বিশ্বব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে তৈরি এক প্রতিবেদনে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটি জানিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় মোট জিডিপির প্রায় দশ শতাংশের মতো খরচ করছে সে দেশ৷ পাঁচ বছর আগের তুলনায় এই ব্যয় চারগুণ বেশি বলে জানিয়েছে ফিজি৷
জার্মানির বন শহরে জলবায়ু সম্মেলন কপ২৩ চলাচালে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়৷ এই সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট ফিজি৷ কিন্তু দেশটির এত বড় সম্মেলন আয়োজনের অবকাঠামো না থাকায় তা বন শহরে আয়োজন করা হচ্ছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি বিষয়ক প্রতিবেদনটিতে ফিজির প্রধানমন্ত্রী ভোরেক বাইনিমারমা বলেন, ‘‘কপ২৩-র প্রেসিডেন্ট এবং ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে ফিজি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কঠোর উদ্যোগের দাবি জানাচ্ছে, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের উন্নয়নের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে৷’’
ঝুঁকির মুখে স্বর্গদ্বীপ
ফিজিকে এক সময় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় স্বর্গোদ্যান মনে করা হত৷ কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এর টিকে থাকা নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ ফিজিতে জন্ম নেয়া আলোকচিত্রী অ্যারন মার্চ জন্মভূমির সৌন্দর্য্যকে ক্যামেরাবন্দি করার চেষ্টা করেছেন৷
ছবি: DW/A. March
হুমকির মুখে স্বর্গ
প্রবাল প্রাচীরের কারণে ফিজির মামানুকা দ্বীপ স্নরকেলারদের স্বপ্নের গন্তব্য৷ কিন্তু স্বচ্ছ পানি এবং রঙিন মাছ ধীরে ধীরে কমে আসছে সেখানে৷ সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মারা যাচ্ছে প্রবালগুলো, ফলে ভেঙে পড়ছে বাস্তুসংস্থান৷ এতে মাছ ধরার ক্ষেত্রে এবং পর্যটনেও প্রভাব পড়ছে, যা দেশের মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস৷
ছবি: DW/A. March
সমুদ্র সৈকতের ক্ষয়
নামাতাকুলা গ্রামে দু’টি মেয়ে সৈকত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে৷ ঝড় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণের দ্বীপ ভিতি লেভুর সৈকত অনেকটাই সমুদ্রগর্ভে চলে গেছে৷
ছবি: DW/A. March
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়ছে যে গ্রাম
সাগরে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া এবং ঝড়ের তাণ্ডব দেখেছে নামাতাকুলা গ্রামের মানুষ৷ তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজেরাই এর মোকাবিলা করবেন৷ ২০১৭ সালে তাঁরা এমন একটি প্রকল্পের খোঁজ পেয়েছেন, যেখানকার কর্মীরা উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে৷ এই দলটি জার্মানিতে আয়োজিত এবারের জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়েছে৷
ছবি: DW/A. March
অন্যত্র চলে যাওয়া
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘূর্ণিঝড় উইনস্টন ফিজির দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ ভুনিসাভিসাভি গ্রামে আঘাত হানে৷ সৈকতের অনেকটাই ধুয়ে যায় এতে, ধ্বংস হয় বেশ কিছু ভবন৷ এরপর থেকে প্রায়ই লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে ফসলি জমিতে, পানির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি৷ এ সময় অনেক পরিবার বাড়ির ভেতর আটকা পড়ে থাকেন অথবা আগেভাগেই উঁচু জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নেন৷
ছবি: DW/A. March
উঁচু স্থানে চলে যাওয়া
ভুনিসাভিসাভি গ্রামের বাসিন্দা সেপেসা কিলিমো ওয়াকাইরাতাভু নিজের বাড়ি ছেড়ে উঁচু জায়গায় চলে গেছেন৷ ২০১৬ সালের ঝড়ে তাঁদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো পরিবার অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়েছে৷
ছবি: DW/A. March
পূর্বপুরুষের ভেটেমাটি ছেড়ে যাওয়া
২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে, ভুনিসাভিসাভি গ্রামের প্রবীণরা তাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে একেবারেই রাজি হননি৷ তাঁরা বিশ্বাস করতেন পূর্বপুরুষরাই রক্ষা করবেন তাঁদের৷ কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল ছোবলে তাঁরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হন, যেমন ৮৫ বছরের মারিয়া ললু৷
ছবি: DW/A. March
কমছে পর্যটকদের সংখ্যা
ভিতি লেভু দ্বীপটির প্রবাল সৈকত পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র৷ এখানে সমুদ্র সৈকতের খুব কাছেই বৈচিত্রময় প্রবাল প্রাচীর দেখতে পাওয়া যায়৷ কিন্তু সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রবালগুলো ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ কিছু অংশ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে৷ তাই পর্যটন সংস্থাগুলোর আশংকা, প্রবাল ধ্বংস হয়ে গেলে পর্যটকরা এখানে আসা ছেড়ে দেবেন৷
ছবি: DW/A. March
বিকল্প পথ
ফিজি কর্তৃপক্ষ পর্যটক টানতে অন্য পথ ধরেছেন৷ তারা কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছেন৷ ফ্যান্টাসি আইল্যান্ড এর এক বড় উদাহরণ৷ সমুদ্রের পানি এনে সৈকতের কাছে এটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বেশ কয়েকটি পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ করা হয়েছে৷
ছবি: DW/A. March
8 ছবি1 | 8
বলাবাহুল্য, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ এজন্য বিভিন্ন গ্রাম সরিয়ে নিতে এবং আরো মজবুত সেতু এবং রাস্তাঘাট নির্মাণে চলতি বছর ১৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করছে ফিজি৷ অতীতে কখনোই এই খাতে এত অর্থ খরচ করতে হয়নি দেশটির৷ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনে ফলে ফিজি'র জনগণ এবং অর্থনীতির উপরে ঝুঁকি যেভাবে বাড়ছে, তাতে তা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ ক্রমশ দুরূহ হয়ে পড়ছে৷’’
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা এবং ভূমিধসের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, ফসল এবং চাষবাসের উপকরণ ধ্বংসের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ডেঙ্গু, লেপটোসপাইরোসিস এবং টাইফয়েড সংক্রমণের হার বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ ফলে ফিজির মতো দেশগুলোকে ভবিষ্যতে জিডিপির একটি বড় অংশ এসব মোকাবিলায় ব্যয় করতে হবে৷
এদিকে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের যে তহবিল তৈরির ব্যাপারে প্যারিসে সমঝোতা হয়েছিল, তা অর্জন জরুরি৷ তহবিল তৈরির সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখনো সুদূর পরাহত বলে জানা যাচ্ছে৷ আগামী বুধবার বনে জলবায়ু সম্মেলনে এক বক্তব্যে এই বিষয়ে জোর দেবেন গুতেরেস৷
এআই/এসিবি (এএফপি, ডিপিএ)
পরিবেশবান্ধব জলবায়ু সম্মেলন
জার্মানির বন শহরে চলছে দুই সপ্তাহব্যাপী জলবায়ু সম্মেলন৷ কার্বন নির্গমন কমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করার এই সম্মেলনকে যতটা সম্ভব পরিবেশবান্ধব করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Setiawan
বিমান পরিবহণ
সম্মেলনে আসা ২০ হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারীর অধিকাংশই বিমানে করে জার্মানির বনে এসেছেন৷ অথচ বিমান হচ্ছে কার্বন নির্গমনের একটি বড় উৎস৷ অর্থাৎ অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যেকেই পরিবেশের ক্ষতি করে পরিবেশ বাঁচানোর আলোচনা করতে এসেছেন৷ কিন্তু বিমান ছাড়া তো আর বিকল্পও নেই৷ জার্মানি অবশ্য এই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Meissner
অফসেট
এটি জলবায়ু সংক্রান্ত একটি ‘টার্ম’৷ কার্বন নির্গমনের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার একটি উপায় এটি৷ বিমান পরিবহণসহ অংশগ্রহণকারীদের রাতে হোটেলে থাকা, লাইট, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, এসব নানা কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে দিতে জার্মানি ‘সার্টিফায়েড এমিশন রিডাকশন’ বা সিইআর ক্রেডিট কিনবে৷ আরও জানতে ক্লিক করুন উপরে (+) চিহ্নে৷
ছবি: DW/H. Kaschel
সিইআর ক্রেডিট
জার্মানির কেনা এই ক্রেডিট ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে জাতিসংঘের ‘ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম’ বা সিডিএম-এর অধীনে যেসব প্রকল্প নিবন্ধিত আছে সেখানে ব্যবহৃত হবে৷ সিডিএম সম্পর্কে আরও জানতে ক্লিক করুন উপরে (+) চিহ্নে৷
ছবি: picture alliance/Robert Harding World Imagery
কাগজের ব্যবহার
আগের যে কোনো সম্মেলনের চেয়ে এবার কাগজের ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে৷ সম্মেলনের তথ্য সংক্রান্ত বেশিরভাগ কাগজপত্র প্রিন্ট না করে ইলেক্ট্রনিক উপায়ে ব্যবহারযোগ্য করা হয়েছে৷ তবে এরপরও কেউ প্রিন্ট চাইলে তাঁকে প্রিন্ট করে দেয়া হচ্ছে৷ তবে সেটা একই পাতার এপাশ-ওপাশ করে৷
ছবি: DW/M. Z. Haque
রিসাইকেল
একেক রকমের ময়লা ফেলার জন্য একেক রকমের ‘ডাস্টবিন’ রাখা হয়েছে৷ সেখানে পাওয়া ময়লা এবং সম্মেলনের জন্য তৈরি করা ব্যানারগুলো রিসাইকেল করে ভবিষ্যতের জলবায়ু সম্মেলনের জন্য পুনরায় ব্যবহারযোগ্য পানির বোতল কিংবা ব্যাগ তৈরির কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Z. Haque
প্লাস্টিক বোতল
এটি ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল ফেলার জায়গা৷ এ সব বোতল জমা দিয়ে পাওয়া অর্থ ‘নিউ ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম’-কে দান করা হবে৷ এটি ‘কোকা কোলা ফাউন্ডেশন’ ও ‘গ্লোবাল ওয়াটার চ্যালেঞ্জ’-এর একটি যৌথ উদ্যোগ৷ পানি পানের জন্য প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে বিনামূল্যে বার বার ব্যবহারযোগ্য পানির বোতল দেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Z. Haque
হাইড্রোজেন বাস
হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে চলে এই বাস৷ এটা এখনও ব্যয়বহুল ও জটিল এক প্রক্রিয়া৷ তবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে জার্মান গবেষকরা এই প্রযুক্তিতে কার্যকর করার চেষ্টা করছে৷ জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের এক জোন থেকে আরেক জোনে নিয়ে যেতে এই বাস ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: DW/A. Setiawan
ইলেকট্রিক গাড়ি
নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে তৈরি বিদ্যুৎ দিয়ে চলছে এই বাস৷ কপ২৩-এ ব্যবহৃত ইলেকট্রিক গাড়িগুলো বেশিভাগই কোরিয়ায় তৈরি৷ ই-কারের জগতে জার্মান গাড়ি নির্মাতারা এখনও কোরিয়া, জাপান ও চীনাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে৷
ছবি: DW/A. Setiawan
সাইকেল
পরিবেশবান্ধব এই বাহনেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ নেক্সটবাইক কোম্পানির প্রায় ছয়শটি সাইকেল কপ-এ ব্যবহৃত হচ্ছে৷ অংশগ্রহণকারীরা একটি অ্যাপ ডাউনলোড করলে সেখান থেকে একটি পিন পাচ্ছেন৷ সেই পিন দিয়ে যে কোনো সাইকেল খুলে নিয়ে যাতায়াত শুরু করতে পারছেন৷ সেবাটি অবশ্যই বিনামূল্যে৷
ছবি: DW/A. Setiawan
হাইব্রিড বাস
এটি আসলে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব নয়৷ নামই বলে দিচ্ছে যে, এতে ডিজেল ও বিদ্যুৎ দুই-ই ব্যবহৃত হয়৷ অংশগ্রহণকারীদের আনা নেয়ায় এই বাসেরও ব্যবস্থা করছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ৷