প্রাকৃতিক সম্পদ
১২ মে ২০১২বাংলাদেশের মতো ‘তৃতীয় বিশ্ব'-এর বহু দেশের একটা বড় সমস্যা হলো, প্রাকৃতিক সম্পদ বিপুল পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও সেই সম্পদ তারা নিজেদের কাজে লাগাতে পারেনি৷ সরকারের ভুল নীতি এবং বহুজাতিক কোম্পানিমুখী বিভিন্ন ধরনের নীতির কারণে আফ্রিকা বা ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলিতে সেই সম্পদ উত্তোলন হচ্ছে, হচ্ছে রপ্তানিও৷ কিন্তু এতে দেশগুলোর কোনো উন্নতি হয়নি৷ বরং বেড়েছে দারিদ্র্য এবং অপশাসন৷
এই অভিজ্ঞতাগুলো দেখে, বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে ‘তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষায় একটি জাতীয় কমিটি৷ ভারতে গ্যাস রপ্তানির উদ্যোগ বাংলাদেশের মানুষকে বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত করবে - এ দাবিতেই ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় এই সম্মিলিত জাতীয় কমিটি৷ যাতে যোগ দেন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র-ছাত্রী, এমনকি আইনজীবীরাও৷
প্রশ্ন, এ নীতি গঠনের পিছনে কী কাজ করেছিল? অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জানান, ‘‘আমাদের যে সম্পদ আছে, তা খুবই সীমিত৷ তেল-গ্যাস-কয়লা এগুলো অনবায়নযোগ্য৷ এগুলো ইচ্ছা করলেই আবারো নতুন করে সৃষ্টি করা যায় না৷ তাই ভুল নীতি যদি একবার হয়, সেটা সংশোধন করার কোনো উপায় নেই৷ তাছাড়া, এ সম্পদ শতভাগ জনগণের৷ তাই এটাকে শতভাগ জনগণের মালিকানাতেই থাকতে হবে৷ এটা হচ্ছে এক নম্বর কথা৷ দু'নম্বর হচ্ছে যে, এই সম্পদ রপ্তানি করা যাবে না৷ তৃতীয়ত, এই কাজগুলি করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বাংলাদেশে একটা দক্ষতা তৈরি হয়েছে৷ এই যেমন গ্যাস উত্তোলন, পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা, কয়লা ব্যবহার করা৷ সুতরাং, সেগুলোকেই কাজে লাগাতে হবে৷''
উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির মাধ্যমে কয়লা উত্তোলনের ফলে সারা পৃথিবীতে অনেক ক্ষতি হয়েছে৷ তবে যেসব দেশে ‘ওপেন পিট' আছে, সে সব দেশে আবাদি জমি কম, জনবসতিও তেমন নেই৷ অথচ বাংলাদেশে প্রত্যেক ইঞ্চি জমি কিছু না কিছু উৎপাদন করে৷ মাটির নীচে একটু খুঁড়লেই পানি পাওয়া যায়, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা এখানে প্রায় ১,২০০ থেকে ১৩,০০ জন৷
স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাদেশ থেকে কয়লা তুলে বিদেশে রপ্তানি করা হলে সর্বনাশ হতো৷ এতে কয়লা যেত, মানুষ যেত, আবাদি জমি নষ্ট হতো, ক্ষতি হতো খাদ্য নিরাপত্তারও৷ আর তাই, এক বিশাল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ৷ ফুলবাড়ির ঐ ঘটনায় জীবনও দিয়েছিল তারা৷
আনু মুহাম্মদের কথায়, ‘‘বাংলাদেশের মানুষের একটা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও চেতনা তৈরি হয়েছে এ ব্যাপারে৷ আর সে জন্যই বাংলাদেশ নাইজেরিয়ার মতো একটি অভিশপ্ত দেশে পরিণত হয় নি৷ কিন্তু তার অর্থ এটা না যে, বাংলাদেশ এর থেকে পুরোপুরি মুক্ত৷ সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে৷ যা রপ্তানির জন্য নিতে চাইছে বিদেশি কোম্পানি৷ আসলে বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, তাদের নিজেদের মধ্যে বহু বিষয়ে মারামারি হলেও, জনস্বার্থ বিরোধী নীতির ব্যাপারে খুব বেশি মতানৈক্য দেখা যায় না৷ কমিশনভোগীরা দেখা যায় দুই পক্ষেই বেশ শক্তিশালী৷''
বলা বাহুল্য, বর্তমানে উন্মুক্ত কয়লা খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধ৷ সারা বিশ্বে এখন ‘ক্লিন এনার্জি', ‘ক্লিন কোল' ইত্যাদি নিয়ে নানা রকম গবেষণা চলছে৷ ‘‘কিন্তু বাংলাদেশে এক্ষেত্রে তখনই কিছু করা সম্ভব হবে, যখন সব রকম ‘কর্পোরেট ইন্টারেস্ট'-এর প্রভাবমুক্ত হতে পারবো আমরা'', জানান অধ্যাপক মুহাম্মদ৷ বলেন, ‘‘আমরা পানি সম্পদের দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধ৷ তাই এই কয়লা তুলতে গিয়ে পানিসম্পদ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না৷ অর্থনৈতিকভাবে এর কোনো যুক্তিও নেই৷ তার ওপর বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঝুঁকি রয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এতে আমাদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে, ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়তে পারে সাধারণ মানুষ৷''
তাই আনু মুহাম্মদের মন্তব্য, ‘‘কি ধরনের পদ্ধতিতে আমরা কয়লার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারি, তা নির্ধারণ করতে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন৷ এবং তার আগ পর্যন্ত আমাদের যে গ্যাস সম্পদ রয়েছে, তা দিয়েই দূর করা উচিত বিদ্যুতের সমস্যা৷''
সাক্ষাৎকার: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন