ব্রিটিশ সংসদে ব্রেক্সিট নিয়ে তর্কবিতর্কের পালা শেষ৷ এবার ব্যালট বাক্সে সমর্থনের লড়াইয়ে নামছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও লেবার নেতা জেরেমি কর্বিন৷ কিন্তু দলমত নির্বিশেষে ব্রিটেনে ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে যে বিভাজন দেখা যাচ্ছে, তার ফলে দুই নেতার পক্ষে ঘর গুছিয়ে ভোটারদের মন জয় করা কঠিন হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ার মারাত্মক প্রভাব নিয়েও হিসেব-নিকেশ চলছে৷
১২ই ডিসেম্বর আগাম নির্বাচনে বরিস জনসন নিজের এক জোরালো ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চান৷ তাঁর মতে, নির্বাচনে বিপুল জয়ের মাধ্যমে একমাত্র তিনিই জানুয়ারি মাসে ব্রেক্সিটের প্রশ্নে জনগণের রায় কার্যকর করতে পারেন৷ যাবতীয় বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে তিনিই ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে নতুন ব্রেক্সিট চুক্তি আদায় করেছেন৷ ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সংসদে জেরেমি কর্বিনের বাধার কারণে ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবি করছেন জনসন৷ ফলে দেশের মানুষ ও ব্যবসা বাণিজ্য জগত আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে গেল৷ ব্রেক্সিট পর্ব সেরে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে মন দিতে হবে, বলেন জনসন৷
অন্যদিকে লেবার নেতা কর্বিন টোরি দলের দীর্ঘ শাসনকালের পর ব্রিটেনে প্রকৃত পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছেন৷ সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার আওতায় তিনি রেল, ডাক ও পানি সরবরাহ পরিষেবাকে আবার সরকারি মালিকানায় আনতে চান৷ কর্বিনের অভিযোগ, টোরি দল দীর্ঘদিন ধরে শুধু ধনীদের স্বার্থরক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারি ব্যয় কমিয়ে এসেছে৷ সাধারণ মানুষকে সেই নীতির কুফল ভোগ করতে হয়েছে৷ তাঁর মতে, এক প্রজন্মের মধ্যে সমাজের এমন রূপান্তরের সুযোগ আর পাওয়া যাবে না৷ জনসন নির্বাচনে জিতলে ব্রিটেনের স্বাস্থ্য পরিষেবা মার্কিন কোম্পানির হাতে চলে যাবে বলে কর্বিন সতর্ক করে দিয়েছেন৷
বর্তমানে জনমত সমীক্ষায় নেতা হিসেবে জনসন ও দল হিসেবে টোরি এগিয়ে থাকলেও সেই হিসেব এলোমেলো হবার একাধিক সম্ভাবনা রয়েছে৷ প্রথমত, জনসন ব্রেক্সিট কার্যকর করতে ব্যর্থ হওয়ায় নাইজেল ফারাজ-এর ব্রেক্সিট পার্টি ব্রেক্সিটপন্থি ভোটারদের আরও সমর্থন পেতে পারে৷ দুই দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে ব্রেক্সিটপন্থিদের ভোটে বিভাজনের ফলে অন্য প্রার্থীরা লাভবান হবেন৷ টোরি ও লেবার দলের মধ্যে ‘বিদ্রোহী'-দের সংখ্যাও কম নয়৷ তাঁরা আদৌ প্রার্থী হতে পারবেন কিনা, তার উপর দলের ঐক্য নির্ভর করবে৷
নেতা হিসেবে কর্বিন নিজের লেবার দলের মধ্যেও যথেষ্ট সমর্থন পাচ্ছেন না৷ ব্রেক্সিট সম্পর্কেও তাঁর কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেই৷ কখনো বলেছেন, তিনি আবার নতুন করে ইইউ-র সঙ্গে আলোচনা করে ব্রেক্সিট চুক্তির মধ্যে পরিবর্তন আনতে চান৷ দ্বিতীয় গণভোটের মাধ্যমে সে বিষয়ে চূড়ান্ত রায়ের কথাও বলেছেন তিনি৷ তাঁর ঘোষিত রাষ্ট্রীয়করণের নীতির ফলে ব্রিটেনের অর্থনীতির ক্ষতি হবে বলে টোরি দল সাবধান করে দিচ্ছে৷
ইইউ-পন্থি ভোটাররা মূলত উদারপন্থি লিবডেম দলের প্রতি সমর্থন জানাতে পারবেন৷ স্কটল্যান্ডের এসএনপি দলও সেখানকার ইউরোপপন্থি ভোটারদের মন জয় করতে পারে৷ ইউরোপ-বিরোধী ও ইউরোপপন্থি ভোটারদের ঘিরে জনসমর্থনের প্রতিফলন দেখা দিলে ত্রিশঙ্কু সংসদের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ সে ক্ষেত্রে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে যেতে পারে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, এএফপি)