জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্যান্য আরো কিছু দেশের মতো বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা এর ফলে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন৷ তবে ঘুরেও দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে সাইক্লোন সিডর৷ এতে প্রাণ হারান অসংখ্য মানুষ৷ আহত অনেকে, সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব মানুষের সংখ্যাও কম নয়৷ সেই সিডরের সময়কার দু'টি ঘটনা আমাকে এখনও নাড়া দেয়৷
সিডরের পরপরই আমি ত্রাণ নিয়ে এবং পরবর্তীতের পেশার খাতিরে দক্ষিণাঞ্চলে যাই৷ প্রলয়ংকরী সাইক্লোন সুন্দরবন সংলগ্ন স্বরনখোলা এলাকাকে কার্যত মাটিতে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যায়৷ সেই গ্রামে যখন যাই, তখনও সেখানকার ছোট খালে মরদেহ ভাসছিল, খেতের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছিল মরদেহ৷ সেসময় এক নারীর সঙ্গে কথা হয় যিনি তাঁর দুই সন্তানকে বাঁচিয়েছিলেন একটি গাছের সহায়তায়৷
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাদের নিত্যসঙ্গী
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নতুন নয়৷ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোর মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করেই এগিয়ে চলছে মানুষ৷ তবে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক৷ বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Jewel Samad/AFP/Getty Images
সবচেয়ে ভয়ংকর টর্নেডো
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় টর্নেডোর ঘটনা ঘটে ১৯৮৯ সালে৷ সেবছরের ২৬ এপ্রিল মানিকগঞ্চ জেলার দৌলতপুর এবং সাটুরিয়া এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ংকরী টর্নেডো৷ এতে প্রাণ হারায় ১,৩০০ মানুষ৷
ছবি: David L. Nelson/AFP/Getty Images
পুরোপুরি ধ্বংস
২৬ এপ্রিলের টর্নেডোতে কার্যত ছয় বর্গকিলোমিটার এলাকা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়৷ সেসময় অবজারভার পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘‘ধ্বংসযজ্ঞ এতই নিঁখুত যে, সেখানে কিছু গাছের চিহ্ন ছাড়া দাঁড়ানো আর কোনো বস্তু নেই৷’’
ছবি: David L. Nelson/AFP/Getty Images
ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় টর্নেডো
আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার পর অন্যতম টর্নেডোপ্রবণ দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ৷ সর্বশেষ গত ২২ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টর্নেডোতে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারায়৷
ছবি: picture alliance / AP Photo
পূর্বাভাষের প্রযুক্তি নেই
টর্নেডোর পূর্বাভাষের কোনো প্রযুক্তি নেই বাংলাদেশে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল এই বিষয়ে বলেন, ‘‘আমাদের দেশে না থাকলেও এখন টর্নেডোর পূর্বাভাষ দেয়া সম্ভব৷ অ্যামেরিকা এবং ইউরোপ এক ধরনের রাডার ব্যবহার করে অন্তত ৪৫ মিনিট আগে টর্নেডোর পূর্বাভাষ দিতে পারে৷ আর এ ধরনের পূর্বাভাষ দিয়ে জীবন ও সম্পদ রক্ষার নজির আছে৷’’
ছবি: picture alliance / AP Photo
ঘূর্ণিঝড়ের নিয়মিত শিকার বাংলাদেশ
টর্নেডো ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়েরও নিয়মিত শিকার হয় বাংলাদেশ৷ উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত বাংলাদেশে মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকায় ১৫৮২ সালের কথা উল্লেখ রয়েছৈ৷ সেসময় বাকেরগঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় দু’লাখ মানুষ৷
ছবি: Reuters
স্বাধীনতা পরবর্তী বড় দুর্যোগ
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল৷ সেসময় চট্টগ্রামে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রাণ হারায় কমপক্ষে ১৩৮,০০০ মানুষ৷ প্রায় এক কোটি মানুষ ঘরছাড়া হয়৷ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটারের মতো৷
ছবি: AFP/Getty Images
আইলার আঘাত
সর্বশেষ ২০০৯ সালে সাইক্লোন আইলায় কয়েকশত মানুষ প্রাণ হারায়৷ সাইক্লোনের পরপরই ডায়েরিয়া ছড়িয়ে পড়লে প্রাণ হারায় কমপক্ষে চার ব্যক্তি৷ এভাবে নিয়মিতই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ৷
ছবি: DW
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এখন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে৷ বিশেষ করে উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় বিশাল এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: Jewel Samad/AFP/Getty Images
8 ছবি1 | 8
আরেক নারীর কথা শুনেছি, তবে তাঁকে দেখিনি৷ সিডরের সময় তিনি ছিলেন পটুয়াখালীর কলাগাছিয়া নামক একট দ্বীপে৷ দ্বীপটির একপাশে সমুদ্র, আরেকপাশে বড় নদী৷ জোয়ারের সময় সেটির একটি বড় অংশ তলিয়ে যায়৷ নিরাপত্তা বলতে দ্বীপের একপাশে কিছু গাছপালা৷ সিডরের রাতে সেই নারী তাঁর ছোট ছেলেকে নিয়ে ভেসেছেন প্রায় ১৫ কিলোমিটার পানি পথ৷ ছেলের বয়স পাঁচ বছরের মতো৷ সে আমাকে জানায়, তাঁর মা পুরোটা পথে একবারও ছেলের হাত ছাড়েননি৷ এক পর্যায়ে তীরের সন্ধান পেলে ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে পারে তুলে দেন তিনি৷ সকালে উদ্ধারকর্মীরা ছেলেটিকে যেখানে পেয়েছিল, তার কাছেই পাওয়া গিয়েছিল তাঁর মায়ের লাশ৷
একজন নারী একজন মা৷ আমাদের সমাজে সংসার আগলে রাখার দায়িত্বটাও কার্যত তিনিই পালন করেন৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তারা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছে৷ ঢাকায় নরওয়ের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে আয়োজিত ‘নলেজ শেয়ারিং অন জেন্ডার অ্যান্ড ক্লাইমেট চেইঞ্জ' শীর্ষক অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নারীর ক্ষতির ধরন ও মাত্রা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি৷ একটি গবেষণা প্রতিবেদনের বরাতে সেখানে উল্লেখ করা হয় যে, ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর অনেক পুরুষ জীবিকার তাগিদে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন৷ ফলে সংসারের চাপ আরো বেশি নিতে হচ্ছে নারীকে৷ তাঁদের শুধু সংসার সামলানো নয়, অর্থ উপার্জনের পথও ভাবতে হচ্ছে৷
এ কথা ঠিক, জলবায়ু পরির্বতনের কারণে তাঁর পরিবার যখন ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, তখন তিনি বসে থাকবেন – এমনটা নারী আশা করেন না৷ ডয়চে ভেলের একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এই নিয়ে, যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে বাংলাদেশের নারীরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছেন৷ দেখুন এখানে:
Women in Bangladesh fight climate change
06:46
আমার মনে হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি ঠেকাতে যেসব বিকল্প আছে তা নারীদের জানাতে আরো উদ্যোগ নিতে হবে৷ তাঁদের হাতে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম তুলে দিতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে আরো বেশি স্বাধীনতা৷
বন্ধু, আপনার মত কী? জানিয়ে দিন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷