ইংরেজিতে বলে ‘পার্মাফ্রস্ট', অর্থাৎ যে জমির তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে, যেমন সাইবেরিয়ায়৷ হিট ওয়েভে সেখানকার পার্মাফ্রস্ট গলতে শুরু করায় অ্যানথ্র্যাক্স ব্যাকটেরিয়া বের হয়ে পড়ে৷ অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে৷
বিজ্ঞাপন
পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানকার মাটি শীতে জমে পাথর হয়ে আছে৷ গরমে হয়ত দু'মিটার গভীরতা অবধি মাটি নরম হয়ে আসে, কিন্তু শীত পড়লেই আবার জমে যায়৷ যে মাটি দু'বছর কিংবা তার বেশি সময় ধরে হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রায় জমে আছে, তাকেই বলে পার্মাফ্রস্ট৷ ভূপৃষ্ঠের বিশ শতাংশ এই পার্মাফ্রস্টে ঢাকা৷
সর্বাধিক পার্মাফ্রস্ট পাওয়া যাবে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে, যার মধ্যে পড়বে সাইবেরিয়া, ক্যানাডার উত্তরাঞ্চল, অ্যালাস্কা ও গ্রিনল্যান্ড৷ আন্ডিজ পর্বতমালা, এমনকি আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো পাহাড়ের চূড়াতেও পার্মাফ্রস্ট পাওয়া যাবে৷
কিন্তু বিশ্বের উষ্ণায়নের ফলে পার্মাফ্রস্টের তাপমাত্রা বাড়ছে, সেই সঙ্গে কমছে তার ঘনত্ব৷ আইপিসিসি-র বিবরণ অনুযায়ী ১৯৯২ সাল যাবৎ দক্ষিণ অ্যালাস্কায় পার্মাফ্রস্টের ঘনত্ব কমছে বছরে চার মিলিমিটার হারে৷ কিন্তু তার ফল?
ভুতুড়ে জীবাণু
সপ্তাহ খানেক আগে অ্যানথ্র্যাক্স জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে এক কিশোরের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় সাইবেরিয়া থেকে৷ সেই সঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়েন নাকি আরো ২০ জন মানুষ৷ কিন্তু কোথা থেকে এলো এই জীবাণু? এই অ্যানথ্র্যাক্স জীবাণু নাকি পার্মাফ্রস্টের তলায় জমে থাকা বলগা হরিণের লাশে লুকনো ছিল একশ' বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে – বলছেন বিজ্ঞানীরা৷
অ্যানথ্র্যাক্স জীবাণু এতদিন ধরে বেঁচে থাকতে পারে ‘স্পোর' বা বীজগুটি হিসেবে৷ কিন্তু অপরাপর জীবাণুরও তো সে ক্ষমতা আছে৷ এবং তাদের মধ্যে বেশ কিছু জীবাণু আবার প্যাথোজেন, অর্থাৎ তাদের মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষমতা আছে – টিটেনাস জীবাণু এই দলে পড়ে৷ কিন্তু কী পরিমাণ জীবাণু আছে পার্মাফ্রস্টে?
নরওয়ের স্পিট্সবার্গেনে স্থায়িভাবে জমে থাকা প্রতি গ্রাম মাটিতে দশ লক্ষ থেকে এক কোটি জীবাণু খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ তাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ নাকি ডিফ্রস্টিং-এর পরেও বেঁচে ছিল৷
সাগরের গভীরে বিস্ময়
ইউনেস্কো বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের সমুদ্রের তলদেশের এমন পাঁচটি স্পট চিহ্নিত করেছেন যা বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেতে পারে৷ তাদের ধারণা বেশিরভাগ মানুষই এদের খোঁজ জানেন না৷ ছবিঘরে দেখুন সেই ৫টি স্থান৷
ছবি: The Natural Environment Research Council and IUCN/GEF Seamounts Project C/O Alex D Rogers
গভীরে যাও, অনেক দূরে এবং বিস্মিত হও
কোনো দেশের সীমানার মধ্যে পড়ে না সমুদ্রের এমন পাঁচটি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয়ার কথা ভাবছে ইউনেস্কো৷ এসব এলাকা যেমন সুন্দর, তেমনি বিরল সব প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাস সেখানে৷
ছবি: Kevin Raskoff/NOAA/Wikipedia
‘লস্ট সিটি’
মধ্য-আটলান্টিকের প্রায় ৮০০ মিটার গভীরে অবস্থিত এই এলাকায় থাকা অসংখ্য ছিদ্র থেকে মিথেন আর হাইড্রোজেন গ্যাস বের হয়৷ ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেখানকার ইকোসিস্টেম পৃথিবীর অন্য যে-কোনো জায়গার চেয়ে একেবারে ভিন্ন৷ ২০০০ সালে এই ছিদ্রগুলোর দেখা পান বিজ্ঞানীরা৷ তাঁদের ধারণা, প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বছর ধরে এরকম হচ্ছে৷
ছবি: Woods Hole Oceanographic Institute and Charles Fisher, Pennsylvania State University
কোস্টারিকা থার্মাল ডোম
ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলে ৫০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই স্থানটি৷ ইউনেস্কো এটিকে ‘সামুদ্রিক মরুদ্যান’ হিসেবে উল্লেখ করেছে৷ এখানে বিশাল বিশাল আকারের মাছ, স্তন্যপায়ী এবং হাঙর, টুনা, ডলফিন ও তিমি রয়েছে৷ বিশেষ করে এখানেই আছে নীল তিমি৷ আর বিরল প্রজাতির লেদারব্যাক কচ্ছপও দেখা যায় এখানে৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE
সাদা হাঙর ক্যাফে
মেরিন বায়োলজিস্টরা ঠিক এই নামটিই দিয়েছেন৷ আসলে এটি কোনো কফি হাউজ নয়, উত্তর অ্যামেরিকার মেইনল্যান্ড এবং হাওয়াই এর মাঝামাঝি অবস্থান এটির৷ খালি চোখে এটিকে তেমন বিশেষ কিছু মনে হবে না৷ কিন্তু সাদা হাঙর সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই এলাকায়৷ এখানেই তারা খাবার খায় এবং প্রজনন করে৷
ছবি: Pterantula (Terry Goss) via Wikimedia Commons
সারগাসো সাগর
ধারণা করা হয় ১৪৯২ সালে কলোম্বাস এই স্থানটি প্রথম ভ্রমণ করেছিলেন৷ বারমুডার দ্বীপগুলো সারাগাসো সাগরের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে৷ এর বিশেষত্ব হলো ভাসমান শৈবাল, মেরিন বায়োলজিস্টরা যাকে বলছেন, ‘ভাসমান স্বর্ণালী রেনফরেস্ট’৷ এছাড়া এলাকাটি ইউরোপীয় ও অ্যামেরিকান ইল মাছদের প্রজনন ক্ষেত্র৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Courtesy Chris Burville
আটলান্টিকের তীর
ভারত মহাসাগরের আটলান্টিকের তীরে সমুদ্রের ৭০০ থেকে ৪,০০০ মিটার গভীরে প্রবাল প্রাচীর, খাড়ি, সমুদ্র সৈকত এবং লেগুনে দেখা মিলবে বড় বড় বায়ুপরাগী ফুল, চেয়ারের সমান স্পঞ্জ এবং শৈবালের৷ এটি আসলে একটি দ্বীপ, যেটি কয়েক লক্ষ বছর আগে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল৷
ছবি: The Natural Environment Research Council and IUCN/GEF Seamounts Project C/O Alex D Rogers
6 ছবি1 | 6
২০১৪ সালে ফরাসি ও রুশ গবেষকরা সাইবেরিয়ার পার্মাফ্রস্ট থেকে এক অজ্ঞাত, সুবিশাল ভাইরাস খুঁজে পান, যার ব্যাস ছিল এক মাইক্রন – যা কিনা যাবতীয় জ্ঞাত ভাইরাসের প্রায় এক হাজার গুণ বেশি! ভাইরাসটি অবশ্য মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর নয়৷ এই ভাইরাস নাকি ৩০ হাজার বছর ধরে পার্মাফ্রস্টের মধ্যে জমে ছিল৷ কিন্তু গলানোর পরেই সেই ভাইরাস একটি অ্যামিবাকে সংক্রমিত করতে সক্ষম হয়৷
মনে রাখতে হবে ভাইরাসরা আমাদের অর্থে ‘বাঁচে' না, কাজেই তারা মরেও না৷ গরমে তারা ধ্বংস হতে পারে, নিম্ন তাপমাত্রায় নয়৷ রুশ গবেষকরা জমা মাটি থেকে তুষার যুগের এক ফুলকেও বাঁচিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন৷ সেই ফুল নাকি তখনও ফল ধরানোর অবস্থায় ছিল৷
কাজেই পার্মাফ্রস্টে ভুতুড়ে জীবাণুর বিপদ ছাড়া হারানো জীবনের হাতছানিও লুকিয়ে থাকতে পারে বৈকি৷
আলাস্কার হিমবাহে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বারাক ওবামা৷ সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে ছড়িয়ে পড়েছে সেই মুহূর্তগুলোর কিছু ছবি৷ ছবির মাধ্যমেই ওবামা ছড়িয়ে দিলেন একটি বার্তা – জলবায়ুর ক্ষতিকর পরিবর্তন রোধ করুন, পৃথিবীটাকে বাঁচান৷
ছবি: Reuters/J. Ernst
হিমবাহে কেন ওবামা?
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণায়ন বাড়ছে৷ সে কারণে খুব দ্রুত গলছে হিমবাহ৷ বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা৷ বিশ্বের নানা প্রান্তে নতুন নতুন স্থান প্লাবিত হচ্ছে৷ এসব বিষয় নিয়ে অনেক কথা হয় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ছোট-বড় সব সম্মেলনে৷ হিমবাহে উঠে সেসব কথাই মনে করিয়ে দিলেন ওবামা৷
ছবি: Reuters/J. Ernst
এই সৌন্দর্য, ওই আতঙ্ক
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন ওবামা৷ আলাস্কা সফরেও উষ্ণায়নের জন্য দায়ী কার্বন নিঃসরণ কমাতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷ আলাস্কার ‘এক্সিট গ্লেসিয়ার’ নামের হিমবাহে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওবামা৷ উষ্ণায়ন বৃদ্ধির কারণে এই বরফ গলতে শুরু করায় প্রতি বছর গড়ে ৪৩ ফুট করে ছোট হচ্ছে এক্সিট গ্লেসিয়ার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/Sgt. B. O'Neal
কিরিবাতির কান্না
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে মহাসংকটের মুখোমুখি প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র কিরিবাতি৷ কিরিবাতির সবচেয়ে উঁচু জায়গাটিই এখন প্রশান্ত মহাসাগরের পৃষ্ঠের উচ্চতার চেয়ে মাত্র তিন মিটার উঁচুতে৷ ভূমির লবণাক্ততা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে ফসল ফলানো অসম্ভব তো হতেই পারে, ধীরে ধীরে ৮১১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দ্বীপরাষ্ট্রটির সমুদ্রগর্ভে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায়না৷
ছবি: John Corcoran
কিরিবাতির এক যুগল
সেই আশঙ্কা থেকেই কিরিবাতির এই যুগল নিজেদের ‘জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার’ দাবি করে নিউজিল্যান্ডে অভিবাসী হতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু নিউজিল্যান্ডের আদালত তাঁদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে৷ আদালত মনে করে, শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞার আওতায় আসার উপযুক্ত নন কিরিবাতির এই যুগল৷
ছবি: DW/V. O'Brien
বাংলাদেশও শঙ্কার বাইরে নয়
বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশকে নিয়েও অনেক সময় অনেক ধরনের শঙ্কার কথা শোনা গেছে৷ জলবায়ুর ক্ষতিকর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ডুবে যেতে পারে – এমন শঙ্কার পক্ষেও যুক্তি দেখিয়েছেন কোনো কোনো পরিবেশবিজ্ঞানী৷ তবে বাংলাদেশের দু-একটি স্থান এখনই এমন শঙ্কার মুখে দাঁড়িয়ে৷ আশার চরের কথাই ধরুন৷ বঙ্গোপসাগরের কোলের এই ছোট্ট জনপদ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন হয়ে পড়ে৷