অ্যামেরিকা নিষেধাজ্ঞা তোলেনি, তাই জাতিসংঘকে দেশের পরমাণু কেন্দ্রের ছবি দেওয়া বন্ধ করল ইরান।
বিজ্ঞাপন
আগেই হুমকি দিয়েছিল ইরান। এবার বাস্তবে সে পথেই হাঁটতে শুরু করল। দেশের পরমাণু কেন্দ্রগুলির ফুটেজ জাতিসংঘের পরমাণু ওয়াচডগের হাতে দেওয়া বন্ধ করা হলো। ইরান জানিয়েছে, অ্যামেরিকা তাদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তুললে ফুটেজ আর দেওয়া হবে না। ইরানের এই পদক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পশ্চিমা দেশগুলি।
গত কয়েকদিন ধরেই খবরের শিরোনামে ইরান। গত ২২ ফেব্রুয়ারি তারা জানায়, অ্যামেরিকাকে যে তিনমাসের সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে। ফলে পরমাণু বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ তারা নিতে চলেছে। বস্তুত, তিনমাস আগে ইরানের পার্লামেন্টে একটি আইন প্রণয়ন হয়। তাতে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছিল। এক, ৪ শতাংশ ইউরেনিয়ামের জায়গায় ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম মজুত করবে ইরান। পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই, দেশের পরমাণু কেন্দ্রগুলিতে জাতিসংঘের কোনো প্রতিনিধিকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তাদের পরমাণু কেন্দ্রের ছবিও দেওয়া হবে না। শর্ত ছিল, তিনমাসের মধ্যে অ্যামেরিকাকে পরমাণু চুক্তি নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ইরানের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলতে হবে।
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
7 ছবি1 | 7
সাধারণত, পরমাণু কেন্দ্রগুলির ছবি নির্দিষ্ট সময় অন্তর জাতি সংঘের পরমাণু সংক্রান্ত সংস্থার হাতে তুলে দেয় ইরান। ২২ ফেব্রুয়ারি ইরান জানিয়ে দেয় সে কাজ আর করা হবে না। বিষয়টি নিয়ে ইরানের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা। তাঁরা জানান, একটি সাময়িক সমাধানসূত্র মিলেছে। কিন্তু মঙ্গলবার ইরান স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, পরমাণু কেন্দ্রের ছবি তাঁরা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তবে ছবিগুলি আগামী তিনমাস সংরক্ষণ করা হবে। তার মধ্যে অ্যামেরিকা নিষেধাজ্ঞা তুললে ছবিগুলি জাতিসংঘের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তিনমাসের মধ্যে তা না হলে ছবিগুলি নষ্ট করে দেওয়া হবে।
ইরানের এই পদক্ষেপে স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন পশ্চিমা দেশগুলি। জার্মানি, ফ্রান্স সহ সকলেই এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। জো বাইডেনও জানিয়েছেন, অ্যামেরিকা ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছে। তবে ইরানের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসেননি বাইডেন। ক্ষমতায় আসার পরে বরং তিনি জানিয়েছিলেন, পরমাণু চুক্তিতে ফিরলেও এখনই ইরানের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার কথা ভাবছেন না তিনি। সোমবার মার্কিন বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ইরান যাতে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, সে দিকে কড়া নজর রাখবে অ্যামেরিকা। কিন্তু ইরান যে ভাবে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে, তাতে পরমাণু ভারসাম্য কীভাবে রক্ষিত হবে, তা নিয়ে চিন্তায় ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এবং জাতিসংঘ।