কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়ার স্বপ্ন সফল করতে কাশ্মীর ছিল মোদীর ‘মাস্টার স্ট্রোক'৷ এখন জোট সরকার ভেঙে দিয়ে গায়ের জোরে শান্তি ফেরাতে বদ্ধপরিকর তাঁর সরকার৷
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনোত্তর দু'টি রাজনৈতিক দলের জোট আরেকটি নির্বাচন আসার আগেই ভেঙে ফেলতে হয়৷ তা না হলে একক শক্তি বৃদ্ধি হবে কী করে? কাশ্মীরে আফজল গুরুর ফাঁসি হওয়ার সময় যে সূত্রটি ছেড়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, সেটিকেই সম্বল করলেন তাঁর উত্তরসূরি নরেন্দ্র মোদী৷ কাশ্মীরে পিডিপি এবং জম্মুতে বিজেপির জমি হারানোর হতাশা যখন এক বিন্দুতে এসে মিলল, সেই মুহূর্তেই প্রখ্যাত সাংবাদিক সুজাত বুখারির রক্তে ভিজল শ্রীনগরের রাজপথ৷ ‘পাথরপন্থি কাশ্মীরীদের' মুখে দাঁড়িয়ে কড়া বার্তা দিলেন নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহরা৷ দলকে গাঁটছড়া কেটে বেরিয়ে আসতে নির্দেশ দিলেন তাঁরা৷
রমজান মাসের পর কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযান পুণরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কেন্দ্র সরকার৷ তারপর থেকেই মেহবুবা মুফতির পিডিপি এবং বিজেপির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়৷ মুফতি চেয়েছিলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসুক সরকার৷ এরপর ঘটনাক্রম যেদিকে গড়িয়েছে তাতে কাশ্মীরে আপাত শান্তি ফিরে এলেও তা যে বেশি দিন স্থায়ী হবে না, তা বলার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না৷ দু'দিন আগে সাংবাদিক সুজাত বুখারি ও নিরীহ জনতার হত্যার প্রতিবাদে বনধ ডেকে ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট৷ বনধ শুরু হওয়ার আগেই গ্রেপ্তার করে নেওয়া হয় জেকেএএফ প্রধান ৫২ বছরের ইয়াসিন মালিককে৷ ইয়াসিন দীর্ঘদিন সশস্ত্র লড়াই চালালেও ১৯৯৪ সালে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনু্প্রাণিত হয়ে বন্দুক ছেড়ে, হিংসার পথ ছেড়ে শান্তির পথ ধরেছেন৷ কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন ইয়াসিন৷ তিনিই একমাত্র নেতা যিনি কাশ্মীরের ভারত কিংবা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি চান না৷ বলে রাখা ভালো, তাঁর হাত ধরেই কাশ্মীরে সশস্ত্র আন্দোলন ভয়ানক আকার ধারণ করেছিল৷ এ পর্যন্ত ৩০০ বার গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি৷ বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ি থেকে আবার ইয়াসিন মালিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ তাঁকে কোঠিবাগ থানায় রাখা হয়েছে৷ ওদিকে, গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে হুরিয়ত নেতা মিরওয়াইজ, হুরিয়ত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান সৈয়দ আলি শাহ গিলানিকে৷
১৯৬৬ সালে শ্রীনগরে জন্মানোর পর থেকেই কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের হিংসার সাক্ষী থেকেছেন তিনি৷ চূড়ান্ত ক্ষোভ থেকে ১৯৮০ তে দল গড়েন৷ নাম দেন ‘তালা পার্টি'৷ তারপর একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে বিতর্কিত নানা বিষয় ছাপিয়ে বিলি করতে থাকেন৷ তার ফলে ক্রমশ অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে কাশ্মীরে৷ ১৯৮৩ সালে কাশ্মীরের শের-ই কাশ্মীর স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ম্যাচ ভেস্তে যায় তাঁর কারণেই৷ ওই সময় একের পর এক ঘটনায় ঘটাতে থাকেন তিনি৷ সেবারই প্রথম চার মাসের জন্য গ্রেপ্তার হন ইয়াসিন৷ তারপর ‘তালা পার্টি'-র নাম বদলে রাখেন ‘ইসলামিক স্টুডেন্টস লিগ'৷ ওই সংগঠন কাশ্মীরে যুব আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে ওঠে৷ ‘আজাদ কাশ্মীর'-এর দাবিতে সরব হতে থাকেন ইয়াসিন মালিক৷ পাকিস্তানে গিয়ে রীতিমতো অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্রমে সশস্ত্র আন্দোলনকারী হয়ে ওঠেন৷ তারপর ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরে ফিরে আসেন জেকেএলএফ-এর সদস্য হয়ে৷ কাশ্মীরের স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন৷
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
ছবি: Reuters
19 ছবি1 | 19
প্রায় তিন দশক ধরে কাশ্মীরের সংবাদ পরিবেশন করছেন প্রবীন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানালেন, ‘‘‘১৯৯০ থেকে দেখছি, সরকার মাঝে মধ্যে এমন কড়া ভূমিকা নেয়৷ কিছু দিন পর আবার পুরোনো অবস্থায় ফিরে আসে৷ এটা দু'টো জিনিসের ওপর নির্ভর করে৷ এক, কাশ্মীরের অভ্যন্তরে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনা৷ এবং দুই, প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা৷ বেশ কিছুদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা বহুদিন বন্ধ হয়ে রয়েছে৷ এখন কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি কীভাবে ভালো করা যায়, তা ভাবা প্রয়োজন৷''
স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রথম কাশ্মীরে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের হাত ধরে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি৷ নেহাৎ ক্ষমতার লোভেই, নীতি আদর্শে একেবারে দুই মেরুর দু'টি দল হাত মিলিয়েছিল৷ এমন প্রমাণ দিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ আগামী কিছু দিন আরও ধরপাকড় হতে পারে৷ আরও বেশি সেনা সক্রিয়তা দেখা যেতে পারে৷
রাজ্যপালের শাসন চলছে৷ কাশ্মীরে এবার ভোট হবে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের দাবিতে৷ এই ধারায় জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া রয়েছে৷ ৩৭০ বাতিলের দাবিতে মুখর হয়ে বিজেপি থাকবে এক মেরুতে৷ একা৷ অন্য মেরুতে থাকবে কংগ্রেস, ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপি, এমনকি হুরিয়ত-সহ আরও কট্টরপন্থি ইসলামিক শক্তি৷ মেরুকরণের এমন অস্ত্রে কাশ্মীরে যাই হোক, জম্মুতে কিন্তু নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্য বিজেপির৷ আর একঘরে মেহবুবার পিডিপি-কে দেখিয়ে কাশ্মীরের জনজোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর ওমর আবদুল্লাহ৷ তা সে সংগঠনের জোরে হোক বা গত ৩ বছর কাশ্মীরে ‘ম্লেচ্ছ'-দের সঙ্গে ঘর করার দরুন বিজেপির সমর্থন ধসে যাওয়ার তোড়ে জম্মুতে কংগ্রেস আগামী কয়েক মাসে গুছিয়ে নিতে পারে কিনা সেদিকে নজর সবার৷
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌম্যর মতে, ‘‘গত ২৫-৩০ বছরে ভারতের কাশ্মীর নীতির জন্য সেখানকার পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তন হয়নি৷ অশান্তি মেটার নাম নেই৷ বরং জটিলতর হয়েছে৷ দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে৷ সে কংগ্রেসের আমলে হোক বা ভারতীয় জনতা পার্টির সময়ে হোক বা জোট সরকারের আমলেই হোক না কেন৷'' এখন যে যুক্তি দেখিয়ে পিডিপি-র সঙ্গ ছেড়ে সরকার ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে বিজেপি, সেই যুক্তিকে সঠিক বলে প্রমান করা বিজেপির পক্ষে অত্যন্ত কঠিন৷ তবে বছরখানেক পরে ভারতে সাধারণ নির্বাচন৷ সেক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের ক্ষমতায় ফেরার কতকগুলি সিঁড়ির মধ্যে একটি সিঁড়ি হতে পারে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি৷
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ বা ধর্মীয় মেরুকরণ তাকে এমন একটা জায়গায় ফলপ্রসূ করতে হবে যেখানে সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগুরু৷ কাশ্মীর হলো আদর্শ স্থান৷ তাই মেহবুবার হাত ধরে সরকার চালানোর পাশাপাশি সেই রাস্তা খুলে রেখেছিল বিজেপি৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং দলের ‘নরম মুখ' হিসেবে পরিচিত৷ তাঁকে দিয়ে বলানো হলো ‘কোর ইস্যু'-র কথা৷ তিনি বললেন, ‘‘কাশ্মীরে স্থায়ী সমাধান চাই৷ সেই পথে এগোতে হবে৷'' সেই পথ ধরেই ক্ষমতায় এলেন সেনা প্রধান বিপিন রাওয়াত৷ কাশ্মীরে সব দলের সর্বসম্মত পদ ছেড়ে বিজেপি শেষমেষ আঁকড়ে ধরল কট্টরপন্থাকেই৷
কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কি সম্ভব?
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সহিংসতা আবারো এই প্রশ্নকে উস্কে দিয়েছে৷ কি চায় কাশ্মীরের জনগণ? আর ভারত সরকার কি সেখানকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে? কাশ্মীরের বর্তমান সংকট নিয়েই এই ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP/T.Mustafa
সংঘর্ষের সূত্রপাত
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ৮ জুলাই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কথিত সংঘর্ষে স্থানীয় হিজবুল মুজাহিদীন কমান্ডার বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে৷ বুরহান নিহত হওয়ার প্রতিবাদে হাজার হাজার ক্ষুব্ধ জনতা সড়কে নেমে নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর ইট পাটকেল ছুড়লে পাল্টা গুলি চলে তাদের ওপর৷ সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৪০ এরও বেশি নিহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Yasin
কারফিউয়ে জনজীবন অচল
কাশ্মীরি নেতাদের বনধের ডাকে সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকার জনজীবন স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ কারফিউ জারি করেও নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না প্রতিবাদকারীদের৷ অন্যদিকে, খাবার ও ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে৷ মোবাইল ও ইন্টারনেট এবং ট্রেন সার্ভিস বন্ধ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
আরো সেনা মোতায়েন
সাম্প্রতিক উত্তেজনার কারণে চলতি সপ্তাহে ওই অঞ্চলে বাড়তি ৮শ’ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
নিহতদের বেশিরভাগই তরুণ
সাম্প্রতিক সহিংসতার নিহত ৪৪ জনের মধ্যে বেশিরভাগই বয়সে তরুণ৷ তাদের বয়স ১৬ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে৷ আহতদের মধ্যে অনেক শিশু ও নারী রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে শতাধিক মানুষ
চিকিৎসকদের আশঙ্কা, কারফিউয়ের কারণে প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং রক্তের অভাবে আরো অনেকের মৃত্যু হতে পারে৷ প্রায় শতাধিক মানুষের চোখে শটগানের গুলি লেগেছে বলে জানিয়েছেন তারা৷ দ্রুত চিকিৎসা না হলে তারা দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারেন৷
ছবি: Reuters/D.Ismail
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক
কাশ্মীরে চলমান সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান অভিযোগ করায় দু’পক্ষের সম্পর্ক আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে৷ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে ভারত সরকারের অস্বস্তি বেড়েছে৷ ইসলামাবাদে সার্কভুক্ত দেশগুলোর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ যাবেন কি না, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Press Information Bureau
চাপে মোদী সরকার
কাশ্মীর পরিস্থিতির কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী অভ্যন্তরীণ চাপের মুখেও পড়তে পারেন বলে সরকারের একাংশের আশঙ্কা৷ প্রশ্ন উঠতে পারে, মোদীর পাকিস্তান নীতি নিয়েও৷ নরেন্দ্র মোদী সরকারের শুরুটাই হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির বার্তা দিয়ে৷ পাঠানকোট হামলার পর পরিস্থিতি বদলে যায়৷ আর কাশ্মীর ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিন্দায় চাপে পড়েছে মোদী সরকার৷
ছবি: DW/J. Akhtar
কাশ্মীর কার ভূখণ্ড?
ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রই কাশ্মীরকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসছে৷ দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে ওই অঞ্চলটি নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে আছে পরমাণু শক্তিধর এই দুই রাষ্ট্র৷ এই সময়ের মাঝে দুটি দেশই দুইবার বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
যে কারণে সহিংসতা
মুসলিম অধ্যুষিত ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাশ্মীরের স্বাধীনতার লক্ষ্যে অস্ত্র তুলে নেয়৷ এরপর থেকে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এবং সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কাশ্মীর পরিস্থিতি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Tauseef
9 ছবি1 | 9
প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৮-৯৯ সালে যখন ভারতে ক্ষমতায় এলেন, তখন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের বিষয়টি দূরে সরিয়ে রেখেছিল বিজেপি৷ কারণ ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি আঁকড়ে থাকলে সেসময় সরকার গড়া যে মোটেই সহজ হতো না, তা তারা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন৷ বাস্তবতার চাপে প্রধানমন্ত্রী পদে স্বয়ংসেবককে বসানোর তাগিদে বিজেপির সবচেয়ে প্রভাবশালী ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কট্টরপন্থি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানির মতো নেতাকেও দলের কোর ইস্যুগুলিকে সরিয়ে রাখার ‘বাজপেয়ী লাইন' মেনে নিতে হয়েছিল৷ সেই থেকে বিজেপির ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার শুরু৷ যদিও সেই অঙ্কে মোটেই ভুল ছিল না৷ কারণ ওই লাইনে ভর করেই কাশ্মীরের নরমপন্থি ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহদের এনডিএ-তে টেনে আনতে পেরেছিল বিজেপি৷ বাজপেয়ীর কাজ ফুরোয় ২০০৪-এর ভোটে পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে৷ ভারতের জনগণ আদবানিকে খারিজ করল ২০০৯ সালে৷ এরপর দশ বছর ইউপিএ-র উদারপন্থি মনমোহন সরকারের অবসান হলো৷ তখন আদবানিকে দিয়েই নরেন্দ্র মোদীকে সামনের সারিতে নিয়ে এল সংঘ৷ ৩০ বছর পর মোদীর হাত ধরে সংসদে এল নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা৷ বিজেপির একক শক্তিতে বলিয়ান হয়েও চরম পদক্ষেপ কিন্তু নিলেন না মোদী৷ কারণ হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখানো তখনও বাকি৷ যদিও একদিকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা, রামমন্দির গড়া, কমন সিভিল কোড ইত্যাদি নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়েছে মোদী সরকার৷ এরপর হিন্দুরাষ্ট্রের চেহারা দেখালেন উত্তর প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে সন্যাসী যোগী আদিত্যনাথকে ক্ষমতায় বসিয়ে৷ ঠিক একইসময়ে একদিকে গরু নিয়ে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পারিকর মুখ বুঁজে রইলেন৷ তেমনি উদারতার আর এক নিদর্শন দেখানো হলো কাশ্মীরে৷ মেহবুবা মুফতির হাত ধরলেন মোদী৷ এবার ভোটের মুখে মুফতির হাত ছেড়ে দিয়ে ঝুলি থেকে বেড়াল বের করতে চাইছে বিজেপি৷
দেশভাগের আগুন, যা এখনো জ্বলছে
১৯৪৭ সালের ১৪/১৫ আগস্ট ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল৷ হিন্দু অধ্যুষিত ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান৷ সেই থেকে দুই দেশের কিছু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়া কোনো উন্নতি হয়নি৷ বরং শত্রুতা বেড়েই চলেছে৷
ছবি: AP
দুই দেশের জন্ম
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই দেশে বিভক্ত হয়৷ জন্ম নেয় নতুন দুই রাষ্ট্র৷ ভারত ও পাকিস্তান৷ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তাঁর দল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ প্রথমে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উপর নিজেদের আধিপত্য দাবি করেন এবং পরবর্তীতে মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জানান৷ জিন্নাহ’র বিশ্বাস ছিল হিন্দু আর মুসলিমরা ভবিষ্যতে একসাথে থাকতে পারবে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/United Archives/WHA
রক্তাক্ত পথ
পার্টিশন বা দেশ বিভাগ নৃশংস এবং ভয়াবহ এক অধ্যায়ের নাম৷ ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে৷ ইতিহাসবিদরা বলেন, ঐ দাঙ্গায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷ জন্মভূমি ছেড়ে ভারত থেকে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে ভারতে আসে লাখ লাখ মানুষ৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Images
১৯৪৮ সালের যুদ্ধ
ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা পাওয়ার পর কাশ্মীর নিয়ে আবারো বিবাদে জড়িয়ে পড়ে৷ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল হিন্দু নেতার হাতে৷ কিন্তু জিন্নাহ চাইলেন এটা যাতে পাকিস্তানের অধীন হয়৷ ১৯৪৮ সালে দুই দেশের সেনাবাহিনী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ কাশ্মীর উপত্যকার বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ভারতীয় সেনারা৷ কিন্তু সেই সংঘর্ষের জের অব্যাহত আছে আজও৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/M. Desfor
যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার মতো
উদারপন্থি ইতিহাসবিদরা বলেন, জিন্নাহ এবং মহাত্মা গান্ধী নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র দু’টির মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন চেয়েছিলেন৷ জিন্নাহ’র আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার মতো সম্পর্ক হবে ভারত-পাকিস্তানের৷ কিন্তু ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা নতুন দিল্লির সঙ্গে বিবাদ অব্যাহত রাখে৷
ছবি: AP
উপস্থাপনের ভিন্নতা
ভারত ও পাকিস্তান সরকার দেশভাগের ব্যাপারটিকে একেবারে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করে৷ ভারত এটাকে ব্রিটিশদের শাসন থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফসল হিসেবে উল্লেখ করে, যেখানে মহাত্মা গান্ধীকে এর স্থপতি বলা হয়৷ অন্যদিকে, পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকে ব্রিটিশ এবং হিন্দুদের আধিপত্য থেকে মুক্তির আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৪ আগস্টকে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/M. Desfor
সম্পর্কের টানা-পোড়েন
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গত সাত দশক ধরেই তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে৷ আর গত কয়েক বছর ধরে ইসলামি জঙ্গিবাদের কারণে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে দু’দেশের মধ্যে৷ নয়া দিল্লি বরাবরই পাকিস্তানকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গিবাদে মদদদাতা হিসেবে দায়ী করে আসছে৷ আর ইসলামাবাদ বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে৷