আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতবছর চমৎকার একটি মন্তব্য করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, বাঘ বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে৷ খুবই সত্যি কথা৷ কিন্তু বাঘ বাঁচানোর জন্য আমরা কী করছি?
বিজ্ঞাপন
এ নিয়ে তথ্য খুঁজতে গিয়ে অন্তত দুটি প্রকল্পের কথা জানতে পারলাম৷ একটি ‘বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান' ৷ অন্যটি ‘বাঘ প্রকল্প' ৷ প্রথমটি বাস্তবায়ন করছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং বন অধিদপ্তর৷ সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও স্থানীয় কয়েকটি সংস্থা৷ এই প্রকল্পে কাজ শুরু হয়েছে ২০০৯ সালে, চলবে ২০১৭ সাল পর্যন্ত৷
এদিকে, বাঘ প্রকল্পের কাজের উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএইড৷ তারা কাজটি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশের ‘ওয়াইল্ডটিম'-কে৷ সঙ্গে বন রয়েছে অধিদপ্তর ৷ এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে, চলবে ২০১৮ পর্যন্ত৷
অর্থাৎ একই সময়ে বাঘ রক্ষায় দুটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে৷ কিন্তু এই সময়ে এসেই আমরা জানতে পারলাম যে, আমাদের সুন্দরবনে মাত্র ১০৬টি বাঘ আছে৷ ১০ বছর আগে করা জরিপে যে সংখ্যাটা ছিল ৪৪০৷ অবশ্য বলা হচ্ছে আগের জরিপ পরিচালনার নিয়মটি নাকি ত্রুটিপূর্ণ ছিল৷ তাই বাঘের সংখ্যা ৪৪০ থেকে কমে একেবার ১০৬ হয়ে গেছে, সেটা বলা যাবে না৷ বুঝলাম৷ হয়ত ১০ বছরে এতগুলো বাঘ হত্যা করা হয়নি বা ভারতে চলে যায়নি৷ কিন্তু বাঘের সংখ্যা নিশ্চয় কিছু কমেছে৷ অন্তত বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন৷ শিকারি আর চোরাকারবারীদের দৌরাত্মের কারণে নাকি বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমছে৷
তবে বাঘের সংখ্যা কমেছে কি কমেনি তা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই৷ এখন যে ১০৬ টি বাঘ আছে বলে বলা হচ্ছে (এবার নাকি জরিপ প্রক্রিয়া ঠিক ছিল) তার সংখ্যা কীভাবে বাড়ানো যায় সেটা ভাবতে হবে৷ আর ১০৬ থেকে সংখ্যাটা যেন কোনোভাবেই না কমে সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷
এই দুটো কাজের জন্যই চলমান প্রকল্পগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে৷ দুটো প্রকল্পের সঙ্গেই যেহেতু সরকারি সংস্থা জড়িত সেহেতু প্রকল্পগুলো অন্য অনেক সরকারি প্রকল্পের মতো সফল নাও হবার আশঙ্কা থেকেই যায়৷ প্রকল্পের টাকায় সরকারি ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শুধু পকেট ভারিই হতে পারে৷ সেটা যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে পারেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী৷ জানি, ছোটখাটো কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না৷ কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই যদি কোনো কাজ সফলভাবে করতে নির্দেশ দেন তাহলে সেটা সঠিকভাবে করেন সরকারি কর্মকর্তারা৷ চলমান পদ্মা সেতু নির্মাণকাজে সেটাই দেখা যাচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রীর কড়া নজরদারির কারণে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেতুর নির্মাণকাজ৷
বিলুপ্তির পথে বাঘ
২৯শে জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস৷ মূলত বিশ্বের অন্যতম রাজকীয় এই প্রাণীর উপর সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পালন করা হয় এই দিবস৷ বর্তমানে গোটা বিশ্বের বাঘের সংখ্যা মাত্র ৩,২০০টি৷ তাদের রক্ষায় কী করা হচ্ছে, জানুন এই ছবিঘর থেকে৷
ছবি: dapd
নাটকীয় হারে কমছে
২৯শে জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস৷ মূলত বিশ্বের অন্যতম রাজকীয় এই প্রাণীটি রক্ষায় উদযাপন করা হচ্ছে এই দিবস৷ গত শতকে গোটা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখ৷ আর বর্তমানে জঙ্গলে বাঘের এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩,২০০তে৷ এভাবে কমতে থাকলে আগামী দশ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে বাঘ৷
ছবি: AP
পৌরাণিক কাহিনিতে বাঘ
মানুষের কাছে অন্যতম সম্মানিত প্রাণী হিসেবে বাঘের কথা বিভিন্ন সংস্কৃতির পুরাণে রয়েছে৷ চীনের রাশিচক্রে উল্লিখিত ১২টি প্রাণীর একটি বাঘ৷ এই প্রাণীকে বনের রক্ষক এবং ক্ষমতা, শক্তি ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক মনে করা হয়৷ চীনে পরবর্তী বাঘের বছর ২০২২ সাল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উপপ্রজাতিগুলোও হুমকির মুখে
উনিশ শতক অবধি বাঘের নয়টি উপপ্রজাতির দেখা মিলেছিল গোটা বিশ্বে৷ বর্তমানে, ইন্দো-চায়না, মালয়, রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং আমুর বাঘ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে৷ আর সুমাত্রান এবং দক্ষিণ চীনের বাঘের অবস্থা আরো সঙ্গিন৷ বালি দ্বীপ, জাভা এবং কাস্পিয়ান অঞ্চলের বাঘ গত ৮০ বছরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ বাঘের বিভিন্ন উপপ্রজাতির মধ্যে আকার, রং এবং লোমের আচ্ছাদনে পার্থক্য রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে
ঐতিহাসিকভাবে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, তুরস্ক, রাশিয়ার পূর্ব উপকূল, চীন এবং সার্বিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে বাঘের আবাসভূমি৷ কিন্তু বর্তমানে বাঘের আবাসের ৯৭ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে৷ মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড – যেমন বাসস্থান সম্প্রসারণ, চাষাবাদ এবং রাস্তা নির্মাণের মতো কারণে বাঘের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে৷ থাকার জায়গার সংকটের কারণে সহজেই শিকারিদের ফাঁদে ধরা পড়ছে বাঘ৷
ছবি: AP
অবৈধ বাণিজ্য
গত এক হাজারেরও বেশি সময় ধরে চীন এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রথাগত ঔষধ তৈরিতে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ মূলত বাত এবং চর্ম রোগেই চিকিৎসায় এসব ব্যবহার করা হয়৷ ১৯৮৭ সাল থেকে অবশ্য বাঘের দেহের বিভিন্ন অংশ বিক্রি আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ৷ তবে এখনো কালোবাজারে বাঘের চাহিদা অনেক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খামারে বাঘ
জঙ্গলে খুব অল্প কিছু বাঘ টিকে থাকলেও বিভিন্ন খামার এবং চীন ও এশিয়ার বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বর্তমানে বন্দি আছে পাঁচ হাজারের মতো বাঘ৷ পরিবেশ বিষয়ক অনুসন্ধানী এজেন্সি গত ফেব্রুয়ারি মাসে জানিয়েছে, খামারে পালন করা বাঘের চামড়া এবং হাড় ব্যবহার করে বিলাসী আসবাব এবং ওয়াইন তৈরি করা হয়৷ এ কারণে জঙ্গলে মুক্ত পরিবেশে থাকা বাঘও শিকার করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিনোদনে বাঘ
সেই সতেরো শতক থেকে সার্কাসে ব্যবহার হচ্ছে বাঘ৷ প্রাণিবাদিরা সার্কাসে বাঘের এ ধরনের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন৷ বিশেষ করে বাঘকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পদ্ধতি, ক্রমাগত ভ্রমণ এবং অপ্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা৷ ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে সার্কাসে বনের প্রাণী ব্যবহারের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ভূমি দখল নিয়ে বাঘ এবং মানুষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে জঙ্গলের বাঘ আরো হুমকির মুখে পড়ছে৷ জঙ্গলের পরিধি কমায় খাদ্যের সন্ধানে বাঘ লোকালয়ে হাজির হচ্ছে, হামলা চালাচ্ছে বিভিন্ন গবাদি পশুর উপর৷ ছবিতে একটি বাঘিনীর মরদেহ পরীক্ষা করছেন ভারতের বন কর্মকর্তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংরক্ষণের প্রচেষ্টা
২০১০ সালের নভেম্বরে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে বাঘ আছে বাংলাদেশ সহ এমন ১৩টি দেশ ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে৷ এজন্য বাঘ শিকার বন্ধ এবং বাঘের আবাসস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ ছবিতে শুল্ক বিভাগের হাতে আটক বাঘের চামড়া দেখানো হচ্ছে৷
ছবি: AP
চিড়িয়াখানায় অথবা জঙ্গলে, নাকি দু’টোতেই?
এমনকি স্বনামধন্য চিড়িয়াখানাতেও বাঘের প্রজনন প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে৷ এক্ষেত্রে চিড়িয়াখানাগুলোর মন্তব্য হচ্ছে, তারা গবেষণা এবং জীনগতভাবে বৈচিত্র্যময় বাঘের বংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে৷ তবে ‘‘বর্ন ফ্রি’’ এর মতো সংগঠনগুলো চায়, বাঘ রক্ষায় জঙ্গলেই আরো উদ্যোগ নেওয়া হোক৷
ছবি: dapd
10 ছবি1 | 10
এখন প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রীর কেন বাঘ রক্ষায় নজর দেয়া উচিত? তিনি নিজেই বলেছেন, বাঘ বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে৷ সুতরাং তিনিই ভালোভাবে বোঝেন কেন বাঘ রক্ষা জরুরি৷ এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটের বিশেষ ভক্ত৷ আর আমাদের ক্রিকেটারদের সারা বিশ্ব চেনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে৷ যে বাঘের নামে আমাদের সবাই চেনে সেটার অস্তিত্বই যদি না থাকে তাহলে সেটা নিশ্চয় ভালো কোনো কথা নয়৷ নজরদারি না বাড়ালে বাঘের সংখ্যা ১০৬ থেকে কমে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়তে হয়ত বেশি সময় লাগবে না৷ অর্থাৎ একটা দেশ তখন জাতীয় প্রাণীশূন্য হয়ে পড়বে, যেটা হবে খুবই লজ্জার৷
কারণ আরেকটি আছে৷ বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুন করার পরিকল্পনা করেছে ‘গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভ' বা জিটিআই৷ বাংলাদেশ এই উদ্যোগের এক অংশীদার৷ ২০১০ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়৷ সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এছাড়া গত বছর ঢাকায় জিটিআই এর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সেটি উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ এর মাধ্যমে বাঘের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর যে আগ্রহ আছে সেটা বোঝা যায়৷ এখন শুধু সেই আগ্রহটাকে কাজে লাগাতে হবে৷ প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে সুন্দরবন থেকে শিকারি ও চোরাকারবারীদের হটাতে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দেয়া৷ বঙ্গবন্ধুর কন্যা নিশ্চয় সেটা করবেন৷