জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে নানা রকম পদক্ষেপের কথা শোনা যায়৷ ক্লাইমেট ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে বাড়তি কার্বন-ডাই-অক্সাইড দূর করার উদ্যোগ নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে৷
বিজ্ঞাপন
অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ছাইয়ের মেঘ বায়ুমণ্ডল ঢেকে দেয়৷ গন্ধকের কণা বিশাল উচ্চতায় উঠে সূর্যের আলোর পথে বাধা সৃষ্টি করে৷ তাপমাত্রা কমে যায়৷ খুব বড় আকারের অগ্ন্যুৎপাতের ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে এমনকি আধ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমে যেতে পারে৷
অতি ক্ষুদ্র এই কণা ঠিক রিফ্লেকটরের মতো সূর্যের আলোর একটি অংশ ঢেকে দিতে পারে৷ পৃথিবীর উপর এমন সুরক্ষার ছাতা মেলে ধরলে উষ্ণতা কমানো সম্ভব হবে৷
শুনতে খুব সহজ মনে হলেও এমন আইডিয়া কতটা বাস্তবসম্মত? উলরিকে নিমায়ার বলেন,‘‘জলবায়ুর প্রণালী এতই জটিল,যে আমরা এমনকি হিসেবের মডেল দিয়েও অপ্রত্যাশিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার পূর্বাভাষ দিতে পারি না৷ তার অপ্রত্যাশিত পরিণতি সম্পর্কেও ধারণা দিতে পারি না৷''
তা সত্ত্বেও গোটা বিশ্বে বিজ্ঞানীরা প্রযুক্তির সাহায্যে জলবায়ুর উপর হস্তক্ষেপের প্রক্রিয়ার খোঁজ করছেন৷ পৃথিবীর গতি-প্রকৃতির রাসায়নিক ও পদার্থগত কার্যপ্রণালীর উপর হস্তক্ষেপ ‘ক্লাইমেট ইঞ্জিনিয়ারিং' নামে পরিচিত৷
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ‘ভাসমান’ যুদ্ধ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় আবাদি জমি বছরে ছয় মাসেরও বেশি সময় পানির নীচে তলিয়ে থাকে৷ জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করে বেঁচে থাকার গল্প শুনুন তাদের মুখেই৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
শৈশব থেকেই ভাসমান চাষ করেন সানোয়ার মিয়া
পিরোজপুর জেলার বৈঠাকাটা ইউনিয়নের সানোয়ার মিয়ার বয়স ৪৩ বছর৷ শৈশব থেকেই বাবার হাত ধরে শিখেছেন ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ৷ পাঁচ হাজার টাকায় এক খণ্ড জমি দুই বছরের জন্য লিজ নিয়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের সবজির চারা উৎপাদন করছেন৷ সব খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তাতে সংসার চলে যায় কোনোরকমে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
মৌসুমে পাঁচবার চারা
বাবুল হাওলাদার যে যায়গাটিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন, সেটি তাঁর নিজেরই৷ শুকনো মৌসুমে মাত্র একবার এ জমিতে ধান চাষ করতে পারলেও ডুবন্ত জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে তিনি কমপক্ষে পাঁচ বার চারা উৎপাদন করতে পারেন৷ এতে তাঁর লাভও ভালো হয়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
স্বামীকে সহায়তা করেন আকলিমা
আকলিমা বেগমের স্বামী ভাসমান পদ্ধতিতে গাছের চারা ও সবজি চাষাবাদ করেন জলভূমিতে৷ স্বামীর কৃষিকাজে সবসময় সহায়তা করেন তিনি৷ বীজ বপন থেকে চারা গজানো পর্যন্ত যতরকমের পরিচর্যা, তার সবই তিনি করে থাকেন বাড়ির আঙ্গিনায় বসে৷ ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদে, চারা গজানোর কাজটি বাড়িতেই করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
বীজ বপন করেই চলে সংসার
আঞ্জু আরা বেগম অন্যের জমির জন্য বীজ বপনের কাজ করেন৷ কচুরিপানা ও ঘাস দিয়ে একটি গোলাকার বল তৈরি করে তার ভেতরে বীজ বপন করতে হয়৷ এক হাজার বীজ বপনের জন্য তিনি পারিশ্রমিক পান দেড়শ টাকা৷ দিনে সর্বোচ্চ দেড় হাজার পর্যন্ত বীজ বপন করতে পারেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
ভাসমান চাষাবাদ সহজ
ডুবে থাকা জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদই সহজ মনে হয় বৈঠাকাটা এলাকার খায়রুল ইসলামের কাছে৷ ভাসমান পদ্ধতিতে তিনি বিভিন্ন রকম লতা-জাতীয় সবজি চাষ করেন৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
কচুরিপানা বিক্রি
হারুনুর রশীদের মতো অনেকেই আছেন, কচুরিপানা বিক্রিই যাঁদের একমাত্র পেশা৷ বাড়ির আশপাশের বিভিন্ন নীচু এলাকায় তাঁরা আটকে রাখেন কচুরিপানা৷ মৌসুমে তা বিক্রি করেন কৃষকদের কাছে৷ এক নৌকা কচুরিপানা বিক্রি হয় পাঁচ থেকে আট হাজার টাকায়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
শ্যাওলা-ঘাস বিক্রি করেন হারেছ মিয়া
ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য পানির নিচের শ্যাওলা খুবই প্রয়োজনীয়৷ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে কৃষকদের কাছে শ্যাওলা বিক্রি করেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
ছয় মাসে ছয় বার
নিজের জলমগ্ন জায়গায় ছয় মাসে ছয় বার সবজির চারা উৎপাদন করেন আব্দুর রহমান৷ প্রথম দুই বারের চারা বিক্রি করে তাঁর সব খরচ উঠে যায়, বাকি চার বারের পুরোটাই লাভ৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
জৈব পদ্ধতিতেই চাষাবাদ
নাজিরপুরের রুহুল আমিন জানান, ভাসমান পদ্ধতিতে যে চাষাবাদ হয়, তাতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার করতে হয় না৷ পচা কচুরিপানাই এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে জৈব সার হিসেবে কাজ করে৷
অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে হস্তক্ষেপের প্রভাবও বিশাল হতে পারে৷ আন্দ্রেয়াস ওশলিস-এর অসংখ্য কম্পিউটার সিমুলেশনে এমনটাই দেখা যাচ্ছে৷
বেশ কিছু আইডিয়া আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত সহজ মনে হতে পারে৷ যেমন মহাসাগরে কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমা রাখার উদ্যোগ৷ কারণ উষ্ণ পানির তুলনায় শীতল পানি অনেক বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড ধরে রাখতে পারে৷ বিশাল পাম্পের মাধ্যমে সমুদ্রের গভীর থেকে শীতল পানি তুলে উপরের স্তরে আনা যেতে পারে৷ সমুদ্র তখন বায়ুমণ্ডলের বাড়তি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেবে৷ সমুদ্রবিজ্ঞানী প্রো. আন্দ্রেয়াস ওশলিস বলেন, ‘‘মডেল সিমুলেশনের মাধ্যমে আমাদের ধারণা হয়েছে, যে এভাবে আমরা বর্তমান কার্বন নির্গমনের ১০ শতাংশ ক্ষতি পূরণ করতে পারি৷ কিন্তু তার জন্য দক্ষিণের মহাসাগরের বিশাল ইকোসিস্টেমের উপর হস্তক্ষেপ করতে হবে৷ সেখানে অ্যালজির বৃদ্ধি ও অক্সিজেন কমে যাবে৷ প্রশ্ন হলো, আজ যে নির্গমন ঘটছে, তার মাত্র ১০ শতাংশ কমাতে আমরা কি সত্যি এমনটা করতে চাই?''
উত্তরমেরু সাগরে পরীক্ষা চালিয়ে একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে৷ গবেষকরা সার প্রয়োগ করে ফাইটোপ্ল্যাংকটন চাষ করেছেন৷ সেগুলি বিকশিত হবার সময় ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ধরে রাখে৷ তারপর প্ল্যাংকটন সমুদ্রের তলদেশে তলিয়ে যায়৷ এভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিরাপদে দূর করা যায়৷
স্রোতের মাধ্যমে সেই সার গোটা বিশ্বের মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়ে ফাইটোপ্ল্যাংকটনের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে৷ তবে এক্ষেত্রেও বড়জোর ১০ শতাংশ নির্গমন কমানো সম্ভব হবে৷ ইকো সিস্টেমের উপর তার প্রভাবও অনিশ্চিত৷
ডিয়র্ক কুনৎসে/এসবি
পৃথিবী ক্লান্ত!
সারা বছর ধরে আমাদের যে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করা উচিত, গতকাল নাগাদ তা আমরা ব্যবহার করে ফেলেছি৷ ধরিত্রীর উপর আমাদের চাপ ক্রমশ মাত্রা ছাড়াচ্ছে, যার ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি
বিশ্বের নব্বইটির বেশি সংগঠনের সমন্বয়ে তৈরি আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংক ‘গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্ক’ প্রতিবছর একদিনকে ‘আর্থ ওভারশুট ডে’ হিসেবে পালন করে৷ এই দিনটি সাধারণত সেদিন হয়, যেদিন পৃথিবী একবছরে যা পুর্নউৎপাদন করতে পারে তারচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ মানুষ খরচ করে ফেলে৷ এটা অনেকটা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ার মতো ব্যাপার৷ ২০১৮ সালে সেই দিনটি ছিল পহেলা আগস্ট৷
ছবি: Fotolia/Yanterric
কার কতটা প্রয়োজন?
আজকে পৃথিবীর মানুষ যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করছে তার যোগান দিতে কার্যত এক দশমিক সাতটি পৃথিবী দরকার৷ আর যদি আলাদা আলাদাভাবে অঞ্চলের কথা চিন্তা করেন, তাহলে জার্মানরা যেভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে, সেভাবে গোটা বিশ্বের মানুষ ব্যবহার করলে তাদের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হতো তিনটির বেশি পৃথিবী৷ মার্কিনিদের ক্ষেত্রে এটি ৪ দশমিক নয়টি পৃথিবী৷
ছবি: picture alliance/landov
জঘন্য কাজ
আমাদের বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত ফুটপ্রিন্টের ৬০ শতাংশের বেশি আসছে জীবাশ্ম জ্বালানী এবং কাঠ পোড়ানোর মাধ্যমে৷ একেবারে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদক৷
হুমকির মুখে বনজঙ্গল
গাছ থেকে কাঠ আসে যা কাগজ তৈরির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল৷ তাছাড়া গাছ মাটির ক্ষয় রোধে সহায়তা করা ছাড়াও ভূগর্ভস্থ পানির আধার পূর্ণ রাখে এবং প্রকৃতি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে আমাদের জন্য অক্সিজেন ছাড়ে৷ তাসত্ত্বেও প্রতিবছর বিশ্ব ৩৩ লাখ হেক্টর বন হারাচ্ছে৷
ছবি: DW/K. Jäger
মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরা
আমরা সাগর থেকে যেহারে মাছ ধরছি তা উৎপাদনের গতির চেয়ে অনেক বেশি৷ চলতি বছরের এই সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর একতৃতীয়াংশ মাছের আধারে প্রজনন ক্ষমতার চেয়ে বেশি মাছ ধরা হয়ে গেছে৷ একদিকে, যেমন বেশ মাছ ধরা হচ্ছে, অন্যদিকে কার্বনর ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্রের পানিও ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে যা সামুদ্রিক জীবের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে৷
পানির ঘাটতি
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির হিসেব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী পানি সংকটে ভুগবে৷ ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ক্রমশ কমে যাচ্ছে কিংবা নানা বিষাক্ত উপাদানের সংমিশ্রণে পানের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Gupta
নিজের জন্য প্রয়োজন ১ দশমিক আট হেক্টর
পরিবেশগত টেকসই পদ্ধতি বিবেচনায় আনলে পৃথিবীর একজন মানুষের সাধারণ চাহিদা মেটাতে ১ দশমিক আট হেক্টর জমির প্রয়োজন৷ কিন্তু গড়ে একজন জার্মান ব্যবহার করছেন ৫ দশমিক এক হেক্টর জমি৷