ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সীমান্ত অঞ্চল সফরের পরপরই জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস জর্ডান সফর করেন৷ জর্ডানের জনসংখ্যার অর্ধেক ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত৷ সেখানে শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় জর্ডানকে আরো সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন মাস৷
বিজ্ঞাপন
জর্ডানের শরণার্থী শিবিরে সফর করে আরও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস৷ ডয়চে ভেলের প্রতিবেদক মিশায়েলা ক্যুফনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই শরণার্থীদের নিয়ে জার্মান সরকারের আরো বড় কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে৷
বৃহস্পতিবার জর্ডানের শরণার্থী শিবির সফরের সময় হাইকো মাসকে বেশ অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল৷ এ সময় ১২ বছর বয়সি এক কিশোর তাঁর কানে কানে কিছু বললে, উপস্থিত ফটোসাংবাদিকরা একের পর এক ছবি তুলতে থাকেন৷ ছবি তোলার পর্ব শেষ হলে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন৷ জার্মানির নতুন এই মন্ত্রী যে সংবাদমাধ্যমের সামনে এখনো ততটা সাবলীল হয়ে ওঠেননি!
ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন সীমান্ত অঞ্চল সফরের পরপরই জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাস জর্ডান সফর করেন৷ জর্ডানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত৷ জার্মানমন্ত্রী মাসের জর্ডান সফরের ঠিক আগেই সৌদি সিংহাসনের সম্ভাব্য উত্তরাধিকার যুবরাজ মোহাম্মেদ বিন সালমান ‘ইসরায়েলিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পূর্ণ অধিকার অধিকার রয়েছে' বলে মন্তব্য করেন৷
বুধবার জর্ডান সফরের প্রথমদিন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাস ‘ইতিবাচক উন্নয়নে'-র ঘোষণা দেন৷ পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে চলমান নানা সংকট ও এ সবের সাথে সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, এর সমাধানে জার্মানি পূর্ণ সহযোগিতা করবে৷
আল-সাল্ত: জর্ডানের ধর্মীয় স্বর্গোদ্যান
বর্তমান বিশ্বে খ্রিষ্টান এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে৷ কিন্তু জর্ডানের আল-সাল্ত দুই ধর্মেরই পবিত্র স্থান৷ ইটালির আলোকচিত্রী ফাতিমা আবাদি’র ছবিতে দেখুন সেখানকার কিছু চিত্র৷
ছবি: Fatima Abbadi
প্রাচীন এক নগরী
ফটোগ্রাফার ফাতিমা আবাদি’র জন্ম আবুধাবিতে৷ কিন্তু তিনি জর্ডানের আল-সাল্ত শহরে পড়ালেখা করেছেন৷ খ্রিষ্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে শহরটির পত্তন হয়েছিল৷ এই শহরে ৯০ হাজার মানুষের বাস৷ আল-সাল্ত এমন একটি কসমোপলিটন শহর, যেখানে আরবীয় এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির সম্মিলন ঘটেছে৷
ছবি: Fatima Abbadi
নেই কোনো প্রাচীর, নেই কোনো বিভেদ
এই উদার মানসিকতা এবং ইতিহাসের কারণে শহরটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় মনোনীত হয়েছিল৷ কিন্তু কেবল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য স্থাপত্য বা ফ্যাশনই এখানকার মুখ্য বিষয় নয়, দেখবার মতো বিষয় হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এবং সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানরা এখানে কীভাবে নির্বিবাদে বসবাস করছেন৷ গবেষক আবদের-রাহমান গিল ঠিক এ কথাই জানালেন৷
ছবি: Fatima Abbadi
সেন্ট জর্জ থেকে আল খিদর
গিলের মতে, আল-সাল্ত-এর খ্রিস্টানরা এখানকার সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন৷ আল-সাল্ত-এ এই দুই ধর্মের ইতিহাস ওতপ্রোতোভাবে জড়িত, যে কারণে সেন্ট জর্জ গির্জায় আপনি কোরআনের লিপি (ক্যালিগ্রাফি) দেখতে পাবেন, পাশাপাশি বাইবেলের কথাও লিপিবদ্ধ আছে সেখানে৷
ছবি: Fatima Abbadi
যে স্থানটি সবার জন্য
১৬৮২ সালে এই পবিত্র স্থানটি নির্মাণ করা হয়৷ সেই দিন থেকে খ্রিষ্টান-মুসলমান সবাই আল-সাল্ত-এ সেন্ট জর্জের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মোমবাতি জ্বালান৷ এছাড়া ঐ স্থানে ল্যাটিন, অ্যাংলিকান এবং অর্থোডক্স গির্জাও রয়েছে৷
ছবি: Fatima Abbadi
২ হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস
জর্ডানের সঙ্গে খ্রিষ্ট ধর্মের সম্পর্কটা অনেক পুরোনো৷ জর্ডান নদীতে যীশু খ্রিস্টের ব্যাপটিজমের সময় থেকে চলে আসছে এটা৷ প্রথম শতক থেকেই তাই এখানে অনেক খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীর বাস৷ খ্রিষ্টানরা এখানকার পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে এবং সরকারি কাজ-কর্মে তাদের অংশগ্রহণ রয়েছে৷
ছবি: Fatima Abbadi
অবিচ্ছেদ্য অংশ
শত শত বছর ধরে শান্তিপূর্ণ বসবাসের পর বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহও ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘আরব খ্রিষ্টানরা আমার অঞ্চলের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অবিচ্ছেদ্য অংশ৷’’ আবাদি বললেন, আল-সাল্ত-এর বিশেষত্ব হলো, এখানকার দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এত বছরেও সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি৷
ছবি: Fatima Abbadi
অপূর্ব সহাবস্থান
আবাদি জানালেন, ক্রিসমাসের সময় এখানে খ্রিষ্টানদের অভ্যর্থনা জানান মুসলমানরা এবং তাঁদের সঙ্গে বড়দিনের আনন্দ উদযাপন করেন৷ ঈদের সময় একইভাবে খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের আপ্যায়ন করেন৷ সম্প্রতি নির্বাচনে একজন খ্রিষ্টান নারী সিটি কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ পদে জয় লাভ করেছেন৷
ছবি: Fatima Abbadi
একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা
আবাদি’র আল-সাল্ত ফটো সিরিজে ফুটে উঠেছে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী কৃষিজীবী মানুষের জীবনযাপন এবং সাম্প্রতিক সময়ে শহরে যে পাশ্চাত্যের ছোঁয়া লেগেছে সেটাও৷ এরপরও তিনি বিশ্বাস করেন যে, সময় পরিবর্তন হলেও এখানকার দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসবে না৷ ‘‘এখানে প্রত্যেকটা মানুষ একে অপরকে শ্রদ্ধা করে এবং একে অন্যের প্রতি এমন আচরণ করে, যেন তারা একটা বৃহৎ পরিবারের সদস্য৷’’
ছবি: Fatima Abbadi
8 ছবি1 | 8
জর্ডানে থাকার সময় মাস বলেন, তিনি ‘শরণার্থী সংকটের অপরদিকটা দেখতে চান' এবং ‘এই অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারকে সহযোগিতা করতে চান'৷
সফরের সময় তিনি বারবার উল্লেখ করেন যে, ছোট দেশ জর্ডান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সামর্থ্যের শেষ বিন্দুতে পৌঁছেছে৷ জর্ডান সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ কোটি ৩০ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী জর্ডানে বসবাস করছে৷ এছাড়াও ৭৫ হাজার ইরাকি শরণার্থী রয়েছে সেখানে৷ দেশটির শিক্ষা, বাসস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবায় যা অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে৷
অনেক পশ্চিমা দেশই জর্ডানকে মধ্যপ্রাচ্যের নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে মনে করে৷ যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি জর্ডানকে সরাসরি অনুদানের পরিমাণ আগের তুলনায় প্রায় চারভাগের একভাগ বাড়িয়েছে, যা বর্তমানে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার বা ৮১৫ মিলিয়ন পাউন্ডে ঠেকেছে৷ জর্ডানকে সাহায্যের দিক থেকে জার্মানির অবস্থান দ্বিতীয়৷ তারা বছরে দেশটিকে ৫৯৬ মিলিয়ন পাউন্ড অনুদান দেয়৷
জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর বিরুদ্ধে তাদের কঠোর অবস্থানের নিদর্শন হিসেবে গত বছরের আগস্ট মাসে জর্ডানের মুবাফ্ফাক এয়ার বেইজে জার্মান বিমান বাহিনি এক সামরিক মহড়া চালায়৷
বুধবার সন্ধ্যায় দ্বিপক্ষীয় আলোচনার শুরুর আগে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি৷ সিরিয়ার সংকটের অবসান সামরিক সামাধানে হবে না বলে আলোচনায় দু'দেশের মন্ত্রী একমত হন৷