘উপহার' পেলেন, তা লটারি জেতার থেকে কম নয়৷ ব্রেক্সিটপন্থি ভোটারদের সমর্থন আদায়ের পথে এতকাল তাঁর টোরি দলের সামনে বাধা হয়ে ছিল ব্রেক্সিট পার্টি৷ একই আসনে দুই দলের প্রার্থী থাকায় ব্রেক্সিটপন্থি ভোটে বিভাজন এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না৷ সোমবার ব্রেক্সিট প্রার্থীর প্রধান নাইজেল ফারাজ আচমকা সেই সব আসন থেকে দলের প্রার্থী প্রত্যাহারের ঘোষণা করেন, যেখানে গত নির্বাচনে টোরি দলের জয় হয়েছিল৷ ফলে ৩১৭টি আসনে টোরি দলের সামনে একটি বড় বাধা দূর হলো৷ ফারাজ বলেন, তাঁর দল এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাকি ২৬২টি আসনে লেবার পার্টি, উদারপন্থি লিবডেম ও ব্রেক্সিট-বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ভোট আদায় করতে চায়৷
এই আংশিক সুখবরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও জনসনের দুশ্চিন্তা কিন্তু কমছে না৷ কারণ সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হলে বর্তমান আসনগুলি ধরে রাখার পাশাপাশি তাঁর দলকে আরও কিছু আসনে জয়লাভ করতে হবে৷ কমপক্ষে আরও নয়টি আসন পেলে সেই লক্ষ্য পূরণ হবে৷ ফারাজের প্রার্থীরা সেখানে এখনো বাধা সৃষ্টি করবেন৷ সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে জয়লাভ করলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্রেক্সিট পার্টির সঙ্গে জোট বাঁধতে হতে পারে৷
নাইজেল ফারাজের এমন বোধোদয়ের পেছনে কারণ কী? তিনি বলেন, জনসন ২০২০ সালের পর ব্রেক্সিটের সময়সীমা না বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন৷ সেইসঙ্গে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক সমন্বয় ছাড়াই ক্যানাডার ধাঁচে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির লক্ষ্য তুলে ধরেছেন৷ ফারাজ বলেন, দেশের স্বার্থে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন৷
ফারাজের দলের একাংশ ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকরাও ঐক্যের জন্য চাপ সৃষ্টি করছিলেন৷ ব্রেক্সিটপন্থি শিবিরে বিভাজনের ফলে ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে বলে তাঁদের মনে আশঙ্কা রয়েছে৷ উল্লেখ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ফারাজের সঙ্গে এক রেডিও সাক্ষাৎকারে ব্রেক্সিটপন্থি শিবিরে ঠিক এমন ঐক্যেরই ডাক দিয়েছিলেন৷ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি কর্বিন সোমবার সেই সংলাপের উল্লেখ করে বলেন, ফারাজ সেই নির্দেশ মানায় এবার ট্রাম্পের সাধ পূরণ হলো৷
নির্বাচনে জনসন ও ফারাজের দল যথেষ্ট আসন পেয়ে জোট বা সমঝোতার পথে গেলেও দুই পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য থেকে যেতে পারে৷ নাইজেল ফারাজ চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের দাবিতে অটল রয়েছেন৷ অন্যদিকে জনসন আবার সরকার গঠন করতে পারলে সংসদে দ্রুত ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন করিয়ে ব্রেক্সিট কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর৷ সে ক্ষেত্রে দুই নেতার মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, ডিপিএ)