যে সংসদকে ‘নিষ্ক্রিয়' করে নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, তার সঙ্গে একের পর এক সংঘাতে হেরে যাচ্ছেন তিনি৷ বুধবারও তাঁকে একাধিক বিষয়ে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে৷ আগামী কয়েক দিনেও বরিস জনসনকে তাঁর ঘোষিত নীতির পথ থেকে সরে আসতে হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
আগামী ১৭ ও ১৮ই অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলনে ব্রেক্সিট সম্পর্কে আগামী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী বরিস জনসনের সরকার হয় তার আগে ইইউ-র সঙ্গে বোঝাপড়া করতে সক্ষম হবে, অথবা ৩১শে অক্টোবর ব্রিটেন চুক্তি ছাড়াই ইইউ ত্যাগ করবে৷ এই শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করেই ব্রিটেনের সংসদে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী পক্ষ ও সরকার পক্ষের কয়েকজন ‘বিদ্রোহী' সংসদ তাঁদের রণকৌশল স্থির করেছেন৷ বুধবার তাঁরা চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে সংসদে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করতে সক্ষম হয়েছেন৷ ফলে ১৯শে অক্টোবরের মধ্যে ইইউ-র সঙ্গে বোঝাপড়া না হলে সরকারকে ব্রেক্সিটের মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়ানোর আবেদন করতে হবে৷ নিম্ন কক্ষের পর উচ্চ কক্ষেরও সম্মতি প্রয়োজন৷ তারপর রানি সাক্ষর করলে এই প্রস্তাব আইন হিসেবে কার্যকর হবে৷ কিন্তু হাউস অফ লর্ডস এর মধ্যেই ৯০টি সংশোধনীসহ প্রস্তাবটি আবার হাউস অফ কমন্সে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ায় গোটা প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ঘটতে পারে৷ সবকিছু ঠিকমতো চললে আগামী সোমবার এই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হতে পারে৷
এই অবস্থায় বিরোধীরা জনসনের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না৷ প্রধানমন্ত্রী ১৫ই অক্টোবর আগাম নির্বাচনের যে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, লেবার পার্টির সংসদ সদস্যরা ভোটদানে বিরত থাকায় বুধবার সংসদে সেটি পাশ হয় নি৷ চুক্তিহীন ব্রেক্সিট নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত বিরোধী পক্ষ নির্বাচনের পক্ষে সমর্থন জানাতে প্রস্তুত নয়৷ তাছাড়া ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের আগে তাঁরা কোনোমতেই নির্বাচন চান না৷ বরিস জনসনের ব্রেক্সিট নীতির চূড়ান্ত ফলাফল স্পষ্ট হবার পরেই জনগণের রায় জানতে চান বিরোধীরা৷ তাছাড়া ১৫ই সেপ্টেম্বর নির্বাচন হলে এবং তাতে জনসন জয়লাভ করলে তিনি চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের প্রস্তাব বাতিল করতে পারেন, বিরোধী এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিতে পারছে না৷
প্রধানমন্ত্রী জনসন বিরোধীদের এই অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেছেন৷ তাঁর ব্রেক্সিট সংক্রান্ত পরিকল্পনা বানচাল করে সংসদ কার্যত ব্রাসেলসের সঙ্গে দরকষাকষি বন্ধ করে দিয়ে ইইউ-র হাতেই ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে৷ তাছাড়া এই প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্রেক্সিটের পক্ষে গণভোটের রায়ও উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন৷ বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলানোর কারণে টোরি দল ২১ জন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে৷
ব্রিটিশ রাজনীতির এমন উত্তাল পরিস্থিতি সত্ত্বেও ইইউ অবিচল রয়েছে৷ ব্রাসেলসে ইইউ কূটনীতিকরা আবার জানিয়ে দিয়েছেন, যে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না৷ আয়ারল্যান্ড মনে করিয়ে দিয়েছে, যে জনসনের সরকার এখনো ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার কোনো বিকল্প সমাধানসূত্র পেশ করে নি৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স)