জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের রক্ষায় বিশ্বকে নজর দিতে হবে
২ ডিসেম্বর ২০১৯
সোমবার স্পেনের মাদ্রিদে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৫৷ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থদের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে দায়ী দেশগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
বিজ্ঞাপন
স্পেনের মাদ্রিদে সোমবার থেকে শুরু হয়েছে কপ-২৫ সম্মেলন৷ দুই সপ্তাহব্যাপী এই আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বের নেতৃবৃন্দকে জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ হুমকির কথা স্মরণ করিয়ে দেন জাতিসংঘ মহাসচিব৷ তিনি বলেন, আমরা দ্রুত এমন একটা জায়গায় পৌছে যাচ্ছি যেখান থেকে আর ফেরার কোনো সুযোগ নেই৷ ‘‘প্রকৃতির বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ থামাতে হবে, এবং আমরা জানি সেটা সম্ভব,'' বলেন আন্তোনিও গুতেরেস৷ এজন্য খনি খনন বাদ দিয়ে সবাইকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং প্রাকৃতিক সমাধানের দিকে মনোযোগ দেয়ার আহবান জানান৷
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হই, তাহলে তারা ক্ষমা করবে না৷ প্রতি মুহূর্তে আমাদের নিষ্ক্রিয়তা পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে৷ এখনই সময় কাজ করার৷''
জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশ সপ্তম
পরিবেশবাদী সংগঠন জার্মানওয়াচ ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০১৯’ প্রকাশ করেছে৷ সেখানে গত ১৯ বছরে চরম আবহাওয়ার শিকার দেশের তালিকা করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
বাংলাদেশ সপ্তম
জার্মানওয়াচ বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চরম আবহাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে আছে৷ চরম আবহাওয়া বলতে ঝড়, বন্যা, তীব্র গরম এসবকে বুঝিয়েছে জার্মানওয়াচ৷
ছবি: Getty Images/AFP
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পুয়ের্টো রিকো
ক্যারিবীয় সাগরে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল পুয়ের্টো রিকোতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে হারিকেন মারিয়া আঘাত হেনেছিল৷ এতে সরকারি হিসেবে প্রাণ হারান ২,৯৭৫ জন৷ তবে শুধু ২০১৭ সালেই নয়, অঞ্চলটি প্রায়ই দুর্যোগের শিকার হয়৷ ফলে জার্মানওয়াচের তালিকায় গত ১৯ বছরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পুয়ের্টো রিকোর নাম উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Arduengo
স্বল্পোন্নত দেশগুলোতেই ক্ষতি বেশি
বাংলাদেশ (৭) ও পুয়ের্টো রিকো (১) ছাড়া সূচকে শীর্ষ দশের অন্য দেশগুলো হচ্ছে হন্ডুরাস (২), মিয়ানমার (৩), হাইতি (৪), ফিলিপাইন্স (৫), নিকারাগুয়া (৬), পাকিস্তান (৮), ভিয়েতনাম (৯) এবং ডোমিনিকা (১০)৷ অতীত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে জার্মানওয়াচ বলছে, সাধারণত শিল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে স্বল্পোন্নত দেশগুলোই চরম আবহাওয়ার কারণে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. K. Thu
আরেক সূচকে বাংলাদেশ নবম
এই সূচকটিও জার্মানওয়াচের করা৷ তবে এটি তৈরিতে শুধুমাত্র ২০১৭ সালের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে৷ এতে দেখা যাচ্ছে, ঐ বছর বাংলাদেশে দুর্যোগে ৪০৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন৷ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৯০ কোটি ডলার৷
ছবি: bdnews24.com
দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশ
২০১৭ সালের সূচকে বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা (২) ও নেপালের (৩) নাম আছে৷ ২০১৭ সালের মে মাসে শ্রীলঙ্কায় ভারী বর্ষণের কারণে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসে দুশ’র বেশি মানুষ প্রাণ হারান৷ নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতেও (১৪) বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা দেখা দিয়েছিল৷ ফলে ঐ তিন দেশের প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Paudel
ধনী দেশগুলোও টের পাচ্ছে
২০১৭ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট একের পর এক হারিকেনের আঘাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ধনী কয়েকটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ ফলে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি যে দিন দিন সার্বজনীন সমস্যায় পরিণত হচ্ছে, তা ধনী দেশগুলো এখন বুঝতে পারছে বলে মনে করছে জার্মানওয়াচ৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Arduengo
6 ছবি1 | 6
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে ‘জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ' (ইউএনএফসিসি) প্রক্রিয়ার ধীরগতি নিয়েও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী৷ বাংলাদেশের মতো দুর্বল দেশগুলোতে জাতীয়ভাবে গ্রহণ করা অভিযোজনমূলক উদ্যোগে সহায়তা করার জন্য খুব কম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গঠন করা তহবিলগুলোতে পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব রয়েছে৷ সরাসরি এবং সহজে তহবিল পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত এবং মানদণ্ড রয়েছে, বেশিরভাগই সেসব সক্ষম দেশগুলোর পক্ষেই যায়৷''
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা আমাদের মতো দেশগুলোর সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও ধারণার চেয়েও কম সহায়তা পাচ্ছি৷ এক্ষেত্রে একটি নতুন সিভিএফ এবং ভি-২০ ট্রাস্ট তহবিল গঠন এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষ দূত নিয়োগ সম্ভব হলে সেটি হবে বড় সাফল্য৷''
বক্তৃতায় শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমের প্রতিবেদনে৷ ‘‘মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নানাভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এরই মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়েছে৷ সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, এর প্রভাব এবং মোকাবেলার সক্ষমতা অভাবের ওপর ভিত্তি করে দুর্বল দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে,'' বলেন প্রধানমন্ত্রী৷
এই সম্মেলন চলবে দুই সপ্তাহব্যাপী৷ ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব দেশকে ‘ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান' তৈরির কাজ শেষ করতে হবে৷ যেসব দেশ এখনো এই কাজ শেষ করতে পারেনি, তাদের উপর চাপ তৈরির শেষ সুযোগ এবারের সম্মেলন৷
দুই ডিসেম্বর থেকে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ ২৫৷ এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ২৬ বার হয়েছে এই আয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/Geisler-Fotopress
প্রতি বছরের আয়োজন
কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিজ, সংক্ষেপে কপ৷ ‘জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (ইউএনএফসিসি) কাঠামোর আওতায় প্রতিবছর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ সেখানে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন৷
ছবি: Imago/Xinhua
বার্লিন থেকে বন
১৯৯৫ সালে প্রথম জলবায়ু সম্মেলনের আসরটি বসেছিল জার্মানির রাজধানী বার্লিনে৷ এরপর এখন পর্যন্ত পাঁচবার এই আয়োজন করেছে জার্মানি৷ শুরুরটি ছাড়া বাকি চারটিরই আয়োজক শহর বন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Meissner
এশিয়া: কিয়োটো থেকে দোহা
এখন পর্যন্ত এশিয়ায় চারবার জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে৷ ১৯৯৭ সালে কপ তিন-এর আয়োজন হয় জাপানের কিয়োটোতে৷ ২০০২ সালে ভারতের নয়া দিল্লিতে কপ আট, ২০১২ সালে কাতারের রাজধানী দোহাতে হয় কপ ১৮৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইউরোপ সর্বোচ্চ
এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৩ বার জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজন করেছে ইউরোপের শহরগুলো৷ জার্মানি ছাড়াও সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, ইটালির মিলান, পোল্যান্ডের পোজনান, ওয়ারশ , কাটোভিৎসে, ডেনমার্কের কোপেনহাগেন ও ফ্রান্সের প্যারিসে হয়েছে কপ-এর আসর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Keystone/P. Klaunzer
দক্ষিণ অ্যামেরিকায় তিনবার
১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজন করেছে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেস৷ ২০১৪ সালের আয়োজনটি হয়েছে পেরুর লিমাতে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Martin Mejia
উত্তর অ্যামেরিকায় দুই আয়োজন
উত্তর অ্যামেরিকার দেশগুলোর মধ্যে এই আয়োজন হয়েছে কেবল দু’টি শহরে৷ ২০০৫ সালে ক্যানাডার মনট্রিলে ১১ তম আর ২০১০ সালে মেক্সিকোর কানকুনে কপ-এর ১৬ তম আসর বসে৷
ছবি: AP Photo/Israel Leal
আফ্রিকায় মারাক্কেশের ‘হ্যাটট্রিক’
আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে মরক্কোর মারাক্কেশে তিনবার এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়৷ সবশেষটি ছিল ২০১৬ সালে৷ এছাড়া ২০০৬ সালে কেনিয়ার নাইরোবিতে কপ ১২ আর ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে কপ ১৭ অনুষ্ঠিত হয়৷
ছবি: WWF International
এবার মাদ্রিদ
জলবায়ু সম্মেলনের এবারের আসরটি বসছে এমন এক সময়ে যখন ইউরোপ এক বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরি আবহাওয়ার সবগুলো রূপই প্রত্যক্ষ করেছে৷ স্পেনের মাদ্রিদে কপ ২৫ তাই বিশেষ গুরুত্বই পাচ্ছে৷ ২০২০ সালের মধ্যে ‘ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে প্যারিস চুক্তির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবারের সম্মেলনের মূল বিষয়৷