জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষাৎ প্রমাণ সত্ত্বেও যাদের মনে এখনো সংশয় রয়েছে, গ্রিনল্যান্ডে এক দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার ফলাফল তাদের মুখ বন্ধ করে দেবার জন্য যথেষ্ট৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের এক গবেষকদল একটি প্রাণীর বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে মূল্যবান তথ্য পেশ করছেন৷
বিমানে করে অভিযানের গন্তব্য, অর্থাৎ গ্রিনল্যান্ডের ট্রাইল দ্বীপে কারুপেলভ উপত্যকায় পৌঁছতে এক ঘণ্টা সময় লাগে৷ অথচ ফ্রান্সের জীবতত্ত্ববিদ বনোয়া সিটলার ও জার্মানির ইয়োহানেস লাং এবং তাঁদের সহযাত্রীদের একটা গোটা দিন পথেই কেটে গেছে৷ নীচে গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহ ও বরফে ঢাকা ফিয়র্ড দেখা যাচ্ছে৷ ক্ষণস্থায়ী গরমকাল ঠিকমতো শুরু হবার আগেই, অর্থাৎ জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বরফ গলতে শুরু করেছে৷ ছোট্ট রানওয়েতে বিমান নামানোই একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো৷
ময়দা, চিনি, দুধ, কফি, তাঁবু ও অবশ্যই গবেষণার সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়েছে৷ ট্রাইল দ্বীপে কেউ বসবাস করে না৷ তাই বিজ্ঞানীদের একাই সময় কাটাতে হবে৷ সে কারণে কিছু ভুলে গেলে চলবে না৷ কয়েক সপ্তাহ পর ছোট্ট বিমানটি তাঁদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে৷ মাঝের সময়টা তাঁবু দিয়ে তৈরি ক্যাম্পে কাটাতে হবে৷ প্রথমেই সেখানে দুশ্চিন্তার কারণ চোখে পড়েছে৷
সাগর উত্তপ্ত হওয়ার যে বিপদ
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে বিশ্বের মহাসাগরগুলি৷ ধেয়ে আসছে নানান রকমের বিপদ৷
ছবি: Fotolia/st__iv
দক্ষিণ মেরুর অবস্থা
অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে অ্যামেরিকার গ্রীষ্মপ্রধান শহর লস এঞ্জেলেসের কাছাকাছি হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে৷ উত্তর অ্যান্টার্কটিকার আর্জেন্টিনিয়ান গবেষণা স্থল এসপেরেনজা বেসের তাপমাত্রা ছিল ১৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ অ্যান্টার্কটিকায় গবেষকরা তাপমাত্রা মাপা শুরু করার পর থেকে আজ পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা৷ নাসা বলছে, তাপমাত্রা বাড়ার ফলে বরফ গলে পুকুর সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: Earth Observatory/ NASA
বাড়বে ঘূর্ণিঝড়
মহাসাগরগুলি গরম হবার ফলে অতলান্ত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় বাড়বে বলে নাসা জানাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Ho
সমুদ্রস্তরে যে বদল
উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে বরফ গলার কারণে বাড়ছে সমুদ্র স্তরের উচ্চতা৷ সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলে যেসব মানুষের বসবাস, বিপদগ্রস্ত হচ্ছে তাদের জীবন৷ শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সার্বিক তাপমাত্রা বাড়ার ফলে এমন সব জায়গায় ঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে, যা আগে হয়তো সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো না৷
চরম আবহাওয়ার ফলে শুধু সমুদ্রস্তরই বাড়ছে না, কিছু কিছু অঞ্চলে বাড়ছে শুষ্কতাও৷ নাসা জানাচ্ছে, খরা বাড়ার ফলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে চলবে দাবানল৷
ছবি: Reuters/AAP Image/D.
ইকোসিস্টেমের ওপর চাপ
সাগর উষ্ণ হলে সেখানে বাস করা প্রাণীদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে৷ মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর জলের তাপমাত্রা বাড়ার ফলে নিজেদের বাসস্থান বদলাতে বাধ্য হচ্ছে৷
ছবি: by-nc-sa/Joachim S. Müller
পানিতে অ্যাসিড
তাপমাত্রা বাড়ার ফলে জলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়ে৷ এর ফলে, অ্যাসিডে ভরতে থাকে সাগর৷ এই বাড়ন্ত অ্যাসিডের জন্য মারা যাচ্ছে বেশ কিছু দুর্লভ প্রাণী, নানা প্রজাতির শ্যাওলা৷
কমছে অক্সিজেনের মাত্রা
জল গরম হলে সেখানকার অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে৷ উষ্ণায়নের ফলে বাড়ন্ত তাপমাত্রা বিশ্বজুড়ে সাগর, নদী ও হ্রদকে করে তুলছে বিষাক্ত, অ্যাসিডযুক্ত৷ সাথে অক্সিজেনের মাত্রা কমায় প্রাণীরা নিঃশ্বাস নেবার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Schmidt
বিষাক্ত শ্যাওলার ছড়াছড়ি
গরম, অক্সিজেনহীন জলে বিষাক্ত শ্যাওলা জন্ম নেয়৷ এর আগে চিলির উপকূলে লাল রঙের বিষাক্ত শ্যাওলা বাড়ার ফলে হাজার হাজার মাছ মারা যায়৷ এমন জিনিস ভবিষ্যতে অন্যান্য জায়গাতেও দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নাসার বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/F. Marquez
বদলাচ্ছে ঢেউয়ের গতি
জলের তাপমাত্রা বদলের ফলে বদলে যায় ঢেউয়ের চলন পথ৷ এর ফলে কিছু কিছু প্রাণী সাগর থেকে অন্যত্র গিয়ে পড়ছে৷ একদিকে কিছু কিছু অঞ্চল আগের থেকে বেশি ঠান্ডা হচ্ছে, আরেকদিকে অন্যান্য অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ ভাঙছে সমস্ত রেকর্ড৷ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এমন ব্যাপক বদল পৃথিবীর প্রাণীবৈচিত্র্য বদলে দিচ্ছে৷ বিপদের সম্মুখীন অসংখ্য প্রাণীদের জীবন৷
ছবি: NGDC
9 ছবি1 | 9
বরফের উপর ভালুকের পায়ের ছাপ দেখা গেছে৷ একেবারে কোনো উপায় না থাকলে সেটিকে গুলি করে মারতে হবে৷ আপাতত এক বৈদ্যুতিক বেড়া লাগিয়ে সেটিকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ তবে গোটা প্রকল্পের আসল তারকা মোটেই তেমন বিপজ্জনক নয়৷ ক্যাম্পের কাছেই কলার লেমিং নামের প্রাণীটি ধরা পড়েছে৷
লেমিং নিয়েই প্রায় ৩০ বছর আগে গ্রিনল্যান্ডে বেনোয়া সিটলারের গবেষণা শুরু হয়েছিল৷ তারপর সেটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে পরিণত হয়৷ প্রাণী হিসেবে লেমিং ভোল বা এক ধরনের ইঁদুরের গোত্রে পড়ে৷ উত্তরের এলাকাগুলিতেই এই প্রাণী দেখা যায়৷ গ্রিনল্যান্ডে কলার লেমিং বাস করে৷ শীতে এই প্রাণীর রং বরফের মতোই সাদা হয়, গ্রীষ্মে ধূসর বা বাদামি হয়ে ওঠে৷
উত্তর মেরু অঞ্চলের কম সময়ের গ্রীষ্মকালে লেমিং মাটির নীচে বাসায় থাকে৷ মেরু শিয়াল, বরফের পেঁচা ও শিকারি হক গল পাখির হামলা সম্পর্কে এই প্রাণীকে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হয়৷ শীতকাল সে তুলনায় অনেকটা নিরাপদ৷ তখন লেমিংয়ের সামনের পায়ের নখ বেশ বড় হয়ে ওঠে৷ ফলে জমাট বরফ ও মাটি খুঁড়তে সুবিধা হয়৷ এটাই লেমিংয়ের বংশবৃদ্ধির সময়৷ বরফের পুরু চাদরের নীচে এই প্রাণী সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং শুকনো ঘাস দিয়ে বাসা বাঁধে৷ কখনো একটির উপর আরেকটি বাসাও দেখা যায়৷ তখন একমাত্র নকুলজাতীয় একটি প্রাণী বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে৷ তবে জন্মানোর মাত্র ছয় সপ্তাহ পরই লেমিং শাবক বংশবৃদ্ধি শুরু করতে পারে বলে এই প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যেতে পারে৷
বনোয়া সিটলার লেমিংয়ের শীতকালীন বাসার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন৷ এভাবে তিনি পরোক্ষ উপায়ে গোটা এলাকায় লেমিংয়ের সংখ্যা জানার চেষ্টা করছেন৷ বরফ সরে যাবার ফলে এখন সেই সব বাসা সহজেই চোখে পড়ছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বরফ আরও আগে গলে যাচ্ছে এবং আরও দেরিতে বরফ পড়া শুরু হচ্ছে৷ ফলে লেমিং-দের বিশাল সংখ্যায় বংশবৃদ্ধির তথাকথিত ‘পিক’ বা সেরা সময় আর দেখা যাচ্ছে না৷ ভালো বছরগুলিতে অভিযান চালিয়ে গবেষকরা এখানে চার হাজারের মতো বাসা দেখেছেন৷ আজকার ৪০০টি বাসা পেলেও মনে হয় পরিস্থিতি ভালো রয়েছে৷ সিটলার বলেন, ‘‘বরফের নীচে লেমিং সম্ভবত সুড়ঙ্গের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল৷ ফলে বাসাগুলির মধ্যেও যোগাযোগ হতো৷ তখন বংশবৃদ্ধিও বেশি হতো৷’’
প্রায় ১৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গবেষণা চালানো হচ্ছে৷ লেমিং-দের সংখ্যা নির্ধারণ করতে গবেষকদের দলকে প্রতি বছর বেশ কয়েকশো কিলোমিটার হাঁটতে হয়৷ দুই সপ্তাহ পর ক্যাম্পের সামনে সমুদ্রের খাঁড়ি থেকে বরফ প্রায় উধাও হয়ে গেছে৷
বেনোয়া সিটলার আবার লেমিংয়ের বাসার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন৷ তবে তিনি এরই মধ্যে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছেন৷ শীতকালে লেমিংয়ের বাসা বিরল হয়ে উঠছে৷ ধাক্কা সামলে ওঠার জন্য এই প্রাণী সম্ভবত যথেষ্ট বাসা তৈরি করতে পারছে না৷ এই প্রবণতার খুঁটিনাটি বিষয়গুলি সযত্নে নথিভুক্ত করা হচ্ছে৷
ইউরোপের অন্য কোনো গবেষণা প্রকল্পের তথ্যভাণ্ডার সম্ভবত এত বড় নয়৷ ফলে এই গবেষণার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ কিছু মানুষের সংশয় সত্ত্বেও এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষাৎ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে৷
একহার্ড ব্রাউন/এসবি
ফাইভজি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সমস্যা করবে?
ফাইভজি মোবাইল নেটওয়ার্কের কারণে ভবিষ্যতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আবহাওয়াবিদরা৷ বিষয়টি নিয়ে তারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Ho
পূর্বাভাস তৈরি
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা, নাসা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা, এসা পরিচালিত আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইটগুলো আবহাওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও প্রেরণ করে থাকে৷ এসব তথ্য কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাস তৈরি করেন৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Ho
তথ্যের মান
স্যাটেলাইটের তথ্য যত ভালো হয় আবহাওয়াবিদরা তত ভালো পূর্বাভাস দিতে পারেন৷ অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠিক কোথায় এবং কখন আঘাত হানবে সেটা বলে দিতে পারেন৷ তবে তথ্য ঠিক না পেলে দেখা যাবে, আবহাওয়াবিদরা বললেন ঝড় হবে খুলনায়, কিন্তু আঘাত হানলো চট্টগ্রামে৷
ছবি: NASA.gov
আশঙ্কা
সম্প্রতি জার্মানিতে জাবিনে নামে একটি ঝড় আঘাত হেনেছিল৷ আবহাওয়াবিদরা কয়েকদিন আগেই এর পূর্বাভাস দিতে পেরেছিলেন৷ ফলে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়েছিল৷ কিন্তু ভবিষ্যতে যখন ফাইভজি নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি বাড়বে তখন এমন সঠিক পূর্বাভাস পাওয়া কঠিন হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা৷
ছবি: Copernicus data/ESA
স্পেকট্রাম সমস্যা
পূর্বাভাস ঠিক করার সময় বায়ুমন্ডলে পানীয় বাস্পের পরিমাণ জানা জরুরি৷ যেসব সেন্সর ব্যবহার করে স্যাটেলাইট এই তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো ২৩.৬ থেকে ২৪ গিগাহার্টজ স্পেকট্রামে কাজ করে৷ আর ফাইভজি নেটওয়ার্ক ২৪.২৫ থেকে ২৭.৫ গিগাহার্টজে পরিচালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থা, আইটিইউ৷ অর্থাৎ দুটো স্পেকট্রামের মধ্যে পার্থক্য ০.২৫ গিগাহার্টজ৷ ফলে আবহাওয়াবিদদের কাছে তথ্য আসায় ব্যাঘাত তৈরি হতে পারে৷
ছবি: imago images/J. Schwarz
সমাধানের উদ্যোগ
তথ্য প্রবাহ যেন ব্যাহত না হয় সে লক্ষ্যে আবহাওয়া সংক্রান্ত বিশ্ব সংস্থা ডাব্লিউএমও ইতিমধ্যে ফাইভজি ট্রান্সমিটারগুলোর শক্তি সীমিত করার অনুরোধ জানিয়েছে৷ তবে এ বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি আইটিইউ৷