বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সদস্য নয় এ রকম গার্মেন্টস আছে হাজারেরও বেশি৷ অথচ রানা প্লাজা ধসের পর কারাখানার ভবন, কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তার জন্য উদ্যোগ নেয়া হলেও, তাদের ব্যাপারে কথা শোনা যাচ্ছেনা৷
বিজ্ঞাপন
আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশানস-এ গত বছরের ২৪শে নভেম্বর আগুন লাগার পর, ঢাকার মোহাম্মদপুরে স্মার্ট ফ্যাশানে আগুন লাগে চলতি বছরের ২৬শে জানুয়ারি৷ তাতে আটজন পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়৷ তাজরীন ফ্যাশানস বিজিএমইএ-র সদস্য হলেও স্মার্ট ফ্যাশানের সদস্য পদ নেই৷ তবুও তারা ফক্স অ্যান্ড স্কট এবং ইনডেক্স-এর মতো আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের পোশাক তৈরি করে দিত সাব কন্ট্রাক্টে৷ তার মানে হলো, বিজিএমইএ-র সদস্য বড় কোনো পোশাক কারাখানার পাওয়া কাজ তাদের দিয়েই করানো হতো৷ বলা বাহুল্য, এসব কারখানার অবস্থা আরো শোচনীয়৷ সেখানে কোনো মনিটরিং নেই, নেই কোনো চাপ৷
ঢাকায় এ ধরনের অনেক পোশাক কারখানা এখনও সক্রিয়৷ পূর্ব রামপুরার এ রকম একটি গার্মেন্টস-এর নাম টিএম গার্মেন্টস৷ ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সরেজমিন গিয়ে দেখেন জারাজীর্ণ একটি ভবনের তিন তলায় মাত্র ১০০ জন শ্রমিক নিয়ে চলছে কারখানাটি৷ কারখানাটির নিরপত্তা, কাজের পরিবেশ কোনোভাবেই মানসম্পন্ন নয়৷ কারখানায় সেলাই মেশিনসহ যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে থাকেন শ্রমিকরা, তাও বহু পুরনো৷ তার ওপর সেখানে সর্বনিম্ন মজুরিও বাস্তবায়ন হয়না৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
সর্বনিম্ন মজুরি ৩,০০০ টাকা হলেও সুফিয়া নামের একজন পোশাক শ্রমিক জানান যে, তিনি নতুন বলে তাঁকে মাত্র ২,২০০ টাকা দেয়া হয়৷ আরো কয়েকজন জানান, তাঁদের ওভারটাইম করানো হলেও সে টাকা তাঁরা পান না ঠিকমতো৷ প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের কাউকে পাওয়া না গেলেও, ফ্লোর সুপারভাইজার মিজানুর রহমান এই অভিযোগ অস্বীকার করেন৷ যদিও তিনি স্বীকার করেন যে, তারা সাব কন্ট্রাক্টে কাজ করেন৷ তাদের সরাসরি কোনো ক্রেতা নেই৷
বিজিএমইএ-র সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, বিজিএমইএ-র সদস্য সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো৷ এর বাইরে এক হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানা আছে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে৷ তাদের দায়দায়িত্ব বিজিএমইএ নেবেনা৷ তারা সরকারকে জানিয়েছে যে, এসব কারখানা যেন সরকার বন্ধ করে দেয়৷ বিজিএমইএ-র সদস্যরাই তো এসব কারাখানাকে আবার কাজ দেয়৷ তাহলে দায়দায়িত্ব কিভাবে এড়ানো যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পোশাক কারাখানা থাকলেও কাজ দেয়া হবে এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু সরকার তাদের লাইসেন্স দেয় কিভাবে?
কেউ দায়িত্ব নিতে না চাইলেও এ সব কারখানায় খুবই কম খরচে পোশাক তৈরি হয়৷ তাই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যে কোনো সময়৷