জাতীয় প্রকল্পে বাদ জাতির জনকের নাম
১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
ইউপিএ আমলে চালু হয় ১০০ দিনের কর্মনিশ্চয়তা আইন। গোটা বছরে ন্যূনতম ১০০ দিন কাজের নিশ্চয়তা পেয়ে থাকেন প্রান্তিক মানুষ। এই প্রকল্পে বদল আসতে চলেছে।
নয়া বিল সংসদে
কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প মনরেগা-র নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব এনে লোকসভায় বিল পেশ করেছে। সোমবার এই বিলটি সাংসদদের নজরে আসে। প্রস্তাবিত নতুন নাম ‘বিকশিত ভারত— গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ)’। সংক্ষেপে নাম রাখা হয়েছে ‘ভিবি জি–রাম–জি’। এতদিন প্রকল্পটির পুরো নাম ছিল মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট। এই নাম থেকে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর নাম বাদ দেওয়ায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
সোমবার লোকসভায় এই বিলটি পেশ করার কথা আগে থেকে নির্ধারিত ছিল না। দুপুরে সরকার একটি সাপ্লিমেন্টারি বিজনেস লিস্ট জারি করে বিলটি পেশের কথা জানায়। পুরোনো মনরেগা প্রকল্পে বছরে ন্যূনতম ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি ছিল। নতুন প্রকল্পে ১২৫ দিনের কাজের গ্যারান্টির কথা বলা হয়েছে। তবে এর সঙ্গে একাধিক শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি সূত্রের দাবি, চাষের সময় প্রতি বছর অন্তত দু’মাস প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার শর্ত বিলে উল্লেখ রয়েছে।
বিরোধীদের অভিযোগ, শুধু নাম নয়, গোটা প্রকল্পের চরিত্রই বদলে দিতে চাইছে কেন্দ্র। প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে, নতুন গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পে মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ রাজ্যগুলিকে বহন করতে হবে। এতদিন এই প্রকল্পের পুরো খরচ বহন করত কেন্দ্রীয় সরকার। নতুন নিয়ম কার্যকর হলে সব রাজ্যের উপর বিপুল আর্থিক চাপ পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
বিরোধীদের সমালোচনা
কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও বিলটির কড়া সমালোচনা করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, বিজেপি কেন মহাত্মা গান্ধীর নাম সরাতে চাইছে। তিনি বলেন, "দেশবাসী ও বিশ্ববাসী গান্ধীজিকে ভারতের তথা বিশ্বের অন্যতম বড় নেতা মনে করেন। কোনও প্রকল্পের নাম বদলাতে গেলে অফিস, স্টেশনারি-সহ বহু কিছু বদলাতে হয়। এতে বিপুল টাকা খরচ হয়।"
লোকসভার বিজনেস অ্যাডভাইসারি কমিটির বৈঠকে বিলটির বিরুদ্ধে প্রথম সরব হন তৃণমূলের মুখ্য সচেতক কাকলি ঘোষ দস্তিদার। তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন সংবাদমাধ্যমে বলেন, "মনরেগা থেকে মহাত্মা গান্ধীর নাম মুছে ফেলা গান্ধীজির অপমান। এরা মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীকে পুজো করেছিল।"
সিপিএম সাংসদ জন ব্রিটাসের দাবি, কেরালার মতো ছোট রাজ্যকেও বছরে অতিরিক্ত ২০০০ থেকে ২৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। তাঁর প্রশ্ন, কেন কেন্দ্র এমন একটি বিল আনছে। বিরোধীদের আরও দাবি, নতুন প্রকল্পটির সঙ্গে পুরোনো মনরেগার কার্যত কোনও মিল নেই।
এই বিলের সমালোচনা করেছে কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের শরিক দল টিডিপিও। তাদের বক্তব্য, এতে রাজ্যগুলির উপরে আর্থিক চাপ বাড়বে। পরিকল্পনার বাইরে বাড়তি খরচ হলে তা-ও রাজ্যগুলিকেই বহন করতে হবে। এর ফলে প্রকৃত উপভোক্তারা সর্বোচ্চ সুবিধা পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিরোধীদের অভিযোগ খারিজ করে অর্থনীতিবিদ ও বিজেপি বিধায়ক অশোক লাহিড়ি ডিডাব্লিউকে বলেন, "সরকার কোনো প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করতে পারে। এটা তাদের প্রিভিলেজ। সবচেয়ে বড় কথা, ১০০ দিনের বদলে ১২৫ দিন কাজের কথা বলা হয়েছে। ১০০ দিন কাজ করে ৩৬৫ দিন নাও চলতে পারে। কেউ যদি অন্য কাজে এর থেকে বেশি উপার্জন করতে পারেন, তাহলে ১০০ দিনের কাজে যোগ দেবেন না। তাই দিন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ইতিবাচক।"
রাজ্যের অংশীদারিত্ব সম্পর্কে তার মত, "কর্মসংস্থান তৈরি করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারেরও আছে। তাই রাজ্যের অংশীদারিত্ব থাকা উচিত। যখন পুরোটাই কেন্দ্রের টাকায় হচ্ছে, তখন রাজ্যের কিছু যায়-আসে না, অপচয় হল কি না। কিন্তু নিজেরা টাকা দিলে রাজ্য অনেক বেশি সতর্ক হবে, এটা খুব দরকার।"
খর্ব হল অধিকার?
পুরোনো আইনে বদল আসায় নাগরিকের অধিকার খর্ব হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের রাজ্য সভাপতি তুষার ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন,
"এটা আগে ছিল একটা আইন। অর্থাৎ কোনো মানুষ বছরে ১০০ দিন কাজের দাবি করলে তার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হত। সেটা ছিল গ্যারান্টেড আইন। নতুন ব্যবস্থায় একটা প্রকল্পে কেন্দ্র সরকার যে টাকা বরাদ্দ করবে, সেই টাকা ফুরিয়ে গেলেও যদি জব কার্ড হোল্ডাররা আবার কাজ চাইতেন, তাহলে সরকার কাজ দিতে বাধ্য থাকত। এখন তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে বলবে, এর মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। তাছাড়া রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে কীভাবে রাজ্যের উপরে দায়ভার চাপানো হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট নয়।"
বাম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "নতুন ব্যবস্থায় মানুষের অধিকার আর রইল না। কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্যবাধকতা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। এখন সবটাই কেন্দ্র ঠিক করবে, কোথায় কী প্রকল্প হবে না হবে। তারা যদি বিজ্ঞপ্তি জারি করে, তবেই কাজ হবে। চাষের সময় কাজ বন্ধ থাকার কথা বলে পরিসর কমিয়ে দেয়া হল। এটা জমির মালিক, বিত্তবান শ্রেণীকে সুবিধা দেয়ার চেষ্টা। এর বিরুদ্ধে আমরা আদালতে আর্জি জানাব। এর আগে কৃষি আইন কার্যকর করেও বাতিল করেছিল মোদী সরকার। সেভাবে খেতমজুররা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায় করবেন। পুরোনো আইন ফিরিয়ে আনতে হবে।"
তুষার বলেন, "গত বছরে ১০০ দিন কাজ কেউ পাননি। ৫০ দিনের মতো কাজ গড়ে দেয়া হয়েছে। নতুন প্রকল্পে চাষের মরশুমে দুমাস কাজ বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এই সময় ১০০ দিনের কাজ চালু থাকলে অন্যান্য ক্ষেত্রে মজুরির জন্য দর কষাকষি করার সুযোগ কমে গেল। তার উপরে আইনের নিশ্চয়তা চলে যাওয়ার এমন দাঁড়াল যে, ১০০ দিনের কাজ আর সাধারণ মানুষ দাবি করতে পারবে না।"
বিকাশরঞ্জনের মতে, "বিজেপি সরকার আরএসএস দ্বারা পরিচালিত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার পরবর্তীকালে গান্ধী, নেহরুর যে অবদান, সেটা তারা মেনে নিতে পারছে না। মোদী সরকার ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেছেন। তার বিরুদ্ধেই আইনি লড়াই করেছি, যাতে আমরা জয়লাভ করি। যখন তারা আইনি লড়াই হেরে গেল, তখন প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে নতুন বিল পেশ করা হল।"