ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে গিয়ে আরও সংকটে পড়ছে৷ শহরের উত্তরে দরিদ্র একটি এলাকার মানুষ টেকসই উন্নয়নের এক মডেল চালু করে আদর্শ হয়ে উঠেছে৷
বিজ্ঞাপন
বন্যা মোকাবিলার প্রচেষ্টা
৩ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার শহর জাকার্তা ইন্দোনেশিয়ার বর্ধিষ্ণু রাজধানী ও বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জনপদ৷ শহরের কেন্দ্রস্থল ব্যস্ততায় ভরা৷ কিন্তু শহরের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে পড়েছে৷ শহরের উত্তরে সমুদ্রের ধারে জেলেদের বসতির পরিস্থিতি এখনই বেশ করুণ৷ ২০০২ সালে মুরা বারু বন্দরে বন্যা মোকাবিলার লক্ষ্যে একটি প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছিল৷
সেই প্রাচীরকে আরও মজবুত করে তার উচ্চতাও বার বার বাড়ানো হয়েছে৷ বন্যা ছাড়াও প্রবল বৃষ্টিপাত হলেই পানি উপচে পড়ে৷ প্রশ্ন হলো, জাকার্তা শহর কেন ডুবে যাচ্ছে? পরিবেশ উপদেষ্টা ইরভান পুলুনগান বলেন, ‘‘ভূগর্ভস্থ পানির এত বেশি নিষ্কাশন হচ্ছে, যে উপরের স্তরে পানি সরে গিয়ে মাটি বসে যাচ্ছে৷ পানি নিষ্কাশনের পাশাপাশি গত ২০ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনও ঘটছে৷ তার প্রভাব শহরের জন্য ঝুঁকি দ্বিগুণ করে তুলছে, কারণ শহরটি তো স্বাভাবিক অবস্থায় এখনই পানির নীচে রয়েছে৷''
এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চার বছর আগে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল৷ শহরকে সাগরের গ্রাস থেকে রক্ষা করতে সমুদ্রের উপর কয়েকটি কৃত্রিম দ্বীপ গড়ে তোলা হয়৷ তারপর থেকে জেলেদের জালে অনেক কম মাসেল বা ঝিনুক ধরা পড়ছে৷ প্রশ্নের উত্তরে জেলেরা জানালো, যে তারা দিনে প্রায় ৫০ কিলো ঝিনুক ধরতে পারছে৷ দ্বীপ তৈরির আগে সেই পরিমাণ ছিল ২০০ কিলোগ্রাম!
ইন্দোনেশিয়ায় মডেল হয়ে উঠেছেন দরিদ্র এলাকার মানুষ
05:37
এবার সেখানে নতুন এক বন্দর তৈরি হচ্ছে৷ সেই সঙ্গে সমুদ্রের বুকে ৫০ মিটার দূরে আরও একটি প্রাচীরও তৈরি হবে৷ তখন জেলেরা তাদের মাছ ধরার ক্ষেত্র থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন৷
নিয়মিত বন্যার সঙ্গে তাঁরা ঘর করতে শিখেছেন৷ কিন্তু নতুন পদক্ষেপের ফলে তাঁদের বসতির কার্যত মৃত্যু হবে বলে তাঁদের ধারণা৷ তাছাড়া কেউই তাঁদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে না৷ স্থানীয় জেলে খলিল বলেন, ‘‘উপকূলীয় প্রাচীর জেলেদের সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করবে কি? এর ফলে সমাজের কিছু সুবিধা হলেও উন্নতির এই পরিকল্পনা নিয়ে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে৷''
জটিল চ্যালেঞ্জ
ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে গত কয়েক বছরের মতো এতটা নাটকীয়ভাবে নামতে দেওয়া যাবে না৷ অন্যথায় গোটা শহর আরও দ্রুত তলিয়ে যাবে এবং বন্যার আশঙ্কা আরও বেড়ে যাবে৷
বিশ্ব উষ্ণায়নের শৈল্পিক প্রতিবাদ
জার্মানির বন শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে ভবিষ্যতের লক্ষ্য নিয়ে৷ বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও তহবিল সংক্রান্ত আলোচনাও ছিল এতে৷ তবে কেবল কথা নয়, সম্মেলন ঘিরে ছিল নানা সৃজনশীল প্রকাশও৷
ছবি: DW/P. Große
সবকিছু একসাথে
কপ২৩ সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ ফিজির প্রধানমন্ত্রী ফ্রাংক বাইনিমারামা বলেন, ‘‘লক্ষ্যে পৌঁছাতে একটি আকাঙ্খাকে সামনে রেখে একসাথে আমাদের নৌকা ভাসাতে হবে৷’’ সম্মেলনে অংশ নেয়া ১৯৬টি দেশের প্রতিনিধিরা সেই বক্তব্যের প্রতিফলনই যেন দেখতে পায় ফিজির নিজস্ব নৌ-যানের এ অবয়বে৷
ছবি: DW/H. Kaschel
প্রতিবাদে হস্তশিল্প
জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষত আদিবাসী গোষ্ঠির মানুষেরা৷ এ ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা৷ কপ২৩ চলাকালীন রাইনাউয়ে পার্কে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের হাতের কাজের নমুনা দিয়ে তৈরি করা এই তাঁবু সেই সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রতীকী রূপ৷
ছবি: DW/P. Große
মেরু ভল্লুকের দুঃখজনক পরিণতি
কেবল মানুষ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা, বন্যা বা ঝড়ের তাণ্ডবে ভুগছে প্রাণীরাও৷ মেরু ভল্লুকের মতো অনেক প্রাণীই চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে৷ সম্মেলনে মেরু ভল্লুকের বিদ্ধ করা মূর্তি যেন জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণাম জানান দিয়েছে৷
ছবি: DW/P. Große
গাছবন্ধু
গাছ আমাদের পরম বন্ধু৷ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গাছের কোনো বিকল্প নেই৷ জার্মান ফরেস্ট অ্যাসোসিয়েশন গাছের গুরুত্ব বোঝাতে এই ৮ মিটার লম্বা গাছের ভাস্কর্যটি তৈরি করে৷
ছবি: DW/P. Große
বিপদের মুখে বিশ্ব
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিদিন আরো বিপদগ্রস্থ হয়ে উঠছে পৃথিবী৷ বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে আবহাওয়ার তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করছে৷ পৃথিবীর বিপন্নতার কথা মনে করিয়ে দিতেই যেন জার্মানির উন্নয়ন মন্ত্রণালয় পৃথিবীর এই ২০ মিটার লম্বা অবয়বটি বসিয়েছিল রাইনাউয়ে পার্কে৷
ছবি: DW/P. Große
নবায়নযোগ্য জ্বালানি
গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর ভারতই সবচেয়ে বেশি দায়ী৷ তবে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে জলবায়ু চুক্তি থেকে পিছু হঠছে, সেখানে ভারত ও চীন ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে চেষ্টা চালাচ্ছে৷ অদূর ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর নির্ভর বাড়ানোর ইঙ্গিত ছিল ভারতীয় প্যাভেলিয়নে৷
ছবি: DW/P. Große
রাজপথে প্রতিবাদ
জলবায়ু সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পরিবেশ কর্মীদের প্রতিবাদ সমাবেশ ছিল বন শহরে৷ জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে এ প্রতিবাদে সামিল হয় হাজারো মানুষ৷ পরে বন থিয়েটারে এ সব প্রতিবাদী পোস্টার প্রদর্শিত হয়৷
ছবি: DW/P. Große
প্রতিবাদে মুখোশ
প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসতে চাওয়া একমাত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র৷ জলবায়ু সম্মেলনে প্রতিবাদকারীদের অন্যতম লক্ষ্যও তাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
8 ছবি1 | 8
আবর্জনা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে৷ বিশেষ করে বর্ষাকালে জঞ্জালের কারণে নদীনালা বুজে যাচ্ছে৷ ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যহত হচ্ছে৷ আবর্জনার মোকাবিলা করতে সম্প্রতি প্রায় ১২,০০০ মানুষ ২৪ ঘণ্টা ধরে সংগ্রাম শুরু করেছেন৷
বন্যা থেকে সুরক্ষার পদক্ষেপের দোহাই দিয়ে বেশ কিছু এলাকা থেকে জোর করে মানুষকে সরিয়ে দিয়ে সব ভেঙে ফেলা হয়েছে৷ ২০১৫ সালে টোংকল এলাকাও ধ্বংসের পরিকল্পনা ছিল৷ সেখানে নদীর ধারেই বাসিন্দাদের বস্তি ছিল৷ ভিটেমাটি হারানোর ভয়ে স্থানীয় মানুষ অবশ্য সক্রিয় হয়ে উঠেছিল৷ সবার আগে তারা নিজেরাই বস্তির কিছু অংশ ধ্বংস করে ফেলেছিল৷ টোংকল এলাকার বাসিন্দা গুগুন মুহাম্মদ বলেন, ‘‘৩ বছর আগে আমরা নিজেদের বাড়ির অংশ কেটে ফেলেছিলাম, নদী সাফাইয়ের কিছু কাজ করেছিলাম, শাকসবজি, ফুলের চারা লাগিয়েছিলাম৷ একেবারে নিখুঁত না হলেও কিছু রদবদল হয়েছে৷''
নাগরিক উদ্যোগ
শান্ত ও সবুজ এক মরূদ্যান সৃষ্টি হয়েছে৷ বাসিন্দারাও গর্বিত৷ তারা নিজেদের এলাকা নিজেরাই পরিচ্ছন্ন রাখে৷ নদীর পাড় খালি করে তারা যে জায়গা সৃষ্টি করেছে, তার ফলে নদীও বাড়তি জায়গা পাচ্ছে৷
তারপর বাইরে থেকেও সাহায্য এসেছে৷ স্থপতিদের সঙ্গে মিলে তারা এক টেকসই বাড়ির পরিকল্পনা করেছে৷ প্লাস্টিক ও টিনের বদলে পাথর ও কাঠ দিয়ে এমন একটি বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে৷ সাতটি পরিবার আজ সেখানে থাকে৷ গুগুন মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সেখানে থাকেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আগের তুলনায় অনেক শীতল৷ আমার একটা জানালাও রয়েছে৷ আগে আমার জানালা ছিল না, তাই এটা আমার কাছে জরুরি৷''
স্থপতিরাও টেকসই ও আরও উন্নত থাকার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন৷ সেইসঙ্গে আরও অনেক ইচ্ছা ছিল তাঁদের৷ সেই স্থপতিদের মধ্যে একজন হেরলিলি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি বলছি না, যে ফলাফল হিসেবে বাড়িটির গুরুত্ব নেই৷ তবে তার সঙ্গে যে সামাজিক প্রক্রিয়া আসে, সেটাই সবচেয়ে জরুরি৷''
দায়িত্বশীল হয়ে টেকসই পদ্ধতিতে পানি ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ৷ টোংকল এলাকার মানুষ দেখিয়ে দিয়েছেন, যে বাস্তবেও এমনটা সম্ভব৷ এলাকাটি অন্যদের জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছে৷ পৌর কর্তৃপক্ষও সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে৷
জাকার্তা শহরের দরিদ্র মানুষ সমস্যার কারণ নয়, বরং সমাধানসূত্রের অংশ হয়ে উঠেছে৷
মিশায়েল ভেৎসেল/এসবি
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা বন্যার পানিতে প্লাবিত
মুষলধারে বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার অনেক রাস্তাঘাট এবং অসংখ্য ঘরবাড়ি৷ তবে বন্যায় ঠিক কত মানুষ গৃহহীন হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP-Photo/D. Alangkara
ব্যাপক বন্যা
এক কোটি মানুষের ব্যস্ত মহানগরী জাকার্তায় মঙ্গলবার কয়েক ঘণ্টা টানা বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে৷ এতে রাজধানীর বেশ কিছু অংশ ১ দশমিক পাঁচ মিটার অবধি পানির নীচে তলিয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP
চাপ সামলাতে পারেনি ড্রেনগুলো
জার্কার্তার ড্রেনগুলো থেকে পানি উপচে পড়ে বন্যার সৃষ্টি হয়৷ রাতভর ঝড়ের কারণে পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় দুর্যোগ নিরসন সংস্থার এক মুখপাত্র৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Alangkara
বিস্তৃত প্রভাব
দুর্যোগ নিরসন সংস্থা মঙ্গলবার জানিয়েছে যে, জাকার্তার পঞ্চাশটির বেশি এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে৷ রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে বন্যার পানির উচ্চতা দেড় মিটার অবধি পৌঁছায়৷ স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, নগর সরকারের এক কর্মী পানিতে তলিয়ে মারা গেছেন এবং আরো একজন ডুবে গেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Ap Photo/D. Alangkara
জীবনের একটি অংশ
সিক্ত মৌসুমে বন্যা এবং ভূমিধস ইন্দোনেশীয়দের জীবনের একটি অংশ৷ প্রতি বছর এই সময়ে জাকার্তায় বিভিন্ন মাত্রায় বন্যা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP-Photo/D. Alangkara
চরম অভিজ্ঞতা
ছবিতে জাকার্তার একটি এলাকায় এক শিশুকে বন্যার পানিতে খেলতে দেখা যাচ্ছে৷ জাকার্তায় সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১৩ সালে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল৷ সেবার শহরের অনেক এলাকা পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয় এবং প্রাণ হারায় বিশ জনের বেশি মানুষ৷
জাকার্তার এক বাণিজ্যিক জেলায় এক রাস্তার বিক্রেতাকে বন্যার পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে৷ মহানগরীর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৩ সালের পর অনেক নদী-নালার গভীরতা বাড়িয়ে বন্যার পানি জমা কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
অনেক হতাহত
চলতি মাসের শুরুতে টানা মুষলধারে বৃষ্টির কারণে ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে চল্লিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং বালিতে ভূমিধসে প্রাণ হারায় ১৩ ব্যক্তি৷