বিশ্বের জলবায়ু সংক্রান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসি-র সর্বাধুনিক রিপোর্টে খনিজ তেল ও কয়লার পরিবর্তে অপরাপর নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে জোর দিতে বলা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃ-সরকার পরিষদের রিপোর্ট নিয়ে যে পরিমাণ দরাদরি হয়েছে, সে তুলনায় এই রিপোর্টে নতুন বলে বিশেষ কিছু নেই৷ দরাদরি আসলে ছিল আক্ষরিক বয়ান নিয়ে, সেই বয়ানের তীব্রতা ও জরুরি আবেদন নিয়ে, যা-তে শীঘ্রই বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন তা-তে প্রতিফলিত হয়৷ বিশ্বের সরকারবর্গের সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার জন্য প্রণীত নথিটি আয়তনে কিন্তু বিশেষ বড় নয়৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষ ও পরিবেশ বিপন্ন
আইপিসিসি-র রিপোর্ট পড়ার পর আর কোনো সন্দেহ থাকে না যে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে; মানুষই তার জন্য দায়ী; জলবায়ু পরিবর্তনের ফলশ্রুতি ইতিমধ্যেই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা রোখার সম্ভবত আর কোনো পন্থা নেই৷ আইপিসিসি-র রিপোর্টে ‘‘মানুষ এবং পরিবেশের জন্য আন্তরিক, ব্যাপক এবং অপরিবর্তনীয় ফলশ্রুতির'' কথা বলা হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও যে সব দেশের প্রচুর তেল সম্পদ আছে, তারা রিপোর্টের বয়ানের এই ‘তীব্রতা' কমানোর চেষ্টা করেছে৷ অথচ সমস্যা সেটাই: তেল ও কয়লার উপর নির্ভরশীলতা – এবং সেই অর্থে খনিজ তেল শিল্প ও কয়লা শিল্পের লবিইং৷
বিনা দোষে ভুগছে বাংলাদেশ
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে বাংলাদেশের তেমন কোনো অবদান নেই৷ তবে এর ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ৷ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ঘরবাড়ি হারাচ্ছে উপকূলের মানুষ৷ অসময়ে বন্যা, খরা ও লবণাক্ত পানি ফসলের ক্ষতি করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জলবায়ু পরিবর্তন
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ৷ উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে৷ ফলে উপকূলের মানুষ বাসস্থান হারাচ্ছেন৷ অসময়ের বন্যা, খরা ফসলের ক্ষতি করছে৷ মোটের উপর লবণাক্ত পানি চাষ উপযোগী জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে৷
ছবি: dapd
বাড়ছে পানি, বাড়ছে ভোগান্তি
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা অনুযায়ী, ২১০০ সাল নাগাদ যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের তিন মিলিয়ন হেক্টর জমি প্লাবিত হতে পারে৷ সম্প্রতি সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি পরিমাপ করে গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জলবায়ু উদ্বাস্তু
বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থী বিষয়ক সংগঠন এসিআর-এর মুহাম্মদ আবু মুসা চলতি বছর ডয়চে ভেলেকে জানান, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ৪৫ জনের মধ্যে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে৷ আর বাংলাদেশে সংখ্যাটা হবে প্রতি সাতজনে একজন৷ দেশের ১৭ ভাগ এলাকা বিলীন হয়ে যাবে সমুদ্র গর্ভে৷ ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন৷
ছবি: Jewel Samad/AFP/Getty Images
লবণাক্ত পানি
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি সমতল ভূমির আরো ভেতরের দিকে চলে আসছে৷ ফলে লবণাক্ততা বাড়ছে৷ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলে ইতিমধ্যে এ সমস্যা সনাক্ত করা হয়েছে৷ পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: DW
মাছের উৎপাদন কমছে
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মাছ উৎপাদনের উপর৷ মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে খাল, বিল, প্লাবনভূমিতে সময় মতো পানি না পৌঁছানোয় দেশীয় মাছের প্রজনন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
ক্ষতির শিকার সুন্দরবন
জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ শীর্ষক ইউনেস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের নানা কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে৷ ইতোমধ্যে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সবচেয়ে গহীনের ক্যাম্প মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্প সাগরে হারিয়ে গেছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
জার্মানির সহায়তা
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রায় ১১ মিলিয়ন ইউরো বা ১১২ কোটি টাকার অর্থ সহায়তা দিতে গত বছর এক চুক্তি স্বাক্ষর করে জার্মানি৷ এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের তিনটি উপকূলীয় জেলায় দুর্যোগ সহনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ ২০১২-২০১৭ মেয়াদে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে৷ এসব প্রকল্পের মধ্যে আছে টেকসই রাস্তা-ঘাট, সেতু ও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ৷
ছবি: DW
জলবায়ু তহবিল
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা দিতে বিভিন্ন সম্মেলনে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক সমাজ৷ তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এসব সহায়তা পুরোপুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে৷ একইসঙ্গে জলবায়ু তহবিল বণ্টনের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ সব মিলিয়ে এক্ষেত্রে আরো সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
জ্বালানি বদল
আইপিসিসি-র রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে: বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি যা-তে বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম না করে, সেজন্য ঠিক কী পরিমাণ কার্বন ডাই-অস্কাইড বাতাসে ছাড়া যেতে পারে৷ মানবজাতি ইতিমধ্যেই তার সিওটু বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ খরচ করে বসে আছে৷ বলতে কি, সিওটু নির্গমন ২০২০ সালের পরে বাড়ার পরিবর্তে কমা প্রয়োজন, যদি জলবায়ুর পরিবর্তনকে চলতি আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় রাখতে হয় – যা হওয়ার সম্ভাবনা নিতান্ত কম৷ ২০৫০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বের বিদ্যুতের চাহিদার একটা বড় অংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে মেটানোর কথা – যার ধারে-কাছে আমরা নেই৷ ২১০০ সালের মধ্যে অশ্বীভূত জ্বালানি বর্জন সম্পন্ন হওয়ার কথা – যদি না কার্বন ডাই-অক্সাইড ‘জমিয়ে রাখার' প্রযুক্তিতে ব্যাপক প্রগতি অর্জিত হয়৷
কিছু একটা ঘটা দরকার
বিশ্বের সব দেশ মিলে এমন একটি জলবায়ু চুক্তি সৃষ্টি করতে হবে, যা-তে জ্বালানি পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত শর্তাবলী মেনে চলার গ্যারান্টি থাকবে৷ এক্ষেত্রে শিল্পোন্নত দেশগুলি এবং জি-টোয়েন্টি গোষ্ঠীর দেশগুলিকে সর্বাগ্রে সক্রিয় হতে হবে – কয়লা উৎপাদনকারী দেশ অস্ট্রেলিয়ায় পরবর্তী বৈঠক যার আদর্শ স্থান হতে পারে৷