আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) শেষ অবস্থান কি হবে তা কেউই বলতে পারছে না৷ কারণ ‘সর্বদলীয়’ সরকারে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগ নাটকের এখনো অবসান হয়নি৷ তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দেননি৷
বিজ্ঞাপন
এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে৷ জাতীয় পার্টির ৭ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপদেষ্টা এরশাদের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন বলা হলেও জমা দিয়েছেন মাত্র ৪ জন৷ রওশন এরশাদ , জিয়াউদ্দিন বাবলু এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এখনো এরশাদের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দেননি৷ আর যে ৪ জন এরশাদের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন তাদের পদত্যাগ পত্র নাকি এরশাদ রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে যাবেন৷ রাষ্ট্রপতি এখন দেশে নেই৷ কিন্তু যার কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠালে সংবিধান অনিুযায়ী পদত্যাগ হবে সেই প্রধানমন্ত্রী দেশে থাকলেও পদত্যাগ পত্র তাঁর কাছে পাঠানো হচ্ছেনা৷ ফলে ধীরে ধীরে আসল ঘটনা বোঝা যাচ্ছে৷ বোঝা যাচ্ছে দর কষাকষির বিষয়টি৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব রহুল আমীন হাওলাদার তা আরো পরিষ্কার করলেন৷ তিনি এরশাদের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দেয়ার একদিন পর শুক্রবার বললেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে৷ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার, নির্বাচন বর্জন এবং মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের 'চূড়ান্ত' ঘোষণা দেয়ার পরও সরকারের সঙ্গে কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সরকার তো সরকারই , সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতেই পারে, যোগাযোগ হতেই পারে এতে দোষের কিছু নেই৷ দেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়৷ জাতীয় পার্টিও চায়৷ সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করাই যায়৷' তিনি আরো বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছি তাই পদত্যাগটা যেন সৌজন্যমূলক হয়৷ তবে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না, যা বিবেক বর্জিত এবং দেশের মানুষের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে৷'
রুহুল আমীন হাওলাদার প্রকাশ না করলেও জানা গেছে সরকারের দু'জন মন্ত্রী এখন জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ জাতীয় পার্টি এরশাদের বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা এবং জনতা টাওয়ার মামলা প্রত্যাহার ও নির্বাচনের তারিখ কিছুটা পেছানোর দাবি তুলেছে৷ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৃহস্পতিবার রওশন এরশাদসহ জাপার ৩ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী দেখা করতে গিয়েও একই কথা বলেন৷ জানা গেছে এখন এইসব বিষয় নিয়েই জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করছে৷ নির্বাচনের তারিখ পেছানো না হলেও মামলার ব্যাপারে সরকার এরশাদকে আশ্বস্ত করছে৷ তবে তা মামলা প্রত্যাহার করে না অন্যকোন উপায়ে সে বিষয়টি জানা যায়নি৷ তবে এরশাদ মামলার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিয়েছেন৷
এদিকে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, জাতীয় পার্টি না থাকলেও নির্বাচন নির্ধারিত সময়েই হবে৷ তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি একেক সময় একেক কথা বলে৷ তারা নির্বাচনে ফিরে আসবে কিনা তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷ নির্বাচন পেছানোর কোন সম্ভাবনা নেই৷ আর রাজনৈতিক কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা হবে৷ তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠেনা৷ শেখ হানিাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই নির্বাচন হবে৷
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ প্রতিদিনের মত শুক্রবারও অল্প সময়ের জন্য সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ তিনি জানান সংবাদ মাধ্যমে যেভাবে এসেছে বুধবার রাতে তিনি সেভাবে আত্মহত্যার কথা বলেননি৷ তিনি বলেছেন তাকে আটক করে তার কাছ থেকে মিথ্যা বিবৃতিতে সই নেয়া হতে পারে৷ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি এখনো নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল আছেন৷ আবারো বলেছেন সময় মত মন্ত্রীদের পদত্যাপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে৷