জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের অনেক এলাকা হুমকির মুখে পড়েছে৷ ফলে বাসযোগ্য এলাকার অভাব দেখা দিতে পারে৷ আমস্টারডামসহ বিশ্বের অনেক শহরে ভাসমান বাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
আমস্টারডাম শহরের একটি খালের এক দিকে এক সময় একশো'রও বেশি মানুষ বসবাস করবে৷ শহরের কেন্দ্রস্থলে গড়ে উঠবে এক নতুন বসতি৷ ‘পরিষ্কার জাহাজ' নামের এক প্রকল্পের আওতায় সেখানে ৩০টি ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে৷ প্রত্যেকটি ভবনের নিজস্ব ডিজাইন থাকবে৷
তবে সবক'টি ভবনের মধ্যে একটি মিল রয়েছে৷ সেগুলি বিশেষভাবে তৈরি কংক্রিটের ভেলার উপর ভাসবে৷ ভাসমান সেই ভিত্তির কয়েকশ' টন ওজন বহন করার ক্ষমতা থাকবে৷ তাই তার নিখুঁত ভারসাম্যও থাকা চাই৷ স্থপতি হিসেবে ইয়রিট হুভ্যার্ট চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের ভবনটির নক্সা তৈরি করেছেন৷ ইয়রিট বলেন, ‘‘নৌকার উপর যা কিছু তোলা হবে, তার ওজন ভালো করে হিসেব করতে হয়৷ কারণ অতিরিক্ত ওজন হলে, নৌকা বসে যাবে ও পানি প্রবেশ করতে শুরু করবে৷ তাই আমরা নৌকার ওজন আগে থেকে ভালো করে হিসেব করি৷''
২০ জন স্থপতি এই প্রকল্পে কাজ করছেন৷ বাড়িগুলি ডাঙার উপর তৈরি করে নৌকায় করে বন্দরে নিয়ে আসা হয়৷ বাসিন্দাদের কাছে টেকসই প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রকল্পের বোর্ডের সদস্য হিসেবে পেয়ার ডে রাইক বলেন, ‘‘পানির উপর অত্যন্ত টেকসই বাড়িতে সমাজবদ্ধভাবে টেকসইভাবে যে বসবাস করা যায়, আমরা সেই লক্ষ্য পূরণ করতে চেয়েছিলাম৷ আমস্টারডাম ও গোটা বিশ্বের কাছে আমরা অত্যন্ত উচ্চ মান বেঁধে দিতে চেয়েছিলাম৷''
ভাসমান ভবনই কি ভবিষ্যৎ?
04:00
অন্যান্য বাড়ির মতো পেয়ার ডে রেইক-এর বাড়িটিও নিজস্ব সৌরশক্তিতে চলে৷ বাড়ি তৈরি করতে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে৷ বাড়ির বাইরের খোলস কর্ক দিয়ে তৈরি৷ পেয়ার ডে রাইক বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা করেছি৷ বিভিন্ন উপদেষ্টা আমাদের উপকরণ সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন৷ তাই শেষে আমরা সবুজ, কমলা ও লাল তালিকা সৃষ্টি করি৷ লাল তালিকার উপকরণ পুরোপুরি বাতিল করা হলো৷ আর্থিক বা প্রযুক্তিগত কারণে এড়ানো সম্ভব না হলে কমলা তালিকার উপকরণ ব্যবহার করা যায়৷ তবে সম্ভব হলে শুধু সবুজ তালিকার উপকরণই ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো৷ কর্ক সবুজ তালিকায়ই ছিল৷ আমাদের ভালো লাগায় আমরা সেটি বেছে নেই৷''
পানির উপর বসবাস আমস্টারডাম শহরের দীর্ঘ ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে৷ প্রায় সব খালেই হাউস বোট চোখে পড়ে৷ অন্যতম প্রথম ভাসমান পাড়া কয়েক বছর আগেই তৈরি করা হয়েছে৷ আইবুর্গ এলাকায় কৃত্রিম দ্বীপের উপর ৫০টি বাড়ি শোভা পাচ্ছে৷ ইউরোপের অন্যান্য শহরেও সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে৷ ইয়রিট হুভ্যার্ট বলেন, ‘‘পানির উপর বাড়ি তৈরির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস৷ সারা বিশ্ব থেকে অনুরোধ আসছে৷ নিউ ইয়র্ক, বাল্টিমোর আগ্রহ দেখাচ্ছে৷ নেদারল্যান্ডসে বেশ কিছু এলাকায় ৫০, ১০০, এমনকি দুশো ভাসমান বাড়িও তৈরি হচ্ছে৷
লন্ডন শহরে বাকা নামের ব্রিটিশ স্থপতিদের কোম্পানি রয়েল ডক্স এলাকায় ভাসমান বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করছে৷ কোপেনহেগেন শহরে ছাত্রছাত্রীদের আবাসনের অভাব মেটাতে তারকা স্থপতি বিয়ার্কে ইঙেল্স তথাকথিত ‘আর্বান রিগার' প্রকল্পের আওতায় ১২টি ভাসমান বাড়ি তৈরি করেছেন৷
বিয়ার্কে এমনকি আরও বড় মাত্রার স্বপ্ন দেখছেন৷ জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির সম্মুখীন অঞ্চলের মানুষের জন্য তিনি ১০ হাজার মানুষের ভাসমান শহরের পরিকল্পনা করছেন৷
মারাদোনার খেলা দেখে পানির উপর মাঠ তৈরি!
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে মারাদোনার খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পানির উপর ভাসমান ফুটবল মাঠ তৈরি করেছিল একদল থাই কিশোর৷ পরের ইতিহাস জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: Youtube/TMBbrand
জেলেদের গ্রাম
ছবিতে চারদিক পানি দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রাম দেখতে পাচ্ছেন৷ থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত পানইয়ে দ্বীপের এই গ্রামের বাসিন্দাদের আয়ের উৎস একসময় ছিল মাছ ধরা৷ এখন তাতে যোগ হয়েছে পর্যটন৷
ছবি: Youtube/TMBbrand
পানির উপর মাঠ!
পানইয়ে দ্বীপে পর্যটকদের আগমনের পেছনে আছে দারুণ এক কাহিনি৷ ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে মারাদোনার খেলা দেখে দ্বীপের একদল কিশোরের মনে ফুটবল খেলার ইচ্ছে জাগে৷ কিন্তু কোথায় খেলবে? তাদের আশেপাশে শুধু পানি আর পানি৷ অবশেষে সেই পানির উপরই মাঠ তৈরির পরিকল্পনা করে তারা৷
ছবি: Youtube/TMBbrand
বয়স্করা পাত্তা দেননি
ঐ কিশোররা যখন পানির উপর মাঠ বানানোর পরিকল্পনার কথা বড়দের জানায়, তখন শুরুতে সেটি অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু তাতে দমে যায়নি অল্পবয়সি ঐ তরুণেরা৷ গ্রামবাসীদের কাছ থেকে পুরনো কাঠ আর পেরেক জোগাড় করে নিজেরাই একটি মাঠ তৈরি করেছিল ঐ কিশোররা৷ ছবিতে ঐ মাঠ তৈরিতে ব্যবহৃত আসল কাঠ, পেরেক আর হাতুড়ি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: FIFA Museum
মাঠের সমস্যা
কিশোরদের তৈরি করা ঐ মাঠের বিভিন্ন জায়গায় পেরেক থাকায় সাবধানে দৌঁড়াতে হতো৷ তবে সবচেয়ে বেশি সাবধানে থাকতে হতো বল নিয়ে, খুব নজর রাখতে হতো যেন বল পানিতে না পড়ে৷ কিন্তু তা কী আর হয়৷ চারদিকে পানি থাকায় প্রায়ই বল সেখানে চলে যেতো৷ ফলে বারবার পানি থেকে বল উঠিয়ে এনে খেলা শুরু করতে হতো৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Archambault
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ
একদিন ঐ কিশোরদের একজন স্থানীয় এক ফুটবল প্রতিযোগিতার খবর নিয়ে আসে৷ তারা সেখানে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ এই খবরে গ্রামের বয়স্করা তাদের উৎসাহ দিতে এগিয়ে আসে৷ তাদের জন্য জার্সি আর অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Archambault
সাফল্য
একদিনের ঐ প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে উঠেছিল পানইয়ে দ্বীপের কিশোররা৷ কর্দমাক্ত মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকায় সেমিফাইনালের প্রথমার্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে গিয়েছিল তারা৷ পরে হাফটাইমের পর বুট ছাড়াই মাঠে নামে তারা৷ ঐ অবস্থায় খেলে দুই গোল শোধও করেছিল কিশোররা৷ কিন্তু শেষ মিনিটের গোলে হেরে যায়৷ তবে সেমিফাইনালে ওঠায় ঐ কিশোররা তো বটেই, পানইয়ে গ্রামের সব মানুষই খুব খুশি হয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Archambault
ফুটবল ক্লাব
প্রতিযোগিতায় সাফল্যের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি৷ গ্রামবাসীর সহায়তা নিয়ে সেখানে আরেকটি মাঠ গড়ে তোলা হয়েছিল৷ প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ঐ মাঠটি ছিল মসৃণ৷ বর্তমানে পানইয়ে ক্লাব দক্ষিণ থাইল্যান্ডের অন্যতম সেরা একটি ক্লাব৷ দলের কয়েকজন খেলোয়াড় প্রফেশনাল ফুটবলারও হয়ে উঠেছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Archambault
অন্যের জন্য অনুপ্রেরণা
টিএমবি নামে থাইল্যান্ডের একটি ব্যাংক তার কর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক একটি গল্প খুঁজছিল৷ সেই সময় তারা পানইয়ে ক্লাবের সন্ধান পায়৷ পরে সেই গল্প নিয়ে একটি শর্টফিল্মও নির্মাণ করে টিএমবি ব্যাংক৷ এটি বিভিন্ন জায়গায় পুরস্কারও পায়৷ এই শর্টফিল্মের কারণে পানইয়ে দ্বীপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে৷ পর্যটকরা এখন সেখানে যাচ্ছেন৷ শর্টফিল্মটি দেখতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Archambault
ফিফার নজর
পানইয়ে ক্লাবের গল্প ফিফা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে৷ তাইতো সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থিত ফিফা জাদুঘরে (ছবি) দর্শণার্থীদের সেই গল্প শোনানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে৷