ভারতের পরিবেশ সংগঠন ‘গ্রিনপিস ইন্ডিয়া’ এবং জাতিসংঘের কিছু শান্তিমিশন কর্মীর বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে৷ হাইতির নারীদের অভিযোগ, শান্তি মিশন কর্মীরা লোভ এবং ভয় দেখিয়ে তাঁদের যৌন মিলনে বাধ্য করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে ভারত সরকার সম্প্রতি গ্রিনপিস ইন্ডিয়ার সব ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেয়৷ পরে কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধসহ অন্যান্য জরুরি কার্য পরিচালনার জন্য দুটি ব্যাংক হিসাব খুলে দেয়া হলেও গ্রিনপিস-এর বিপদ এখনো কাটেনি৷ পরিবেশ বিষয়ক বেসরকারি সংস্থাটির কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক সাবেক নারী কর্মী প্রথমে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রকাশ করেন৷ পরে আরো কয়েকজন সাবেক কর্মীও জানিয়েছেন, গ্রিনপিস-এ তাঁরাও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, প্রতিবাদ করে বিচার তো পানই-নি, উল্টে তাঁদেরই এক সময় চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে৷ নারী কর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্রিনপিসের কতিপয় কর্মকর্তা নারীদের নানা কৌশলে শয্যায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিভাগে অভিযোগ করে কোনো লাভ হয় না, অপরাধীরাই বরং তাদের চরিত্রহননের চেষ্টার অভিযোগ তুলে নারী কর্মীদের অপদস্থ করেন৷
গ্রিনপিস-এর এক সাবেক কর্মী সম্প্রতি জানান, বেঙ্গালুরুতে অফিসের কাজে হোটেলে ওঠার পরই এক পুরুষ সহকর্মী তাঁকে নিজের কক্ষ ছেড়ে তার কক্ষে চলে যেতে বলেন৷ রাজী না হওয়ায় ওই কর্মকর্তা সরাসরি যৌন নীপিড়নে চেষ্টা করেন৷ জন্মদিনে কেক খাওয়ানোর মুহূর্তটিকেও যৌন লালসা চরিতার্থ করার সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওই কর্মকর্তা৷ বেশ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করা ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি, বরং ওই নারীকেই পরে ধর্ষণ করে গ্রিনপিস-এর কয়েকজন কর্মী৷
ধর্ষিতার দুই আঙুল পরীক্ষা
কোনো নারী ধর্ষিতা হয়েছেন কিনা, তা নিরূপণের জন্য বিতর্কিত দুই আঙুল পরীক্ষা চালু করতে চেয়েছিল ভারত৷ এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ শেষে অবশ্য বিশেষ কারণ ছাড়া পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়৷ কী এই পরীক্ষা?
ছবি: AP
প্রমাণ করার জন্য
ধর্ষণকারীকে সাজা দিতে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনাটাই যথেষ্ট নয়৷ ধর্ষণ যে হয়েছে, সেটা প্রমাণ করতে হয়৷ তাই এতদিন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা দুই আঙুল পরীক্ষা করতেন৷
ছবি: Fotolia/detailblick
সম্ভোগের অভ্যাস
নিগৃহীতা মহিলার যৌনসম্ভোগের অভিজ্ঞতা বা অভ্যাস আছে কিনা, তা যাচাই করা হতো, কোথাও কোথাও এখনও হয়ে থাকে যোনিপথে আঙুল ঢুকিয়ে৷
ছবি: AP
কুমারিত্বের প্রমাণ
আঙুলের স্পর্শে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, একজন নারীর সতীচ্ছদ অক্ষত আছে কিনা, অর্থাৎ সেই নারীর কুমারিত্ব অক্ষুণ্ণ আছে কিনা৷
ছবি: Fotolia/NinaMalyna
ভিত্তিহীন ধারণা
আঙুলের সাহায্যে নাকি বোঝা যায়, বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, না সম্মতি নিয়ে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পদ্ধতিকে ভিত্তিহীন বলে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
সর্বোচ্চ রায়
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালেই বলেছিল, দুই আঙুল পরীক্ষা ধর্ষিতার পক্ষে শারীরিক ও মানসিকভাবে অবমাননাকর৷ সরকারের বিকল্প পদ্ধতির সন্ধান করা উচিত৷
ছবি: CC-BY-SA-3.0 LegalEagle
আর্মিতে ভর্তি হতে গেলে
ইন্দোনেশিয়ায় মহিলারা আর্মিতে ভর্তি হতে চাইলে, তাঁদের এই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়৷ দেশটির আর্মি প্রধান জেনারেল মোয়েলদোকোর কথায়, ‘‘দুই আঙুল পরীক্ষা নারীর আচার-আচরণ, চরিত্র নিরীক্ষণের মূল চাবিকাঠি৷’’ বলা বাহুল্য, দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও মধ্য-পূর্ব এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও এটি একটি চালু পরীক্ষা৷
ছবি: AFP/Getty Images/A. Berry
6 ছবি1 | 6
আরেক সাবেক কর্মী জানান, গ্রিনপিস-এর এক ঊর্ধতন কর্মকর্তা সবসময় নারীদের সামনে এসে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ কথা-বার্তা বলতেন৷ যৌনতা বিষয়ক এমন কথায় অস্বস্তি হওয়ায় তিনি সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন৷ এক্ষেত্রেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি গ্রিনপিস৷ অভিযুক্ত কর্মকর্তা সেই নারীকেই পরে মনরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর পরামর্শ দেন এবং নিজে যথারীতি যৌন উত্তেজক কথা বলার অভ্যাস বজায় রাখেন৷
বেশ কিছু ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ায় গ্রিনপিস অবশেষে অতীতের নিষ্ক্রিয়তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং পাশাপাশি তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছে৷
জাতিসংঘের শান্তি মিশনের কতিপয় কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগটা আরো ভয়াবহ৷ বার্তাসংস্তা এপির খবরে বলা হয়, সম্প্রতি হাইতির ২৩১ জন নারী জাতিসংঘের শান্তিমিশন এবং অন্যান্য বিভাগের কর্মীদের বিরুদ্ধে ভয় এবং লোভ দেখিয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন মিলনের অভিযোগ তুলেছেন৷ জাতিসংঘের ‘অফিস অফ ইন্টারন্যাল ওভারসাইট সার্ভিস' (ওআইওএস) পরিচালিত এক সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য৷
হাইতির হতদরিদ্র নারীরা জানান, তাঁদের মধ্যে কারো হয়তে ঘর নেই, কারো ঘর থাকলেও ঘরে খাবার নেই, কারো বা সন্তানকে সুস্থ করে তোলার জন্য চিকিৎকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই৷ এ পরিস্থিতিতে তাঁরা যখনই জাতিসংঘের শান্তি মিশন কর্মীদের কাছে যেতেন, সেখানকার কিছু কর্মী তখন খাবার, ওষুধ বা অন্য কোনো সামগ্রির বিনিময়ে যৌনমিলনে প্ররোচিত করতেন৷ হাইতির ওই নারীদের দাবি, দারিদ্র্য এবং অজ্ঞতার কারণে, লোকলজ্জার ভয়ে তাঁরা এতদিন শান্তিমিশন কর্মীদের এই অপকীর্তির খবর কাউকে জানাতে পারেননি৷
ছোট পোশাক পরাই কি ধর্ষণের কারণ?
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন নারীরা৷
ছবি: AP
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Reuters
আইনের ভয় নেই
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ছবি: Fotolia/DW
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
ছবি: dapd
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
ছবি: UNI
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?