বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন৷ এই ধকল মোকাবিলায় কোপ-২৬ এ উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে তহবিলের প্রতিশ্রুতি আদায়ে আশাবাদী সরকার৷
বিজ্ঞাপন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সেমিনারে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ এরইমধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন৷ সমূদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়া, নদী ভাঙ্গন এবং ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার অভিঘাতে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে৷’’
বিশ্বব্যাংকের হিসাব জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে৷ এই সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো৷ তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু৷
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আহ্বায়ক নুর আলম শেখ বলেন, ‘‘লবনাক্ততা বাড়ছে৷ বাড়ছে নদী ভাঙন৷ যা প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে৷ কৃষি নির্ভর এলাকার মানুষ কাজ হারিয়ে শহরে যাচ্ছেন কাজের খোঁজে৷ কেউ যাচ্ছেন একা আবার কেউ সপরিবারে৷ তারা শুধু ঢাকা নয় অন্য শহরেও যাচ্ছেন কাজের খোঁজে৷’’
‘যারা জলবাযুর এই ক্ষতির জন্য দায়ী তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে’
তিনি বলেন, ‘‘শুধু গরিব মানুষ নন, ধনীরাও এর শিকার হচ্ছেন৷ খাবার পানির সংকট সবাইকে বিপর্যস্ত করছে৷ লবণ পানির কারণে এই এলাকায় প্রতি তিনজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন৷ জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন৷’’
এমন বাস্তবতায় রোববার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হতে যাওয়া কপ সম্মেলনে বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিলের ওপর জোর দেবে৷
বাংলাদেশের প্রতিবেদন
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হবে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ৷ তাতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দের পরিমাণ দুই হাজার ১৮৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা৷ তবে করোনার কারণে আগের চেয়ে এই বরাদ্দ কমেছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মেকাবিলায় বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে৷ জলবায়ু এবং এর তহবিল নিয়ে কাজ করছে ২৫টি মন্ত্রণালয়৷
বাংলাদশে এ পর্যন্ত গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি থেকে ৪৩টি প্রকল্পে ১৬ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান পেয়েছে৷ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে নয় কোটি ৪৭ লাখ ডলার, ক্লাইমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থেকে ১১ কোটি ডলার অর্থ পেয়েছে৷ এর বাইরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে ১০৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার অনুদান পেয়েছে৷ আর সরকার প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করছে রাজস্ব খাত থেকে৷
বাংলাদেশের বস্তিতে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে
02:28
তহবিলের উপর জোর দেয়া হবে
খ্যাতিমান পরিবেশবিদ ও জলবায়ু গবেষক ড. আতিক রহমান মনে করেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সঠিক পথেই আছে৷ বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও নিজেদের উদ্যোগে প্রভাব মোকাবিলার চেষ্টা করছে৷ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে,কৃষি উৎপাদন বাড়াচ্ছে৷ কারিগরি দিকেও কাজ হচ্ছে৷ বাংলাদেশ তার উৎপাদনের সাথে রপ্তানি বাড়াচ্ছে৷
তিনি বলেন, ‘‘যারা জলবাযুর এই ক্ষতির জন্য দায়ী তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ ফান্ড দিতে হবে৷ এই জায়গায় আমাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে৷ এটা বাংলাদেশের একার কাজ নয়৷ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে৷’’
আমরা ফান্ড ভালো পাবো বলে আশা করি: মো. সাহাবুদ্দিন
This browser does not support the audio element.
তার মতে এজন্য সরকার, এনজিও ও সাধারণ মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে৷
বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরির্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘‘এবার আমরা ফান্ড ভালো পাবো বলে আশা করি৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷ যারা পরিবেশের ক্ষতি করছে সেই দেশগুলোর প্রতি বছর এক লাখ মিলিয়ন ডলার করে দেয়ার কথা৷ এইবার আশা করছি তারা এটা দিতে সম্মত হবেন৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থায়নে কাজ করে যাচ্ছে৷ অনেক মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হচ্ছেন৷ এই সংখ্যা বাড়ছে৷ যারা ঘরবাড়ি হারাচ্ছেন, কৃষি জমি হারাচ্ছেন তাদের জন্য সরকার কাজ করছে৷ তাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে৷’’
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশের প্রবৃদ্ধি চার শতাংশ কমে যেতে পারে৷
জলবায়ু পরিবর্তন: গর্ভেই শিশুমৃত্যু
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন ঝুঁকি দেখতে পেয়েছেন গবেষকরা৷ মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে নারীদের গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ কমছে মাটির উর্বরতা, গ্রাম ছাড়ছেন অবস্থাপন্নরা৷
ছবি: Mortuza Rashed
জানেন না নারীরা
চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলার ফাইলাপাড়া গ্রামের নারীরা তাদের গর্ভের সন্তান নষ্ট হবার বিষয়টি স্বীকার করলেও কেউই জানেন না কেন এমন হচ্ছে৷ মাটি ও পানিতে অতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি এবং তার প্রভাবের বিষয়টি জানার পর অনেকেই অবাক হয়ে যান৷
ছবি: Mortuza Rashed
পুনরায় গর্ভধারণ
৩২ বছর বয়সী সেনোয়ারা বেগমের আড়াই মাস বয়সী গর্ভের শিশু নষ্ট হয় এক বছর আগে৷ সাত মাস হলো তিনি পুনরায় গর্ভধারণ করেছেন৷ এখন পর্যন্ত গর্ভের বাচ্চা সুস্থ থাকলেও অজানা আশঙ্কা কাজ করছে বলে তিনি প্রতিবেদককে জানান৷
ছবি: Mortuza Rashed
মৃত্যু ভ্রুণের ছয় মাস আগেই
ফাইলাপাড়া গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় অধিকাংশ নারীরই গর্ভের বাচ্চা মারা যায় ভ্রূণের বয়স ৬ মাস হবার আগেই৷ তবে এ বিষয়ে কেউ কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না৷
ছবি: Mortuza Rashed
এরকম হয়েছে সাতবার
দুই কন্যা সন্তানের মা রাজিয়া বেগমের গর্ভের বাচ্চা মারা গেছে সাতবার৷ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, স্বামী ক্যানসারের রোগী, এতবার গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়া এবং বারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া কিছুই না৷
ছবি: Mortuza Rashed
স্বাস্থ্যকর্মীদের তৎপরতা
১০ বছরের বেশি সময় ধরে ইসমত জাহান খুকি এবং কাওসার জান্নাত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) এর চকরিয়া শাখায় মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেন৷ তারা জানান, গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে গ্রামের নারীদের প্রতিনিয়ত সচেতন করে আসছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed
মাটিতে লবণের ভাব
ফাইলাপাড়া, মানিকপাড়াসহ চকরিয়া উপজেলার অন্যান্য গ্রামগুলোর বিভিন্ন শুকনো জায়গাতেও সাদা প্রলেপ দেখতে পাওয়া যায়৷ এ সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন গ্রামবাসী বলেন, এগুলো লবণের ভাব৷ কোথাও পানি উঠলে তা নেমে যাওয়ার পর এরকম সাদা হয়ে থাকে৷
ছবি: Mortuza Rashed
গ্রাম ছাড়ার উপায় নাই
চকরিয়ার মানিকপাড়া গ্রামের ২২ বছর বয়সী মায়মুনা জান্নাতের এ পর্যন্ত গর্ভের সন্তান মারা গেছে দুইবার৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি জানার পর তিনি বলেন, এই এলাকায় তাদের বসত ভিটা৷ এটি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো বিত্তবান তারা নন৷ যত সমস্যাই থাকুক, এখানেই তাদের থাকতে হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed
গবেষকের বক্তব্য
আইসিডিডিআর’বি এর বিজ্ঞানী ড. মানজুর হানিফি এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত৷ তিনি বলেন, সাধারণত একজন সুস্থ মানুষ দিনে ৫ গ্রাম লবণ খেলেও এখানকার মানুষেরা খায় ১৬ গ্রাম৷ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা থেকে যারা ২০ কিলোমিটার দূরে থাকেন, তাদের চেয়ে এখানে গর্ভের বাচ্চা মারা যাওয়ার হার দেড় গুণ বেশি যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে৷ দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, সুন্দরবনেও এর ব্যতিক্রম হবার সম্ভাবনা নেই৷
ছবি: Private
আগের মতো জমিতে ফসল হয় না
৪০ বছর বয়সী উম্মে হাবিবার গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হয় দুই বছর আগে৷ মাটি এবং পানিতে অতিরিক্ত লবণের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ২৫-৩০ বছর আগেও এখানকার জমিগুলো অনেক উর্বর ছিল৷ কিন্তু এখন আর তেমন কোন ফসল না ফলায় অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছেন৷ সামগ্রিক বিষয়ে তিনি সরকারের সুদৃষ্টি আশা করেন৷
ছবি: Mortuza Rashed
‘‘আল্লাহ্র ইশারা’’
চকরিয়ার মানিকপাড়া গ্রামের সানোয়ারা বেগমের দুইটি সন্তানের মধ্যে শেষ সন্তানটি গর্ভে মারা যায় ১১ বছর আগে৷ তিনি বলেন, “অনেকেরই তো শুনি বাচ্চা পেটে মারা যাইতেসে, কিন্তু এর পিছে যে এই কারণ সেটা তো আন্দাজ করতে পারি নাই৷ আমরা ভাবসি, আল্লাহ্র হুকুম হইসে, বাচ্চা পেটেই মারা যাইতেসে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed
শুনতে হয় কটু কথা
মানিকপাড়া গ্রামের রোমানা বেগমের প্রথম সন্তানটিই গর্ভে থাকাকালীন মারা যায় তিন বছর আগে৷ আল্ট্রসনোগ্রাম করার মাধ্যমে তিনি বিষয়টি চিকিৎসকের কাছে জানতে পারেন৷ প্রথম সন্তানটি গর্ভে মারা যাওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে কটু কথা শুনতে হয় বলে তিনি জানান৷
ছবি: Mortuza Rashed
লবণকেন্দ্রিক জীবিকা
চকরিয়ার নিকটবর্তী একাধিক গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, এখানকার পুরুষদের অধিকাংশই লবণের ব্যবসার সাথে জড়িত৷ শুকনো মৌসুমে তারা লবণ সংগ্রহ ও বিক্রি করে রাখেন৷ প্রতি মণ অপরিশোধিত লবণ বিক্রি হয় ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে৷ যারা লবণের ব্যবসা করেন না, তাঁরা শহরে গিয়ে অন্য কিছু করেন৷