‘জলবায়ু ফান্ডের টাকা স্বচ্ছতার সঙ্গে খরচ করা হচ্ছে না’
৫ নভেম্বর ২০২১এসব নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি- বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান৷
ডয়চে ভেলে : বিশ্বের কোন দেশ আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কতটা দায়ী, জলবায়ু সম্মেলনে কি এসব নিয়ে আলোচনা হয়?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : জলবায়ু সম্মেলনে এগুলো নিয়ে বেশ বিস্তারিত আলোচনা হয়৷ কিন্তু এখন আর এগুলো নিয়ে তেমন বেশি আলোচনা হবার কারণ নেই৷ এগুলো তো নির্ধারিত হয়েই গেছে৷ প্রথম যখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা আলোচনা আসে তখন উন্নত বিশ্বকেই এর জন্য দায়ী করা হয়েছে এবং খুব সঠিকভাবেই তা করা হয়েছে৷ পরবর্তীতে যখন প্যারিস এগ্রিমেন্ট হয় তখন উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও বলা হয়েছে৷ উন্নত দেশগুলো এখন যতটা কার্বণ নিঃসরণ করছে, দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও অনেক বেশি করছে৷ তখন উন্নত বিশ্বই শুধু দায়ী না দ্রুত উন্নয়নশীল বিশ্বও এর জন্য দায়ী এবং তাদেরও আইনগত বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা হবে সেটা আলোচনা হয়৷ এই দু'টো বিষয়ই এখন নিষ্পত্তি হয়ে গেছে৷ দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চায়না, ভারত এরা কিন্তু নিজেদের দায় মেনে নিয়েছে৷ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ি কন্ট্রিবিউট করার কথাও তারা বলেছে৷ ফলে কারা দায়ী সেই আলোচনা মোটামুটি একটা উপসংহারে পৌঁছেছে বলে আমরা দেখছি৷ এটা নিয়ে আর আলোচনা শুরু করার প্রয়োজন নেই৷
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর কি কোনো দায় আছে?
আসলে আজকের যে সংকট এটা সৃষ্টি করেছে উন্নত বিশ্ব৷ এটা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে চীন বা ভারত বা ব্রাজিল বা সাউথ আফ্রিকার তেমন কোন দায় নেই৷ তাদের যে নিঃসরণটা বাড়ছে সেটা এখনই থামাতে হবে৷ সেটা না হলে যে সমস্যাটা উন্নত বিশ্ব সৃষ্টি করেছিল, সেটা আরো বেশি ক্ষতিকর হয়ে যাবে৷ বাংলাদেশের সে অর্থে কোন দায় নেই৷ বাংলাদেশের নিঃসরণ অত্যন্ত কম৷ কিন্তু এখানে দু'টো বিষয় লক্ষ্য করতে হবে৷ এখন আসলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ যে মাত্রায় পৌঁছেছে, সে মাত্রা যদি কমিয়ে আনতে হয়, যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি আমাদের এক দশমিক ৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে এই শতাব্দী শেষে আটকাতে হয় তাহলে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যদি বাড়তি ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে ক্ষতির কিছু নেই৷ বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত জনবহুল দেশ হওয়াতে যে সমস্ত প্রযুক্তি, যে সমস্ত প্রকল্প গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে সেগুলোতে তার না যাওয়ায় ভালো৷ সেগুলো তার জনগোষ্ঠীর উপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে৷ এখন তো এগুলোর সবকিছুরই বিকল্প চলে এসেছে৷ কয়লা ভিত্তিক বা এলএমজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপরীতে আমাদের রিনিউয়েবল সোলার চলে এসেছে৷ তাহলে আমরা কেন এখনও দূষণকারী প্রকল্পে থাকব, যখন আমার কাছে নিরাপদ বিকল্প চলে এসেছে৷
জলবায়ু সম্মেলনে তো নানা ধরনের অঙ্গীকার করা হয়৷ বিশেষ করে ক্ষতিপূরণের যে অঙ্গীকার করা হয়, সেই টাকা কী আদৌ পাওয়া যায়? পাওয়া গেলে, সেটা কতটা?
সেই টাকা যেটা পাওয়া যায়, সেটা কখনই প্রতিশ্রুত যে অংক থাকে তার সঙ্গে মেলে না৷ অনেক কম হয়৷ আবার যেটুকু পাওয়া যায় সেটাকে আবার ডাবল ক্যালকুলেশন করা হয়৷ বেশিরভাগ উন্নত বিশ্ব নতুন এবং অতিরিক্ত তহবিল দেয় না৷ তারা বিদ্যমান ফান্ডটাকেই নানাভাবে জলবায়ুর ফান্ড দেখিয়ে দেয়৷ ফলে যেটা পাওয়া যায়, তার বড় একটা অংশ জলবায়ুর তহবিল নয়৷ এ পর্যন্ত বিশ্ব নেতারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার পুরোটা তারা কখনই পূরণ করতে পারেননি৷ তারা কিন্তু ক্ষতিপূরণের কনসেপ্টটাই মানেন না৷ ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো কিন্তু মেনে নিয়েছে, আমরা ওই সমস্ত তর্কাতর্কিতে যাব না, কিন্তু আমাদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য যেটুকু সাহায্য দরকার সেটুকু তোমাদের দিতে হবে৷ কারণ ঐতিহাসিকভাবে তোমরাই এই সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী৷
বাংলাদেশ যে ক্ষতিপূরণের টাকা পায়, সেটা কি সঠিকভাবে ব্যবহার হয়?
ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার প্রসেসটা খুবই জটিল৷ এখানে বাংলাদেশের মতো অধিক ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর দাবি হচ্ছে, যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তার অর্ধেক খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য দেওয়া হচ্ছে৷ বাকী যেটুকু টাকা দেওয়া হচ্ছে সেটা গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর জন্য দেওয়া হচ্ছে৷ এই অর্থ পাওয়া জন্য যে টেকনিক্যাল সক্ষমতা দরকার বেশিরভার উন্নয়নশীল দেশের সেটা নেই৷ ফলে তারা পায় না৷ কিছু টাকা বাংলাদেশ পায়৷ আর বাংলাদেশ নিজে যে টাকাটা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফান্ড থেকে দেয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে টাকাটা সঠিকভাবে বিতরণ হয় না৷ যেখানে যাওয়ার দরকার সেখানে যায় না৷ অনেক মন্ত্রণালয়, অনেক প্রকল্প জলবায়ু দেখিয়ে ফান্ড নিয়ে নিচ্ছে৷ এই টাকাটা যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে যদি যেত তাহলে পরপর চারবার সাইক্লোন হওয়ার পর আমরা বারবার দেখতাম না গাবুরা, দাকোপ এবং কয়রায় বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে৷ সেখানে বাঁধ মেরামত হয়নি৷ যথেষ্ট টাকা আমাদের হাতে ছিল, অনেক সময়ও আমরা পেয়েছিলাম ওখানে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করার জন্য৷ ফলে যেখানে প্রাধান্য পাওয়া উচিত সেখানে প্রাধান্য না দিয়ে অন্য জায়গায় টাকাটা খরচ করা হয়েছে৷
এই টাকা কতটুকু স্বচ্ছতার সঙ্গে খরচ করা হচ্ছে?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতার সঙ্গে খরচ করা হচ্ছে না৷ আপনি যদি টিআইবির রিপোর্ট দেখেন তাহলে সেখানে দেখবেন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে ফান্ডটা যাদের দেওয়া হচ্ছে, তাদের হয়ত ওই ধরনের কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই৷ অনেক সময় তারা যে কাজের কথা বলে টাকাটা নেয়, সেই কাজ তারা করেন না৷
স্বচ্ছতা না থাকার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে তাদের কি কখনও শাস্তি হয়েছে?
আমার জানামতে হয়নি৷ বাংলাদেশে যারা পদ্ধতিগত ক্রাইম যারা করে তাদের কাউকেই কোন ক্ষেত্রেই বিচারের মুখোমুখি হতে আমরা দেখিনি৷ জলবায়ু ফান্ডের ক্ষেত্রেও এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি৷
প্রতি বছর জলবায়ু সম্মেলন আসলেই দেখা যায়, এই বিষয়টা নিয়ে পত্রিকা-টেলিভিশনে অনেক রিপোর্ট হয়৷ অন্য সময় কেন ধারাবাহিকতা থাকে না?
আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত না৷ একটা সম্মেলন যখন হয় তখন বিশ্বের সবার মনোযোগ ওই দিকেই থাকে৷ সেজন্য এ সময় বেশি কভারেজ হয়৷ তবে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এখন ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় একটু কম হলেও সংবাদপত্রে অনেক বেশি রিপোর্ট হচ্ছে৷ সপ্তাহে একটা বা দু'টো রিপোর্ট কিন্তু এখন আমরা পায়৷ আরও অনেক বেশি ইস্যু নিয়ে রিপোর্ট করতে হয় বলে প্রতিদিন হয়ত থাকে না৷ কিন্তু আগের তুলনায় অনেক বেশি রিপোর্ট হয়৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে সিদ্ধান্তগুলো হয়, তাতে মিডিয়া কি কোনো ধরনের ভূমিকা পালন করে?
আমি এখনও বলব মিডিয়া অনেক বেশি ইতিবাচক দায়িত্ব পালন করছে৷ মানুষের দুঃখ দুর্দশার বিষয়গুলো আমাদের নেতারা অন্য সময় ফাইল চাপা দিয়ে রাখত, এখন মিডিয়ার কারণে ফাইল চাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশের গাবুরা, দাকোপ, কয়রার গল্প, ছোট ছোট দ্বীপ হারিয়ে যাওয়ার গল্প মিডিয়ার কারণে বিশ্ব নেতাদের সামনে চলে এসেছে৷ এখন তো একটা মিডিয়া নয়, একাধিক মিডিয়া কাজ করছে৷ সোশ্যাল মিডিয়াও এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে৷
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার আসলে মূল দায়িত্বটা কার?
এটার মূল দায়িত্ব উন্নত বিশ্বের৷ যারা এটার জন্য দায়ী৷ এক সময় তারা জানত না, তাদের কর্মকাণ্ড কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে৷ এখন যেহেতু বিজ্ঞান নিশ্চিত করে বলে দিচ্ছে, তাদের কোন কোন কর্মকান্ডের জন্য এই বিপর্যয় হয়েছে তখন তো আর চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই৷ তখন তাদের এই গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণে অনেক বেশি মনোযোগি হওয়া উচিৎ৷ তাদের হাতে তো অনেক বেশি প্রযুক্তি আছে, অনেক বেশি আর্থিক সক্ষমতা আছে৷ আমাদের হাতে তো সেটা নেই৷ আমাদের একটা সাইকোন হলে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ৩/৪ বছর সময় লাগে৷ আর তাদের লাগে ১৫ থেকে ২০ দিন৷ উন্নত দেশগুলোর পরিবেশ বিধ্বংসী সেই মডেলকে এখনও যেসব উন্নয়নশীল দেশ ফলো করছে তাদের আমি ক্ষমার চোখে দেখব না৷
ক্ষতিপূরণের এই অর্থ দিয়ে কি আসলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কিছু করা সম্ভব?
অর্থ সব সমস্যার সমাধান করবে না৷ আপনি যদি সব নদী দূষিত করে ফেলেন তাহলে কত টাকা দিয়ে আপনি সব নদী ফেরত আনতে পারবেন? বাংলাদেশের ৮০ ভাগ জমি যদি অতিরিক্ত সার ব্যবহারের ফলে ক্ষতি করে ফেলেন সেটাকে তো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আপনার ৮০ বছর লাগবে৷ টাকা দিয়ে হয়ত আপনি বাঁধ করতে করতে পারবেন, সাইকোন সেন্টার বানাতে পারবেন৷ আপনি যদি মডেল পরিবর্তন না করেন তাহলে টাকা দিয়ে সকল সমস্যার সমাধান করা যাবে না৷
বাংলাদেশ কি সঠিক পথে এগুচ্ছে?
একদম সঠিক পথে এগুচ্ছে না৷ বাংলাদেশ এখন যে উন্নয়নের মডেল গ্রহণ করছে, সেটা হলো আরও বেশি রাস্তা, আরও বেশি ফাইওয়ার৷ ফলে ঢাকা শহর বিশ্বে অবসবাসযোগ্য নগরীর এক নম্বর হয়েছে৷ ঢাকা শহর মূলত কার লক সিটি হয়েছে৷ আমাদের সবার গাড়ি আছে, কিন্তু রাস্তায় বের হলে আর এগুচ্ছে না৷ গতি কমে গেছে৷ বাংলাদেশের বাতাস পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাসের মধ্যে এক বা দুই নম্বরে আছে৷ ৯০ ভাগ কৃষি জমি দূষিত হয়ে গেছে৷ বাংলাদেশে বন উজাড়ের হার ২ দশমিক ৬ শতাংশ৷ যেখানে বিশ্বে এই গড় এক দশমিক তিন শতাংশ৷ বাংলাদেশের নদীগুলো বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে উপরের দিকে থাকবে৷ বিদেশি টাকা না পেলেও আমরা নিজেদের জমি, নিজেদের পানি, নিজেদের গাছ ব্যবহার করেও আগাতে পারতাম৷ কিন্তু সব সেক্টরগুলোকেই আমরা ধ্বংস করে দিচ্ছি৷ আরেকটা বিষয় হলো বাংলাদেশ যখন উন্নত বিশ্বকে বলে তোমার জিডিপির ১০ ভাগ আমাদের দিয়ে দাও জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায়৷ কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ তার জিডিপির জিরো পয়েন্ট ৭৯ শতাংশ দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য৷ অন্য যেই দায়ি হোক, উপকূলের মানুষকে রক্ষা করা তো আমাদের দায়িত্ব৷