জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন৷ এজন্য তিনি দফায় দফায় বৈঠক করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও নিজেদের মধ্যে বৈঠক করছেন৷ এই পর্যায়ে সোমবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর তারানকো সমঝোতার ব্যাপারে আশাবাদীও হয়ে উঠেছেন৷
রবিবার প্রথম দফা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ও সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো৷ সোমবার দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে বর্তমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব৷ নির্বাচন কমিশন তারানকোকে বলেছে যদি রাজনৈতিক সমঝোতা হয় তাহলে তারাও নির্বাচনের তফশিল পরিবর্তন করতে পারবেন৷ তবে এজন্য সময় হাতে খুব কম৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ বলেছেন নির্বাচন পিছিয়ে সমঝোতার চেষ্টা নয়, সমঝোতা হলে নির্বাচন পেছানো যাবে৷
তারানকো ঢাকায় আসেন শুক্রবার রাতে৷ এরপর শনি ও রবিবার তিনি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন৷ প্রধান দুই দলের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি৷ এমনকি নেতাদের সঙ্গে একাধিক অনির্ধারিত বৈঠকও করেছেন তিনি৷
এসব বৈঠকে তারানকো সংকটের মূল কোথায় এবং সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে তা সমাধানের সুযোগ আছে কিনা তা জানার চেষ্টা করেছেন৷ জানা গেছে, তারানকো যে বিষয়টি এখন বুঝতে পেরেছেন তা হলো নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তি হলেই সব দল নির্বাচনে আসবে৷ আর এ নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কয়েকদফা আলোচনা করে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা চালান তিনি৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
নির্বাচন কমিশনের অবস্থানও বোঝার চেষ্টা করছেন তারানকো৷ তাই দ্বিতীয় দফা বৈঠকে তিনি কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন৷ কারণ নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনের তফশিল পরিবর্তনে রাজি৷ তবে সেই সমঝোতা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে না হলে নির্বাচনের তফশিল পরিবর্তন কঠিন হবে৷
তবে তারানকো আশাবাদী হলেও মূল জায়গায় বিরোধ এখনো রয়ে গেছে৷ আওয়ামী লীগ সংবিধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে অনড় রয়েছে৷ আর বিএনপি শেখ হাসিনাকে বাদ দেয়া ছাড়া নির্বাচনে যেতে রাজি হচ্ছে না৷ এই অবস্থায় আরো কি বিকল্প আছে তা নিয়েও কথা হচ্ছে৷ জানা গেছে নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা কমিয়ে অন্য কোনো উপায়ে নির্বাচন করা যায় কিনা তাও আলোচনায় আছে৷
এদিকে বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আগে একতরফা নির্বাচন বন্ধ করে তারপর সংকট নিরসনে আলাপ আলোচনার কথা বললেও তাতে সায় নেই আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের৷
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, তিনিও মনে করেন প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যদি কিছুটা ছাড় দেয় তাহলে সংকটের সমাধান সম্ভব৷ তবে তিনি মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো ছাড় দেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছে বলে তার মনে হয় না৷ তারানকোর সঙ্গে বদিউল আলম মজুমদারের বৈঠক হয়েছে৷ তাতে তিনি বুঝতে পেরেছেন জাতিসংঘ আন্তরিকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাইছে৷ তাদের লক্ষ্য হলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি পথ বের করা৷ আর এজন্য তারানকো একই বিষয় নিয়ে একই ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলছেন৷ বদিউল আলম মজুমদারের মতে, তারানকো মূলত তাঁর সফরে একটি বহুপক্ষীয় সংলাপ চালাচ্ছেন৷ তিনি সবার সঙ্গে কথা বলে দূরত্ব কমিয়ে এনে হয়তো তাঁর কোনো প্রস্তাব দিতে পারেন৷
এদিকে তারানকো নিজে কূটনীতিকিদের সঙ্গে ফাঁকে ফাঁকে বৈঠক করছেন৷ আবার বিদেশি কূটনীতিকরা নিজেদের মধ্যেও বারবার বৈঠক করছেন৷ এই বৈঠক হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক৷ কূটনীতিকরা তারানকোর আপ্রাণ চেষ্টাকে সাইডলাইন থেকে সফল করার জন্য কাজ করছেন বলে জানা গেছে৷
মঙ্গলবার তারানকোর বাংলাদেশ সফর শেষ হবে৷ বাংলাদেশ ছাড়ার আগে তিনি সংবাদ সম্মেলনে তাঁর মতামত তুলে ধরবেন৷ জানা গেছে বাংলাদেশে অবস্থানের শেষ সময় পর্যন্ত তারানকো রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তাঁর চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন৷
এদিকে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলীয় জোট অবরোধ শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে৷ মঙ্গলবার সকালে এই অবেরোধ শেষ হওয়ার কথা ছিল৷ বিএনপির মুখপাত্র সালাউদ্দিন আহমেদ অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তায় অবরোধ বাড়ানোর ঘোষণা দেন৷