জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড ঘিরে অ্যামেরিকা বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে৷ ইউরোপে কেমন আছে কৃষ্ণাঙ্গরা৷ অ্যামেরিকা থেকে ভালো, নাকি এখানেও তাদের বর্ণবাদের শিকার হতে হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের সংবাদকর্মী শিপন্দে চিম্বালু নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে ইউরোপে জীবনযাপনে চিত্র তুলে ধরেছেন৷
‘‘আমি জার্মানিতে বসবাস করি মানে এই নয় যে আমি শান্তিতে আছি,’’ বলেন চিম্বালু৷
গত ২৫ মে যুক্তরাজ্যের মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে পুলিশি নির্যাতনে মারা যান ৪৬ বছরের জর্জ ফ্লয়েড৷ যিনি হিউস্টনে একটি বারে বাউন্সার হিসেবে কাজ করতেন৷ কিন্তু করোনা সংকটে বারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছিলেন ফ্লয়েড৷
ঘটনার সূত্রপাত একটি খাবারের দোকান থেকে৷ দোকানের কর্মচারীরা ৯১১ এ কল করে অভিযোগ করেন, এক ক্রেতা সিগারেট কেনার পর জাল নোট দিয়েছে৷ পুলিশ এসে ওই অভিযোগে ৪৬ বছর বয়সি জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেপ্তার করে৷
ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর অনেক বন্ধু ও পরিচিত জন বর্ণবিদ্বেষের কারণে হত্যা নিয়ে চিম্বালুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের ক্ষোভের কথা জানান৷
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে নির্মম হত্যার প্রতিবাদ
বারবার ‘‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’’ বলেও পুলিশি নির্যাতন থামাতে পারেননি জর্জ ফ্লয়েড৷তার মৃত্যুর পর থেকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলছে যুক্তরাষ্ট্রে৷ সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/A. Konstantinidis
আমস্টারডাম
জর্জ ফ্রয়েড হত্যার প্রতিবাদে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে হাজারো মানুষের সমাবেশ৷ পহেলা জুনের ছবি৷
ছবি: Reuters/E. Plevier
বার্লিন
গত ৩১ মে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের ব্রাণ্ডেনবুর্গ গেটের সামনেও হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদ৷ মেগাফোন হাতে স্লোগান দিচ্ছেন এক নারী৷ তার টি-শার্টে লেখা ‘‘আমাদের শ্বাস নিতে দাও৷’’ পুলিশি নির্যাতনের সময় জর্জ ফ্লয়েড বারবার বলছিলেন, ‘‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না৷’’ তার ঘাড়ের ওপর চেপে ধরা পুলিশের হাঁটু তারপরও সরেনি!
ছবি: Reuters/C. Mang
লন্ডন
ব্রিটেনে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের সামনে হাঁটু গেড়ে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন একজন৷
ছবি: Reuters/J. Sibley
প্যারিস
ফ্রান্সের রাজধানীতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে ‘‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ৷
ছবি: Reuters/C. Hartmann
কোপেনহেগেন
ডেনমার্কের রাজধানীতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে শত মানুষের বিক্ষোভ৷ ব্যানারে লেখা, ‘‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও একটা ব্যাপার৷’’
ছবি: Reuters/R. Scanpix
ব্রাসেলস
বেলজিয়ামের রাজধানীতে প্রতিবাদ৷ এক নারীর দুই হাতে উঁচু করে ধরা কাগজে লেখা, ‘‘গতকাল একজন মানুষকে মেরে ফেলেছে পুলিশ৷’’
ছবি: Reuters/F. Lenoir
টরন্টো
বিক্ষোভ মিছিলে একজনের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘প্রিয় কালো মানুষেরা, তোমাদের জানিয়ে রাখতে চাই যে, কান্না ঠিক আছে৷ আরো জানাতে চাই, ভালোবাসি তোমাকে৷ - আরেকজন ভাই৷’’
ছবি: Reuters/C. Osorio
এথেন্স
গ্রিসের রাজধানীতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে কমিউনিস্ট পার্টির বিক্ষোভ সমাবেশ৷
ছবি: Reuters/A. Konstantinidis
বার্লিন
জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে একজনের হাতের প্ল্যাকার্ডে যা লেখা তার মর্মার্থ একটাই- সুবিচার ছাড়া শান্তি আসে না৷
ছবি: Reuters/C. Mang
লন্ডন
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভরতদের একজনের তুলে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘শুধু মৃত্যুর পরেই আমি গুরুত্বপূর্ণ? #জর্জ ফ্লয়েড’’
ছবি: Reuters/J. Sibley
প্যাডারবর্ন
৩১ ডিসেম্বর বুন্ডেসলিগায় প্যাডারবর্নের বিপক্ষে গোল করার পর গেঞ্জিতে ‘‘জাস্টিস ফর জর্জ ফ্লয়েড’’ লেখা দেখাচ্ছেন বোরুসিয়া ডর্টমুন্ডের জেডন সাঞ্চো৷
ছবি: Reuters/L. Baron
বার্সেলোনা
স্পেনের বার্সেলোনা শহরেও বিক্ষোভ হয়েছে৷ বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারীর মাস্কে লেখা, ‘‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না৷’’
ছবি: Reuters/N. Doce
12 ছবি1 | 12
চিম্বালু বলেন, তারা তাদের অনুভূতির কথা আমাকে জানায়৷ কেউ কেউ জানায় তারা আমার পাশে আছে৷ তবে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ম্যাসেজে আমার চোখ আটকে যায়৷ এক জার্মান বন্ধু আমাকে লিখেছে৷ ‘এই মুহূর্তে তুমি অ্যামেরিকায় নেই, সেজন্য কি তুমি খুশি? সেখানে এখন যা হচ্ছে সেটা সত্যি দুঃখজনক৷’
‘‘আমি পুরো একদিন ভেবে তার ম্যাসেজের উত্তর দেই৷ জার্মানিতে আছি বলেই স্বস্তিতে আছি, বিষয়টা এমন নয়৷ আমি হতাশ, আমি বিধ্বস্ত৷ বছরের পর বছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গরা অ্যামেরিকা ও ইউরোপে সহিংসতার শিকার হচ্ছে৷ এমনকি পুলিশের কাছেও তারা নিরাপদ নয় এর একমাত্র কারণ তারা কালো৷ তাই আমাদের জন্য জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড বড় সতর্কবার্তা- বর্ণবিদ্বেষ কখনো কখনো মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়৷’’
পশ্চিমা দেশগুলোতেও আছে বিরোধী বর্ণবিদ্বেষ:
২০১১ সালে পুলিশের গুলিতে মার্ক ডুগান নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি নিহতের ঘটনায় লন্ডন বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল৷
২০০৫ সালে বুনা তাওহে ও জিয়েঁদ বিনা নামের দুই কিশোর পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে একটি সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা পড়ে৷ যে ঘটনার জেরে পুরো ফ্রান্সে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল৷ ওই বছরই জার্মানির ডেসাউয়ে পুলিশ সেলে গুলিতে সিয়েরা লিওনের শরণার্থী ওউরি জালহ মারা যায়৷
অ্যামেরিকার গত কয়েক বছরে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখে অনেক ইউরোপীয় হয়তো সহজেই ভেবে নিচ্ছে, এখানে কৃষ্ণাঙ্গরা ভালো আছে৷ কিন্তু সত্যি হচ্ছে, এই বিলাসিতা এখানেও নেই৷ এখানেও তাদের বর্ণবাদের শিকার হতে হয়৷ হয়তো অ্যামেরিকার মত পুলিশি নির্যাতনের খবর এখানে সংবাদের শিরোনাম হয় না৷ কিন্তু ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষের কৃষ্ণাঙ্গ সম্পর্ক ধারণা দাসত্ব ও উপনিবেশবাদের আমলেই আটকে আছে৷
ইউরোপকে বর্ণবিদ্বেষ স্বীকার করতে হবে:
শুধু জার্মানিকে দিয়ে পুরো ইউরোপ বিচার করলে হবে না৷ ইউরোপের অন্যান্য দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে৷ শুধু গায়ের রঙের কারণে কিভাবে মানুষকে প্রতিদিন বৈষম্যের শিকার হতে হয় তার কোনো তথ্য যদিও জমা হয় না৷ তাই এ সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব না৷
তাই অ্যামেরিকায় এখন যেটা চলছে সেটা দেখে ইউরোপীয়দের ভাবার অবকাশ নেই যে এখানে কৃষ্ণাঙ্গরা ভালো আছে৷ শুধু গ্রিসের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়৷ তার শরণার্থীদের সঙ্গে কতটা অমানবিক আচরণ করছে৷
কালো রঙের কারণে বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ এবং আফ্রিকানদের সব জায়গায় কর্তৃপক্ষের হাতে ও সমাজে প্রতিপদে প্রতিনিয়ত ভুগতে হয়৷
শিপন্দে চিম্বালু/এসএনএল
বর্ণবাদ নিয়ে হলিউডের কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
‘গ্রিন বুক’ ২০১৯ সালে সেরা চলচ্চিত্রের অস্কার জিতে নিয়েছে৷ কিন্তু বর্ণবাদ নিয়ে এই প্রথম কোনো ছবি আলোড়ন তুললো এমন নয়৷ একই ইস্যুতে হলিউডে এর আগেও চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে এবং প্রশংসা ও পুরস্কার জিতেছে৷ ছবিঘরে দেখে নিন৷
২০১৯ সালের সেরা ছবি: গ্রিন বুক
পিটার ফ্যারেলি পরিচালিত ‘গ্রিন বুক’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ হয়েছে বাস্তব কাহিনির উপর ভিত্তি করে৷ ভিগো মোর্টেনসেন (বামে) একজন গাড়ি চালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, যিনি পিয়ানিস্ট মাহেরসালা আলীকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ রাজ্যগুলোতে ঘুরে বেড়ান৷ তাঁর কাছে থাকে একটি সবুজ রঙের বই, যেখানে সেসব রেস্তোরাঁ আর মোটেলের তালিকা আছে, যেগুলো কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য৷
ছবি: picture alliance/AP/Universal/P. Perret
‘ব্ল্যাকক্ল্যান্সম্যান’ এর জন্য অস্কার
বেস্ট অ্যাডাপটেড স্ক্রিনপ্লে’র জন্য চলতি বছর অস্কার জিতেছে এই ছবিটি, যেটাতে বর্ণবাদকে উপজীব্য করা হয়েছে৷ পরিচালক স্পাইক লি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন৷ ৭০ এর দশকে একটি গ্যাং-এর কর্মকাণ্ড তদন্ত করেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ৷ এই ঘটনা নিয়েই সিনেমার কাহিনি গড়ে উঠেছে৷
ছবি: D. Lee/F. Features
‘ব্ল্যাক প্যান্থার’
চলতি বছরে অস্কার পাওয়া চলচ্চিত্রের মধ্যে এটি তৃতীয় ছবি, যা বর্ণবাদের সঙ্গে যুক্ত৷ ২০১৮ সালে মার্ভেলের চলচ্চিত্র ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ প্রথমবারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরোদের জনসমক্ষে এনেছে৷
ছবি: picture-alliance/Marvel Studios
‘মিসিসিপি বার্নিং’ ভেঙে দেয় সব ট্যাবু
১৯৮৮ সালে অ্যালেন পার্কারের মুভি ‘মিসিসিপি বার্নিং’-এ তিন সমাজকর্মীর অন্তর্ধানের গল্প বলা হয়েছে৷
ছবি: ORION PICTURES CORPORATION
‘ইনভিকটাস’
২০০৯ সালে ইস্টউড দ্বিতীয়বারের মতো বর্ণবাদকে তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেন৷ ‘ইনভিকটাস’ খেলা নিয়ে একটি কাহিনি, যেখানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় রাগবি দলের গল্প বলেছেন৷ জার্মান ভাষায় এই চলচ্চিত্রের নাম ‘শত্রুরা যেভাবে বন্ধু হলো’৷ এই চলচ্চিত্রে নেলসন ম্যান্ডেলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মর্গ্যান ফ্রিম্যান৷
ছবি: AP
‘দ্য বাটলার’
বর্ণবাদ নিয়ে শিক্ষণীয় চলচ্চিত্র এটি৷ ২০১৩ সালের এই ছবিতে ফরেস্ট হোয়াইটেকার এবং অপরাহ উইনফ্রে অভিনয় করেছেন৷ এই চলচ্চিত্রে আফ্রো-অ্যামেরিকান বাটলার ইউজেন অ্যালেন-এর গল্প বলা হয়েছে, যিনি আট জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করেছিলেন৷
ছবি: picture alliance/AP Images
‘টুয়েলভ ইয়ার্স আ স্লেভ’
২০১৩ সালে মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি এবং সে বছর সেরা ছবির অস্কার জিতে নেয়৷ যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীতদাস প্রথা নিয়ে নির্মিত এটি৷ ব্রিটিশ পরিচালক স্টিভ ম্যাককুইন এই চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন৷
ব্যারি জেনকিন্স পরিচালিত ‘মুনলাইট’ চলচ্চিত্রে আফ্রো-অ্যামেরিকান এক ব্যক্তির গল্পকে তিন অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে৷ এই ছবির সিনেমাটিক কাজ অসাধারণ৷ ফলে কোনো ধরণের মেলোড্রামা ছাড়া এই ছবির মূল উপজীব্য উপস্থাপিত হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/D. Bornfriend
‘আই অ্যাম নট ইওর নিগ্রো’
গত কয়েক দশক ধরেই বলিউডে বর্ণবাদকে ইস্যু করে চলচ্চিত্র, এমনকি তথ্যচিত্র নির্মাণ হয়েছে৷ হাইতির পরিচালক রাউল পেক ২০১৬ সালে অসাধারণ একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন যার নাম ‘‘আই অ্যাম নট ইওর নিগ্রো’৷